লেখক: সিদ্ধার্থ সিংহ
মাহেশের স্নানযাত্রা
মাহেশের জগন্নাথদেবের মন্দির সন্বন্ধে কথিত আছে যে, পূরী থেকে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব গঙ্গাস্নান করে মাহেশে এসে বিশ্রাম করেছিলেন বলে এখানেই মন্দির নির্মাণ করা হয় এবং সেই মন্দিরে দেব-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জগন্নাথদেবের সেই স্নানের ঘটনাকে স্মরণ করেই প্রতি বছর রথের ঠিক আগেই জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মহা ধূমধামের করে স্নানযাত্রা উৎসব পালন করা হয়। এ বছর ৬২৮ তম বর্ষে পা রাখতে চলেছে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম শ্রীরামপুরের সেই ঐতিহাসিক মাহেশের স্নানযাত্রা।
১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে যে নিয়মনিষ্ঠা মেনে স্নানযাত্রা শুরু হয়েছিল, আজও সেই প্রথা মেনেই ভোর থাকতেই তিন বিগ্রহকে মন্দিরের বাইরে স্নানপিড়ি ময়দানে এনে রাখা হয়। তার বহু আগে থেকেই অবশ্য স্নানমঞ্চকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। মন্দির গর্ভ থেকে স্নানমঞ্চ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে করা হয় শুদ্ধিকরণ। ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে যাতে স্নানযাত্রায় কোনও বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য পুরো জায়গাটা ঘিরে ফেলা হয়। মহন্তরা নতুন বস্ত্র পরে ২৮ ঘড়া গঙ্গাজল আর দু’মণ দুধ দিয়ে জগন্নাথদেবের বিগ্রহকে স্নান করান। সঙ্গে স্নান করানো হয় বলরাম আর শুভদ্রাকেও। জনশ্রুতি আছে, এই স্নানের পরেই জগন্নাথদেবের ধুম জ্বর আসে। তাই স্নানযাত্রার পরে তিন বিগ্রহকেই কম্বল দিয়ে মুড়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে রাখা হয়।
এরপর রথের আগের দিন জগন্নাথদেবকে পরানো হয় রাজবেশ। ভগবানের সেই রূপকে নবযৌবন বলা হয়। প্রথা মাফিক, রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিড়ি ময়দানে এক মাস ধরে মেলা চলে। শ্রীরামপুরের মাহেশের জগন্নাথদেবের মূল মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকে বের করে এনে বসানো হয় ৫০ ফুট উচু রথে। জিটি রোড দিয়ে সেই রথ লক্ষ লক্ষ মানুষ টেনে নিয়ে যায় গুন্ডিচা মন্দিরে, মানে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়িতে। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। যে ৯ দিন জগন্নাথদেব রাধাবল্লভের ঘরে থাকেন, তার নাম গঞ্জবাড়ি।
শুধু যে পুন্য করার জন্যই লোকজন স্নানযাত্রায় যান তা নয়, আগেকার দিনে বেশির ভাগ বাবুরা আমোদ-প্রমোদ করতেই যেতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’য় সেই ছবি ধরা পড়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘পূর্ব্বে স্নানযাত্রার বড় ধুম ছিল— বড় বড় বাবুরা পিনেস, কলের জাহাজ, বোট ও বজরা ভাড়া করে মাহেশে যেতেন, গঙ্গায় বাচখ্যালা হতো, স্নানযাত্রার পর রাত্তির ধরে খ্যামটা ও বাইয়ের হাট লেগে যেতো! কিন্তু এখন আর সে আমোদ নাই। সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই।
এই মেলায় শুধু বাইজিদের চটকদার নাচ কিংবা জুয়াখেলাই নয়, মেয়েদেরও কেনাবেচা হত। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে রথযাত্রা উপলক্ষে একজন লোক জুয়াখেলার জন্য মেলায় তাঁর স্ত্রীকে পর্যন্ত বিক্রি করেছিলেন। ১২২৬ সালের ৬ই আষাঢ় ‘সমাচার দর্পণ’-এ সে খবর ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল। খবরে লেখা হয়েছিল— এখানে প্রথম দিনে অনুমান এক দুই লক্ষ দর্শনার্থী আইসে এবং এই যাত্রার সময় অনেক স্থান হইতে অনেক অনেক লোক আসিয়া জুয়াখেলা করে। ইহাতে কাহারো কাহারো সর্বস্ব নাশ হয়। এইবার স্নানযাত্রার সময়ে দুইজন জুয়া খেলাতে আপন যথাসর্বস্ব হারিয়া পরে অন্য উপায় না দেখিয়া আপন যুবতী স্ত্রী বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল এবং তাহার মধ্যে একজন খানকীর নিকটে দশ টাকাতে আপন স্ত্রী বিক্রয় করিল।’
সেকালে মাহেশের স্নানযাত্রায় কী রকম লোকসমাগম হত এবং এই উৎসব ঘিরে বাবুরা কী ভাবে আমোদ-প্রমোদ করত, তা সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে স্নানযাত্রা নিয়ে লেখা কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি কবিতায়। কবিতাটির কোথাও কোথাও অশ্লীলতা থাকলেও, তখনকার সামাজিক অবস্থা কী রকম ছিল, তা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। তিনি লিখেছেন—
বৃষপূর্ণিমার দিবা,/ অপার আনন্দ কিবা/ মাহেশে সুখের মহামেলা/ স্নানযাত্রা প্রতি বর্ষে,/ এই দিন মহা হর্ষে,/মেলা পেয়ে করে সবে খেলা॥/ হাড়ি মুচি যুগী জোলা,/ কত বা সেখের জোলা/ জাঁকে জাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে চলে।/ ঠেলাঠেলি চুলো চুলি,/ কাঁকে কাঁকে ঝুলোঝুলি/ লোকারণ্য জলে আর স্থলে।।/ আগে পাছে পাকাপাকি/ আঁকা আঁকি তাকা তাকি/ ঝাঁকা-ঝাঁকি স্থান নাহি পায়।/এসে বাড়ী যত রাড়ী/ কাঁকে ক’রে কেলে হাঁড়ি/ হাতে পাখা কট্টটাল মাথায়।।/ ভদ্র যত মন শাদা/ পরম্পর করি চাঁদা,/ রচির তরণী লয়ে ভাড়া।/ যাহাতে আসক্তি যাঁর/ সেই শক্তি সঙ্গে তার,/ গরবেতে গোঁপে দেয় চাড়া।।/ গায়ে বাটি/ তবলায় মুখে চাঁটী,/ পরিবাটী খান কসে কসে।/ পূর্ণ হ’লে ইচ্ছে যেটা,/ স্নান আর দেখে কেটি/ প্রধান পান এক ঠাঁই বসে।।/ লম্পট যুবক যারা/ বাচ করে ফেরে তারা/ ধীরে ধীরে তীরে চালে ডিঙ্গে।
বছর বছর ভিড় বাড়লেও গত বছর অতিমারির কারণে কোভিদ রীতি মেনে মাত্র কয়েকজন মহন্ত আর সেবাইতের উপস্থিতিতে স্নানপিড়ি ময়দানে নয়, মূল মন্দিরেই আয়োজন করা হয়েছিল স্নানযাত্রা। এমনকী ভক্তদের ভিড় এড়াতে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যেই অস্থায়ী ভাবে তৈরি করা হয়েছিল জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি। বিগ্রহের বদলে শুধু নারায়ণ শিলাকেই জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দিরে পাঠানো হয়েছিল। তাতে অবশ্য রীতি, আচারে এতটুকুও ফাঁক থাকেনি। নিষ্ঠা ভরেই পালিত হয়েছিল জগন্নাথের স্নানযাত্রা। তার আগের দু’বছর অতিমারির কারণে সেই আড়ম্বরেও ছেদ পড়েছিল।
ঐতিহাসিক এই রথে প্রতি বছর জগন্নাথ, বলরাম, সুভ্রদাকে বসানোর পরে একটি বিশেষ পুজো করা হয়। সেই পুজো দামোদর পুজো নামে খ্যাত। রথ যাত্রায় এখানে ভোগ হিসেবে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, আলুরদম, ধোঁকার ডালনা, পনির এবং পায়েস। সোজা রথ থেকে উল্টো রথ অবধি প্রতিদিন নানা রকমের পদ রান্না করে দেওয়া হয় জগন্নাথ-বলরাম-সুভ্রদাকে।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল, চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেব। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পুজো করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শ্রীচৈতন্য পুরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে তিনি মাহেশে পৌঁছেছিলেন। ধ্রুবানন্দের মন্দির পরিদর্শন করার পরে তিনি তাঁর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং গভীর সমাধিতে মগ্ন হন। শ্রীচৈতন্য মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ অর্থাৎ ‘নতুন পুরী’ বলে নামকরণ করেছিলেন। পরে বৃদ্ধ ধ্রুবানন্দ তাঁকে মন্দিরের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এতে মহাপ্রভু কমলাকার পিপলাইকে মন্দিরের ভার দেন। যিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের দ্বাদশ গোপালদের মধ্যে পঞ্চম। এর কিছুদিন পর ধ্রুবানন্দ দেহ রাখেন। কমলাকার সুন্দরবনের খালিঝুলির জমিদারের পুত্র। তিনি যুক্তিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে নবদ্বীপে এলেন। পরে তিনি মহাপ্রভুর একজন প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন এবং তাঁর মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। তিনি ৬৪ মহন্তের মধ্যে প্রথম। মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে ভার গ্রহণ করার পর, তিনি সেখানে থাকতে শুরু করেন। তিনিই এই বিখ্যাত রথ উৎসব ৬২৭ বছর আগে শুরু করেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরা এখনও সেবাইত বা মন্দির ‘অধিকারী’ হিসেবে মাহেশে বসবাস করেন। এই কমলাকার পিপলাই-ই ৬২৭ বছর আগে, মানে ১৩৯৬ বঙ্গাব্দে তৈরি করেন শ্রীরামপুরের ১২৫ টন ওজনের ৫০ ফুট উচু, ১২ চাকার প্রথম রথযাত্রা।
পরবর্তিকালে ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথদেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন, যা আজও রয়েছে। মাহেশের রথ পুরীর মতো কাঠের নয়। এটা সম্পূর্ণ লোহার রথ। যা ১৩৮ বছরের পুরনো। এখানে পুরীর মতো জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার আলাদা আলাদা রথ নেই । একটি রথেই তিন দেবতা পূজিত হন। আগে এই রথ কাঠের ছিল। যদিও দীর্ঘ দিন ধরে সেই রথ পুজিত হতে হতে কাঠের সেই রথে ক্ষয় ধরতে শুরু করে।
শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সঙ্গে মাহেশের অধিকারী পরিবারের দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ। তাঁরা জগন্নাথ মন্দিরের সেবক। তাঁরা ইচ্ছা প্রকাশ করেন নতুন রথ তৈরি করে দেবেন। ১৩৭ বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কাঠের রথ বদলে ফেলা হবে। রথ হবে লোহার। সেই রথ এখনও পুজিত হয়ে আসছে৷ সে যুগে ২০ হাজার টাকা খরচ করে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং দু’টি তামার ঘোড়া।
পুরীর পাশাপাশি মাহেশেও জগন্নাথদেবের স্থানযাত্রা ও রথযাত্রা উপলক্ষে শ্রী চৈতন্যদেব, শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদাদেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে। স্থানীয় মানুষজন তথা দূরদূরান্তের ভক্তদের কাছেও এই স্নানযাত্রা ও রথযাত্রার গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাহেশের রথ এবং মেলা ঘুরে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, একটা গোটা উপন্যাসই লিখে ফেলেছিলেন। উপন্যাসটির নাম ‘রাধারাণী’। সেখানে মাহেশ রথযাত্রার বিস্ময়কর বিবরণ পাওয়া যায়।
এই প্রসঙ্গে জগন্নাথ মন্দির কমিটির সম্পাদক পিয়াল অধিকারী বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ মাহেশে উপস্থিত হয়ে প্রভু জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রায় সামিল হন। প্রভুর আশীর্বাদ নেন। কিন্তু মহামারীর জেরে মাঝের দু’বছর মহাপ্রভুর রথযাত্রা এবং স্নানযাত্রা মূল মন্দিরেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই কড়াকড়ি বিধি-নিষেধ আর নেই। অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে।