প্রাচীন সাহিত্যের অপূর্ব এক বর্ষাকাব্য ‘মেঘদূত’
‘মেঘদূত’ আনুমানিক ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে মহাকবি কালিদাস রচিত একটি কাব্য। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হওয়ার কারণে অনেকের কাছেই এর পাঠ কিছুটা দুর্বোধ্য। তাই অসাধারণ এ সাহিত্যকর্মের অর্থ বিশ্লেষণ নিয়ে বিভ্রাট এড়াতে বিভিন্ন সাহিত্যিক এই কাব্যের অনুবাদ করেন। এদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বহু গুণী কবিসাহিত্যিকগণ বহুরূপে মেঘদূতকে অনুবাদ করেছেন।মেঘদূত কাব্যর প্রতিটি অনুবাদের রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র্যময় আবেদন। মেঘদূত কাব্য যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, প্রাচীন সাহিত্যের কালজয়ী এই লেখাটির ভাবগাম্ভীর্য ও তাৎপর্য ছিল অনিন্দ্যসুন্দর।
ঋতুবৈচিত্রে বর্ষা ফিরে আসে বারে বারে। নবরূপে জেগে ওঠে প্রকৃতি।কদম গাছে থোকায় থোকায় কদম ফুল ফোটে। ঝুম বৃষ্টি কিংবা মেঘলা দিনে হঠাৎ করেই আমাদের মন কেমন যেন উদাস হয়ে ওঠে!আষাঢ়ের মেঘ-বৃষ্টি প্রিয় মানুষটির কথা মনে করিয়ে দেয় বারে বারে। প্রযুক্তিগত সুবিধার কারনে এখন আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের সাথে মুহূর্তেই মনের সমস্ত আবেগগুলো শেয়ার করতে পারি। হৃদয়ের কথা মুহূর্তে পৌঁছে যায় প্রিয় মানুষটির কাছে। কিন্তু ধরুন মোবাইল ফোন বা ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার যদি না থাকত তাহলে কি করতেন? কি করে জানাতেন তখন এই পাগল করা আষাঢ়ের রূপ দেখে প্রিয় মানুষটিকে আপনার মনের কথা?
বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনগুলো প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনেও যোগ করে নতুন মাত্রা। তাই বর্ষাকে ঘিরে যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন দারুণ সব কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস। বহু বছর আগে আষাঢ়ের এমনই এক দিনে প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠানোর আকুলতাকে ঘিরে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বর্ষাকাব্য ‘মেঘদূত’, যা সংস্কৃত সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বহু ভাষা, সাহিত্য ও মানুষের হৃদয় গহীনে জায়গা করে নিয়েছে। আর মেঘদূতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে বর্ষায় মানব মনের গভীর আকুলতা।মূলত বিরহ, অপেক্ষা আর প্রেয়সীর কাছে মনের কথা বা বার্তা পাঠানোর আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে অসাধারণ এই কাব্য।
‘মেঘদূত’ কাব্যের মূল চরিত্রে আছে যক্ষ এবং তার পত্নী। তাদের নিবাস অলকা নগরীতে। যক্ষ ছিল রাজা কুবেরের সেবায় নিয়োজিত এক সেবক। সে ধনপতি কুবেরের বাগান দেখাশোনা করত। কিন্তু একদিন যক্ষ বাগান অরক্ষিত রেখে তার স্ত্রীর কাছে গেলে হাতির পাল সেই বাগানে ঢুকে বাগান নষ্ট করে দেয়। আর এ কারণে যক্ষ তার প্রভু কুবেরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এক বছরের জন্য নির্বাসিত হয় রামগিরিতে।
প্রিয়ার বিরহে যক্ষের নির্বাসিত সময় কাটতে থাকে রামগিরিতে। ঋতু পাল্টে আসে আষাঢ় মাস। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘের আগমনে প্রকৃতির নিয়মেই যক্ষের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার প্রিয়ার জন্য। বিরহী যক্ষ তখন মেঘের কাছে অনুনয় জানায়, তার মনের গভীরে থাকা কথা অলকা নগরীতে তার প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। আর যক্ষ প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে বার্তা পাঠানোর কাহিনীকে উপজীব্য করেই রচিত হয়েছে মহাকবি কালিদাস রচিত সংস্কৃত সাহিত্যের বহুল সমাদৃত কাব্য ‘মেঘদূত’।১১৮টি শ্লোক বিশিষ্ট কবি কালিদাস মেঘদূত কাব্য রচনা করেছেন এবং তা দু’টি খণ্ডে ভাগ করেছেন; উত্তরমেঘ ও পূর্বমেঘ।
পূর্বমেঘের প্রথম অংশে মেঘদূত কাব্যের ঘটনাপ্রবাহের আরম্ভ, এ অংশেই দেখা মিলবে মেঘদূত কাব্যের নায়ক যক্ষের সাথে। এরপর পর্যায়ক্রমে এসেছে তার প্রেয়সী এবং অলকা নগরীর কথা। সদ্য বিবাহিত যক্ষ আর তার পত্নীর নিবাস অলকা নগরীতে। এরপর কাহিনীর মোড় নিতে আগমন হয়েছে যক্ষের প্রভু ধনদেবতা কুবেরের। ঘটনাপ্রবাহে যক্ষ নির্বাসিত হয় রামগিরিতে। আর এখান থেকেই গল্পের মূল অংশ। নির্বাসিত যক্ষ রামগিরি থেকে অলকা নগরীতে তার প্রিয়ার কাছে বার্তা পাঠানোর জন্য মেঘের কাছে জানায় আকুল আবেদন।
এই ঘটনার প্রবাহের বিপরীতে পূর্বমেঘের মূল আকর্ষণ হচ্ছে রামগিরি থেকে অলকা নগরীর মেঘের যাত্রাপথের বর্ণনা। মেঘ যখন যক্ষের বার্তা নিয়ে অলকা নগরীর দিকে যাবে, সে যাত্রাপথের সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে কাব্যর শ্লোক ১৬ থেকে ৬৪ পর্যন্ত। পূর্বমেঘের এ অংশে অলকা নগরীর যাত্রাপথের সৌন্দর্য বর্ণনা দিতে কবি ব্যবহার করেছেন অনিন্দ্যসুন্দর সব উপমা আর ফুটিয়ে তুলেছেন রামগিরি থেকে অলকা নগরী পর্যন্ত অখণ্ড ভারতের অসাধারণ রূপ।পূর্বমেঘ পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অলকা নগরীর যাত্রাপথে উজ্জয়নী, অবন্তি অথবা বিদিশা নগরীর দৃশ্য। কিংবা কানে বেজে উঠবে রেবা, শিপ্রা ও বেত্রবতী নদীর বহমান জলধারার কলকল ধ্বনি ও ভেসে আসবে নদীর তীরের ভুঁইচাপা ফুলের সুবাস।আবার ‘পূর্বমেঘ’ পড়তে পড়তে সন্ধ্যা নামতে পারে বিন্ধ্য, কৈলাস কিংবা দেবগিরি পাহাড় চূড়ায়। আবার কখনও হারিয়ে যাবার সাধ জাগে মেঘের যাত্রাপথের কেতকী বনে। পথিমধ্যে দেখা মিলবে আনন্দিত চাতকের দলের সাথে। আর বইয়ের পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়াবে বর্ষার স্নিগ্ধ সতেজ কদমগুচ্ছ ফুলের সৌরভ।
এরপর উত্তর মেঘের বর্ননায় বহু নগর, পাহাড়, নদী আর বন পেরিয়ে মেঘ পৌঁছায় অলকা নগরীতে।পূর্বমেঘ জুড়ে অলকা নগরীর যাত্রাপথের বর্ণনা শেষ হবার পর দেখা মেলে যক্ষপ্রিয়ার বাড়ির। উত্তর মেঘের বর্ণনায় পাঠকের মানসপটেও সেই বাড়িটি ভেসে উঠবে অবিকলভাবে।মেঘ যখন কুবেরের বাড়ি পৌঁছবে, তখন দেখা মিলবে বাড়ির পাশের উঠোনে থাকা মন্দার গাছটির। আর কিছুদূর পাশেই আসছে পান্নাশোভিত চমৎকার একটি হ্রদ, যেখানে তখন ভেসে বেড়াবে হাঁসের দল আর নীলকান্তমনি শোভিত পদ্মের কাণ্ডে ছেয়ে থাকবে সেই পুরো হ্রদ।
এভাবেই অলকাপুরী আর যক্ষের বাসগৃহের বর্ণনার পর দেখা মিলবে যক্ষপ্রিয়ার। হালকা গড়নের ঈষৎ শ্যামলা বর্ণ- এমনভাবেই তার রূপের বর্ণনা শুরু হয়েছে। এরপর বহু উপমা আর রূপে রঞ্জিত হয়েছে যক্ষপ্রিয়া। শুধু সৌন্দর্যের বর্ণনাই নয়, যক্ষের বিরহে বিনিদ্র রজনী পার করে যক্ষপ্রিয়ার মলিন দশাও বর্ণিত হয়েছে এক দারুণ ভঙ্গিমায়।
এরপর মেঘ পৌঁছে যায় যক্ষপ্রিয়ার কাছে এবং তাকে পৌঁছে দেয় বহু প্রতীক্ষিত যক্ষের বার্তা। এভাবেই প্রেয়সীর কাছে যক্ষের বার্তা পৌঁছানোর মধ্য দিয়েই ‘মেঘদূত’ কাব্যটি এর নামের সার্থকতা পায়। প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার এক উজ্জ্বল নিদর্শন অনবদ্য এক মনোমুগ্ধকর সৃষ্টি, মহাকবি কালিদাসের কালজয়ী এই মহাকাব্য ‘মেঘদূত’ যেমন সমাদৃত হয়েছে সাহিত্যাঙ্গনের সর্বক্ষেত্রে তেমনি পাঠক হৃদয় জয় করেছে যুগে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।