গল্প: কমপ্লেইন।। পবিত্র মণ্ডল - শৃণ্বন্তু গল্প: কমপ্লেইন।। পবিত্র মণ্ডল - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ অপরাহ্ন

গল্প: কমপ্লেইন।। পবিত্র মণ্ডল

আপডেট করা হয়েছে : সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪, ৭:৩৭ অপরাহ্ন
গল্প: কমপ্লেইন।। পবিত্র মণ্ডল

  গল্প: কমপ্লেইন

 

    পবিত্র মণ্ডল 

খুব সন্তর্পনে কলাগাছের আড়ালে দাঁড়ায় লোকটা। সময় বুঝে বাগাত নিয়ে আড়াল ফুঁড়ে পুকুরে একটা খ্যামন। কলাগাছের একটা বেগোয় সামান্য বাধলেও খ্যাপলা জাল ছড়ছড়িয়ে গোল। পাতা ক’টা না কাটলে নয়। এবার অপেক্ষা। জালের কাঠি মাটিতে না থিতানো পর্যন্ত। টইটুম্বুর জল। যদিও বর্ষাকাল নয়। শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের শেষাশেষি। শরতেও বেদম বৃষ্টির রেশ। পয়লা খ্যামোন যুতসই না হলে এই জলে মাছ ফক্কা। পুকুরে কিছু কাঠকুটোও আছে। একবার ঘা পেলেই মাছ সব সাঁধায়।
ধীরেসুস্থে জাল টানে অচিন্ত্য। জালের কেঠে দড়ি বেয়ে হাতে একটা ঠোক্কোর টের পেয়েছে। পড়িস একখান। কানা পোকড়া যা হয়, একটা হলে আর লাগবে না। মানুষ মাত্তর দুজন। কুলিয়ে যাবে। না, লোক কুটুম্ব আসেনি, নিজারাই।
গাঙের মাছ ছাড়া হাট বাজারের দেশি মাছ খুব একটা কেনে না অচিন্ত্য। দু-আড়াই কাঠা পুকুরে আষাঢ়ে ভন্নার আগে বছরসনের মাছ ছেড়ে নিশ্চিন্ত। টুকটাক খুটেবেছে বছর গড়ায়। কখনও জষ্ঠ্যির জো থাকতে পুকুরে এক-দু গিরু লম্বা মাছের ছানাপোনা ছাড়ে। রোদে তেতে চরা খেয়ে ডাঁটো হয়ে মালগুলো বাড়ে ভালো। এবার একটু কম ছাড়া হয়েছে বলে সেদিন বউয়ের কী তড়পানি!
-এখনও জাল ঝাড়ছিস! যাবি না!
অচিন্ত্য কলাপাতার ফাঁক গলিয়ে রাস্তায় দৃষ্টি মারে। বাদল খুড়ো। পাড়ার মাঝ ষাটের লোক। হনফনিয়ে দক্ষিনমুখো। পাকাঠি শরীরে লুঙ্গি, কাঁধে ভাঁজ করা গামছা, হাতে বাজারের নাইলন ব্যাগ। ব্যাগটা একটু মোটা – জামাটা ওর খোলে ছাড়া হয়তো! গন্তব্যে ঢোকার আগে খাটিয়ে নেবে গায়ে। বলে – চলে আয়, বাবুরা এতক্ষনে এসে গেছে হয়তো!
জাল হাতে গোটাতে গোটাতে অচিন্ত্য জিজ্ঞাসে – আজ নাকি?
-আজ নয় তো কী! ১১ই পোষ, বিষ্যুদবার!
– হুঁ, যাচ্ছি, একটু পরে। তুমি যেতে থাকো।
অচিন্ত্য জাল তুলে নিশ্চিন্ত। একটা বাটা মাছ – চার-পাঁচ টুকরো হবে, একটা ছোটো ছাটি চিংড়ি, ক’টা আঙুলে পুঁটি, মরখুল্ল, একটা গোল কাঁকড়া, আর খানিক পাতাপুতি – পুকুরপাড়ে একটা বটগাছ আছে।
অভিজ্ঞজনেরা কয় – পুকুরপাড়ে বড়ো গাছপালা একদম নয়। পুকুরের ক্ষতি – ছায়া, হাওয়াবাতাস, মাছের শরীরস্বাস্থ্য, পাতা পড়ে জলের বারোটা পুরে মাছের আকাল। সেজন্যে মাছ ভালো বাড়েও না পুকুরটায়। বউ কৃষ্ণার বিরাট অভিযোগ বটগাছটা নিয়ে – বটগাছ গৃহস্থালির পক্ষে একটা ফাও গাছ, ছায়ার চোটে খন্দপাতি হয় না, কাঠকুটোয় ধর্মমতে না করা যায় জ্বালানী, না ঘরদোরের খোঁটাখুঁটি, টেঁকেও না, ঘেরাবেড়ায় গুঁজে দিলেও পরের সন আর আসে না। অচিন্ত্য ভেবেছে, কেটে ফেলবে, কিন্তু বটগাছের ছায়ায় বড্ডো মায়া। পুকুরটা একটু কষ্ট পেলেও গরমে গরু ছাগোলের বড্ডো আরাম। ও নিজেও তিষ্টোতে না পেরে কোনও কোনও দিন একটা খেঁজুর চ্যাটাই পেতে গড়িয়ে নেয় বটের ছায়ায়।
মাছ কাঁকড়া বালতিতে পুরে, জালটা ভালোমতো ঝেড়ে, ধুয়ে সোনাঝুরির খাঁজে লোটকে অচিন্ত্য ব্যস্ত ঘরে ঢুকল। ছিটকানো কাদামাটি হাতে পায়ে ফুট কেটে চকরাবকরা।
কৃষ্ণা দুপুরে রান্নার শাকপাতা কুটছিল। অচিন্ত্যপানে একটু তাকিয়ে স্বগতোক্তি ছাড়ে – লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কাদা মাটি হাতে পায়ে ঘরে –
ঘর থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া আসে না। ট্রাঙ্ক খোলার সাড়া ছড়ায়।
বন্ধও হয় ট্রাঙ্ক। পলিথিনের ক্যারিব্যাগ হাতে লোকটা বাইরে এসে গলায় মধু মেশায় – দুটো পান্তা দিবি?
কৃষ্ণা কোলের পুরুষপানে সন্দেহ ছেড়ে তাকায়।
-দিবি তো দে, দুটো খেয়ে যাই, কখন আসব তার ঠিক নেই।
পলিথিনের খোলে কিছু কাগজপত্তর। চোখ বুলিয়ে কৃষ্ণা প্রশ্ন তোলে – এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে আলসে বাদশার?
রসিকতার মাঝে ঘাই। প্রথম কেউ শুনলে গা জ্বলে যাবে ঠিকই, কিন্তু অচিন্ত্যের গায়ে সানায় না। শুনে শুনে গা-সওয়া। ও একটু অলস – নিজেও অস্বীকার করে না। বাড়ির প্রথম সন্তান অচিন্ত্য বড়ো আদোরের। অনেকদিন পরে নাকি মায়ের কোল ভরিয়েছিল। খোকন সোনা, চাঁদের কনা। বাবা কোনও দিন কাজ করতে দিত না। গায়ে ঝুলকালি লাগবে বলে হেঁসেলে খেতে দিত না। পায়ে ধুলোবালি লাগবে, কোথায় ছিঁড়েকেটে যাবে বলে গরু বাছুর চরাতে দিত না। আরও কত কিছুর বাড়াবাড়ি। ননীর পুতুল করে রেখেছিল ওকে বাড়ির সব্বাই। অথচ আর্থিক দিক দিয়ে আহামরি ছিল না ওদের সংসার। কলেজে পড়তে গেলে সেই বাপকে হারাল ও। পড়াশুনার চেটিপাটি গুছিয়ে বাড়ি। কাজকম্ম করতে গেলে খুব কষ্ট। পাড়ার ছেলেপুলে পড়ানোর নামে কাটিয়ে দিত সময়। এই সে-বছর নতুন ঘর বাঁধতে গিয়ে কোমরে বেদম লাগাল। একটু ভারিভুরি কাজ করলে বড্ডো চাগাড় দেয়। ওসব কাজে আর যায় না। হালকা পলকা কাজ হলে করে। বউ তাকে ছাড়ে না, সুযোগ পেলেই খোঁচায়। এখন বউয়ের কথায় হেসে বলল – ইশকুলের দিকে।
– কেন?
– আজ জমিজায়গার সেই লোকজন আসবে।
– তাহলে দুটো খেয়ে যাও।
ঘরের ছায়ায় তড়িঘড়ি বঁটি পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে কৃষ্ণা হেঁসেলে ঢোকে। জমিজায়গার বাবুরা কেন আসবেন, অচিন্ত্যের কী কাজ – কৃষ্ণা সব জানে, নতুন করে আর খোঁচায় না। দু-এক দিনের শলাপরামর্শে সব কৃষ্ণার মগজে গাঁথা।
পাছার তলায় ছোটো খেঁজুর পাতার চ্যাটাই টেনে অচিন্ত্য দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে। সামনে এক থালা পান্তা। ডান হাত জল ঢেলে কচলিয়ে সাফ। নুন আর পোড়া লঙ্কায় সব পান্তা তিন পাকে মোসকে জল ঢালে। সাত তাড়াতাড়ি নাকের নিচে ঢুকিয়ে উঠে পড়ে অচিন্ত্য।
টাট উলটে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতের ক্যারিব্যাগ পরোখ করে – পঞ্চাশ টাকার কোর্টপেপার, নোটিশটা, আর কিছু লাগবে না। রাস্তা ধরে পথ কমায়। ভোল পালটে রাস্তা ইট ভাঙা রাঙা। পিচ পড়বে। লোকের কানাঘুসোয় কত কথা! রাস্তার মালপত্র নাকি সব এদিক ওদিক। ক’টা মাতব্বর গোছের লোক লুটেপুটে খাচ্ছে। তা নিয়ে কারও কারও জবাব – যে করে হোক, রাস্তাটা গড়ুক। বর্ষার দরুণ কাজ বাদ ছিল মেলা দিন। বৃষ্টির আগে ইটের খ ছড়িয়ে ভারী রোলার গাড়ি দিয়ে মসৃন। সাইকেল, ইঞ্জিন ভ্যান, মোটর বাইক, মানুষের হাঁটা চলায় মসৃনতা চটে আবার খোঁসপাঁচড়া ওঠা। উদোখুদো রাস্তায় পা টেনে ফ্যালে অচিন্ত্য।
গত বছর বাবুরা এসে বড়ো ম্যাপ ধরে জমি কালি মেরে হিসেবনিকেশ। মাঝে দু-এক জন এসে নামে নামে কাগজপত্র জমা নিয়ে কাজ গুছিয়ে রেখেছে। অচিন্ত্যের কাগজপত্রে একটা বেকায়দা ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের গাফিলতিতে নথিপত্র আর সারাই করা হয়নি। দলিলটা উঁইপোকায় কুরে ভাঙাচোরা উপকূল ধরা মানচিত্র। সে সব মেরামত করতে যা হ্যাপা গেল! আগে জমিজমার দলিলপত্র সব হাসনাবাদে হত। চব্বিশ পরগনা উত্তর দক্ষিন ভাগ হওয়ার পর এখন বাসন্তী গেলে কাজ মেটে। গাঁটের কড়ি ফাঁক করে লোকের ধরা করায় কিছু পয়সাকড়ি খাইয়ে দু-তিনবার হেঁটেহুটে কাগজপত্র সোজা। তবুও ঝক্কি। বাবুদের খাতায় আর বাপের নামে কিছু হবে না, তিনি তো মরে সগ্গে! প্রধানের কাছ থেকে ওয়ারিশন সার্টিফিকেট হাতিয়ে আবার প্রমান করতে হল, লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল অচিন্ত্যের বাপ। এত কিছুর পরেও বাবুরা জিজ্ঞেস করেছিল – আর ভাইবোন নেই তো?
-না।
পাশের দু-পাঁচজন অচিন্ত্যের কথায় সম্মতি ছেড়েছিল।
জায়গাটা ছায়া ছায়া। কাপালি বাড়ির শিরিষ গাছ রাস্তার এপার ওপার। গোবিন্দরা আবার রাস্তার পাশে খোঁটা পুঁতে গরু বাঁধে। গোবর, চনায় জায়গাটা পিছল। মসৃণ খ-র পিঠে খোঁদল। হোমরাচোমরা লোকজনকে ডেকেডুকে বলাও যায় না, তবুও অনেকে খোঁচা মারতে ছেড়েনি। আসলে ওদের চক্ষুলজ্জাও নেই। এ পাড়ায় অচিন্ত্যরা একরকম নতুন, তবু ইয়ার্কির ছলে ঘাই কসেছিল একদিন।
এর আগে ওরা গাঙভেড়ির গায়ে ছিল। আয়লায় ঘরবাড়ি সব মুছে যাওয়ার পর এই মাঝের পাড়ায় ছটাকফটাক জমি কিনে নতুন ঘরসংসার। দিনকাল যা এগোচ্ছে গাঙের পাশে আর বসত করা যাবে না। আয়লার পরে সে শিক্ষা বহু লোকের হয়েছে। বাপ-ঠাকুদ্দারা বলতেন –
থাকো যদি গাঙের পাশে, থাকবে তুমি সুখে;
হাওয়া, খাওয়ার হবেনা অভাব, অন্যথায় দুখে।
কেউ বলতেন – নদীর কূলে বাস
     জীবনভর আশ।
তাই তো বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে পো-ঠাকুদ্দা, ঠাকুদ্দারা গাঙপারে ঘর তুলেছিল। রসে বসে কাটিয়েছিল জীবন। আর এখন মানুষজনের ভাবনা উলটো। আয়লার ঘাইয়ে সুর পালটে একশ আশি ডিগ্রি। লোকে বলে –
গাঙের কূলে বাস,
ভাবনা বারো মাস।
অচিন্তের অন্য শরিকশারাক গাঙভেড়ির গায়ে আছে। ও শুধু একা ছিঁড়ে এসেছে মাঝ পাড়ায়। মেজ, সেজ ঠাকুদ্দার ছেলেপুলেরা এখানকার জমিজমা বেচে ক্যানিংয়ের ওপারে। ভাগ্যিস, ওরটা ব্যাচেনি! বাস্তু বিলান ধরে ওই ছ’কাঠার টানে অচিন্ত্যকে এখন যেতে হচ্ছে।
আয়লার পর গাঙের নোনাজল রুখতে বাঁধ উঠে গেলেও ওটা সাময়িক। চরের বারবাড় থেকে দু’শ ফুট খোল দিয়ে আসোল নতুন রাস্তা যাবে। সব্বাইকে গাঙভেড়ির গায়ের জমি ছাড়তে হবে। অচিন্তের ছ’কাঠাও সেই আওতায়। সরকার একেবারে মাগনা নেবে না, ক্ষতিপূরণ দেবে। আজ নামে নামে চেক দেওয়ার কথা। এর আগে ব্যাঙ্কের বই, ভোটার কার্ডের জেরক্স জমা দিতে হয়েছিল। অচিন্তের ব্যাঙ্কের বইটা নিয়ে একটু ক্ষুৎক্ষুতানি আছে। ও আর এ নিয়ে। মন্ডল বানান এম ও এন ডি এ এল আছে। ও-টা এ হবে। বাবুরা অবশ্য বলেছেন – ওতে কিছু হবে না, যাতে চেক ভাঙাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেই ব্যবস্থাই করে দেওয়া হবে।
প্রায়মারি ইশকুলের মাঠে মেলা লোকজন নেই, ঘর বারান্দা জুড়ে কিচিরমিচির। যদিও কাজের দিন, ইশকুলের ছেলেপুলে একটাও নেই। এই ঝামেলায় ইশকুল মনে হয় ছুটি। ক’জন সিভিক ভলান্টিয়ারও ব্যস্ত। লাইন লেগেছে। ওপাশে গন্ডোগোল ঝামেলা। কারা জমি নিয়ে মুখ বলাবলি শুরু করেছে।
-দেখে নেব।
– হ্যাঁ, নিসনা! রায়তি সম্পত্তি আমার, শুধু চাষ করতে দিয়েছিলাম। না হয় চার বছর ধরে চাষ করছিস, তাই বলে টাকার ভাগ!
– ভাগ তো দিতেই হবে।
– মাগনা নাকি!
– মাগনা, কি হকের, সময় এলেই টের পাবি।
কিছু লোক জমে সেখানে জমজমাট আসোর।
অচিন্ত্য জানলায় চোখ গলায়। নোটিশপত্র দেখে বড়ো রেজিস্টারে স্ট্যাম্প লাগিয়ে সই করিয়ে নিচ্ছেন, কোর্ট স্ট্যাম্প গচ্ছিত রাখছেন একজন; অন্যজন রেজিস্টারের সিরিয়াল নাম্বার ধরে চেক তুলে দিচ্ছেন মালিকের হাতে। চেয়ার টেবিলে তারা আয়েশ করে বসে অফিস ঘর। মুখে দুজনার সিগারেটে ফুকফুক টান। দু’জন পঞ্চায়েত মেম্বার দুই বেঞ্চে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে বহল তবিয়তে – এই বুথ আর পাশের বুথের। সিগারেটে টানের ফাঁকে ফুসুর ফুসুর কানাকানি। দুই বুথেরই ডাক আজ – তিরিশ, একত্রিশ পার্ট। আশেপাশে পঞ্চায়েতের চ্যালাচামুন্ডারা ঘুরঘুর মারছে। নানান রসালাপে মত্ত।
একজন অচিন্ত্যকে চিনিয়ে দিল – ওই হচ্ছেন মধু উকিল।
-কোন জন?
– লাল সাদা কালো স্ট্রাইপ জামা, ফ্রেন্সকার্ট দাড়ি, বুকে ঝোলানো গগলস।
অচিন্ত্য ভালো করে দেখে নেয়। উকিলটার নাকি হেব্বি নামডাক। জমিজিরেতের ব্যাপারে হ্যাবক বোঝে। চোখমুখ দেখেও মনে হচ্ছে বেশ ঝানু মাল। লোকটা এদিক সেদিক ব্যস্ত ঘুরে ভিতরে একটু বসলেন। বাবুদের সঙ্গে দু-চার কথা সেরে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেলেন। চোখে মুখে ধার। খরখরিয়ে কথা ছাড়েন, ফালুকফুলুক এদিক সেদিক।
অচিন্ত্য লাইনে এক পায়ে ভর মেরে দাঁড়িয়ে। সামনে এখনও মেলা লোক। কতক্ষন দাঁড়াতে হবে ঠিক আছে! যদিও দেরি হচ্ছে না বেশি। নাম, দাগ, খতিয়ান খুঁজে পেলেই সই আর চেক। তিন-চার লাখও জুটছে কারও কারও হাতে। ছপ্পর ফাটিয়ে দিয়েছে সরকার। চেকটা আবার যে কোথায় ভাঙাতে হবে! স্থানীয় সি এস পি – ছোটো ব্যাঙ্ক আছে। সেখানে যদি হয় ভালো, না হলে এক দিনের কাজ ফই মেরে সে-ই গোসাবায়। যে করে হোক, চেকটা তো ভাঙাতে হবে! একটা চেকে তিন মাস নাকি ভাঙানোর সময়। তার উপরে আবার ক’দিনের বাসি তার ঠিক নেই।
বড্ডো সুসময়ে দিচ্ছে। গোয়ালটা বেঁধে একটা গরু এবার কিনতেই হবে। একটু ঘুটে জ্বালানী, একটু দুধ। বাড়ি একটা গরু থাকলে কত কাজেকম্মে লাগে। তার উপর যদি একটা গাই গরু হয়! আবার একটা ডিস, টিভি কিনতে হবে। বউটা বশে থাকবে। পাড়ায় বউ-ঝি নিয়ে যে কান্ডকারখানা শুনছে, ওর কৃষ্ণা অবশ্য সে পদে পড়ে না। তবু, সিরিয়াল দেখার জন্যে পরের বাড়ি আর যেতে হবে না। আর পাশাপাশি যদি দু-দশ কাঠা জমি কেনা যায়!
-অচিন্ত্যদা!
ঘাড় ঘোড়ায় অচিন্ত্য। বাবলু। ওদের পঞ্চাৎ-মেম্বারের সাঙ্গপাঙ্গ। ভালো করে বাবলুর মুখটা দেখে ভ্রু নাচায় অচিন্ত্য।
-তোমার তো হবে না।
– কেন!
– তোমার দাগ নিয়ে কমপ্লেন আছে।
– ক-ম-প্লে-ন!
বাবলুর পাশে ওদেরই এক জাতভাই এসে দোহারকি জোড়ে – ওই দাগটা নিয়ে বিরাট ঝামেলা অচিন্ত্যদা।
-ঝামেলাটা কিসের! রায়তি সম্পত্তি, কম্পিউটার রেকর্ড, দলিল সব আছে।
– অতশত তো বুঝিনে, দাদা। বাবুদের কাছে থেকে যেটুকু শুনেছি, দেখেছি, বললাম।
লাইনে অচিন্ত্যের পেছনের জন উসফাসায় – ছাত্তার ভাই, নিখিল কামারের চেকও আটকে গেল। সব নাকি কমপ্লেইন আছে।
অচিন্ত্য অস্থির হয়। ঘরের খোলে ওদের পঞ্চাৎ-মেম্বারের মুখে খ্যালে বাঁকা হাসি। ক্যারিব্যাগ থেকে অচিন্ত্য নথিপত্র টেনে বের করে। ইশকুলের নাম, তারিখ, বার, জমির দাগ নাম্বার, খতিয়ান, পরিমান, টাকার হিসাব – মোচড়টা কোথায়!
আবার ঘরের খোলে তাকাতেই মেম্বারের চোখাচোখি। সবেগে অচিন্ত্য লাইন ছেড়ে মেম্বারের নিকট। মাথা ঠান্ডা রেখে ফিসফিসোয় – আমারটা নাকি হবে না!
হুঁ, কমপ্লেইন আছে – মেম্বার হেসে একটু জোরে জবাব টানল।
-কারা করল?
– আমরা জানি না, বাবুরা বললেন –
রেজিস্টারধারী বাবুর কান বেশ খাঁড়া। বললেন – নাম বলুন!
অচিন্ত্য আউড়ে গেল।
দাগ নাম্বার, খতিয়ান, বলুন – পাতা ওলটাতে ওলটাতে ভদ্দোরলোক বললেন।
মুখস্ত ঝেড়ে দিল অচিন্ত্য।
-হ্যাঁ, এই তো, একটু গোলমাল আছে।
– কারা করল, স্যার!
ভদ্দোর লোকটা চশমার উপর দিয়ে মেম্বারের দিকে এক পলক দৃষ্টি ছোটায়। তারপর দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে। মুখে বলেন – অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন, চেকগুলো দিয়ে নিই। পরে সময় হলে বলা যাবে।
অচিন্ত্য মাথা নিচু করে বাইরে আসে। কিন্তু কূল পায় না, কারা একাজ করল! ওর রায়তি সম্পত্তি। আর তো কোনও অংশিদার নেই! বোনও নেই, ও একা। তাহলে হাত বাড়াল কে, কারা!
লাইনে আর দাঁড়ায় না অচিন্ত্য। ইশকুল ঘরের বাইরে আসে। দু-পাঁচজন চেনাজানা জিজ্ঞাসে – হয়ে গেছে? কত হল?
না, একটু পরে হবে – অচিন্ত্য আর বেশি খুলেমেলে বলে না।
-তোমার লাইন তো আগে ছিল!
– একটু ঝামেলা আছে।
অনেকের চোখে সন্দেহ, জিজ্ঞাসা।
মাঠের ইউক্যালিপ্টাস, সোনাঝঝুরি, শিরিষের ছায়ায় থোকা থোকা লোকজন। অচিন্ত্য অনুসন্ধানী দৃষ্টি চালিয়ে শিরিষের ছায়ায় ভিড়ল। একটা বুড়োর ধারে গাছের শিকড়ের উপর বসল। ওর ছোটো কাকা। পাছায় গামছা রেখে সেও শিকড়ের উপর।
উত্তুরে হাওয়া ধরেছে বাতাস। আর ক’দিন পরেই শীতকাল। দিনের বেলা ছোটো হয়ে রাত বাড়ন্ত। গা হাত পায়ে শুক্ন টান। শেষ রাতে গায়ে কাঁথাকাপড় টেনে আরাম।
কাকাকে সব খুলে বলল অচিন্ত্য। বয়স্ক মানুষ। চুলে অভিজ্ঞতার পাক, মুখে অস্পষ্ট বলিরেখা। স্মৃতি হাতড়ে আউড়ে যান লোকটি – …ভোন্তা গাজির কাছে বিনিময়। বাংলাদেশ থেকে আসলাম। নায়েবের আমলে কাগজপত্তর। সেই জমি ভাইদের চার ভাগ। রায়তি সম্পত্তি। তারপর তোমার বাবার নামে। সেখান থেকে তোমার। নাঃ, তেমন কোনও ঝুটঝামেলা তো খুঁজে পাচ্ছি না! বাবুরা অপেক্ষা করতে বলেছেন যখন, দ্যাখো।
অচিন্ত্য গাছতলায় গাছতলায় খানিক সময় কাটাল। নাঃ, তেমন কোনও সুত্র মিলল না। এখনও মেলা সময়। চারটে, সাড়ে-চারটে পর্যন্ত তো থাকবেন বাবুরা!
বাড়ি ফিরল অচিন্ত্য। চ্যানদান সেরে, দুটো খেয়েদেয়ে, একটু গড়িয়ে দলিল আর রেকর্ডটা নিয়ে ধীরেসুস্থ্যে আসা যাবে।
বাড়িতে ঢুকতেই বউয়ের মুখ হাসিতে ঝিকমিক। গদগদ ভাব খেলিয়ে বলল – এবার একটা আংটি কিন্তু দিতেই হবে!
অচিন্ত্য উত্তর টানল না। কাগজপত্র দাওয়ায় ছুঁড়ে পুকুরমুখো।
-কী হল, কিছু বললে না যে!
– হলে তো বলব!
– হয়নি!
অচিন্ত্য ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ায়।
-কেন?
– কমপ্লেন।
খাওয়াদাওয়ার পর পেটের জ্বালা মরল বটে, মনের খচখচানি নিভল না। আরাম ধরবে বলে একটু শুয়েছিল, দেরি হচ্ছে ভেবে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। দলিল, পড়চাটা সঙ্গে নিয়ে আবার বেরল। ছায়াটা পুবে হেলে সামান্য লম্বা। শীতল বাতাসে ফুরফুরে গতি।
ইশকুল বাড়ি প্রায় শুনশান। দু-একজন ক্লান্ত মুখে অপেক্ষায়। বাবুরা খেতে গেছেন। কেউ কেউ বলছে – বাবুরা এখানে আর আসবে না, ওখান থেকেই কেটে পড়বে।
খুব বেশি সময় ছাড়ল না অচিন্ত্য। বলা যায় না, কথাখান যদি খেটে যায়!
কোথায় বাবুদের দুপুরের মিল, অচিন্ত্য জানে।
গিয়ে দেখল, কারও কারও ডান হাতের কাজ শেষ। মধু উকিল বাইরে গাছতলায় সিগারেটে সুখটান মারছেন। অচিন্ত্য দু’মনায় পাশে গেল – ভালো আছেন তো?
ধোঁয়া ছেড়ে মুখে হাসি খেলিয়ে উকিল বললেন – বলুন!
-স্যার, আমার ওই ১৩৬২ দাগটা আটকে গেল কেন?
– কমপ্লেইন আছে হয়তো!
সে তো শুনেছি। কিন্তু – রায়তি সম্পত্তি। এই দেখুন – অচিন্ত্য ক্যারিব্যাগটা খুলতে যায়।
-আরে না না, ওসব রাখুন। আজ আর হবে না, ফিরতে হবে। নদীনালায় যেতে হবে। অনেক দূরের পথ। না ফিরতে পারলে – কাল আবার আমাদের অফিস।
বাবুদের কথা অমান্য করতে নেই। ফল ভালো হয় না। অচিন্ত্য আর জোরাজুরিতে গেল না।
মোড়ল মাতব্বর প্রায় সবাই আছেন। সবার জন্যে দুপুরের ব্যবস্থা। ভালোমন্দে ভুরিভোজ। সশব্দে ঢেকুর তুলছেন কেউ কেউ। সকলের চোখেমুখে তৃপ্তির জেল্লা।
সত্যিই বাবুভদ্দোরলোকেরা আর দাঁড়ালেন না। ব্যাগবাড়ি গুছিয়ে রাস্তা ধরলেন। মেম্বারসহ হোমরাচোমরা অনেকেই বাবুদের পাছে পাছে। নানান কথাবাত্রায় ভালোমন্দ। সাহেবসুবোরা উঠলেন লঞ্চে। গাঙভেড়িতে মেলা লোকজন। হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে লঞ্চে স্টার্ট। অনেকের সমস্যা মিটল না। যেমন – অচিন্ত্য। এত আশা নিয়েও গোমড়া মুখে বাড়ি।
যারা চেক পায়নি, অনেকের সঙ্গেই কথা হল অচিন্ত্যের দু-এক দিনের খোলে। অনেকে দু’একটা সমস্যা তুলে চিন্তিত। কে একজন বলল – তোমার সঙ্গে এসব ব্যাপার নিয়ে মেম্বারের কথা হয়নি?
অচিন্ত্য স্মৃতি হাতড়ে খোলসা হয় – সুভাষ একদিন গিয়েছিল।
-কোন সুভষ?
– হাত কাটা সুভাষ।
– তারপর?
– গিয়ে বলল – জমির ক্ষতিপূরণের চেক আসছে শুনেছো! আমি মাথা ঠুঁকলাম। ও বলল – তোমার নাম তো আছে, নোটিশ পেয়েছো তো! আমি আবার সাঁয় দিলাম। ও বলল – এখন একটু পুজোটুজো না দিলে হবে না। ভাষাটা বুঝতে পারিনি আমি, বললাম – ঝেড়ে কাশো। ও আমতা আমতা করে খানিক সময় নিয়ে বলল – পার্টি ফান্ডে টোয়েন্টি পারসেন্ট দিতে হবে। আমি শুনলাম – বাঁধে কি পার্টির জমি যাচ্ছে? ও চুপ করে থাকল। আমি বললাম – যাচ্ছে আমার, বুকের পাঁজর ভাঙছে আমার, তোমাদের ফান্ডে টাকা কেন!
– ও কী বলল?
– বলল – সেটা আপনার ব্যাপার। তারপর কথাবাত্রা অন্য লাইনে ঘুরিয়ে দিল সুভাষ।
যিনি এতক্ষন ধরে মন দিয়ে অচিন্ত্যের কথা শুছিলেন, উচ্চৈস্বরে হা হা করে হেসে উঠলেন। হাসির দমোক থামিয়ে বললেন – তোমার জমিতে তো বহুত কমপ্লেইন! পরেও বাবুরা যদি চেক বিলোতে আসে, তুমি কিন্তু পাবে না।
আচিন্ত্য লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে হা।
***

গল্পকার: পবিত্র মণ্ডল


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!