মেঘের দিনে ‘মেঘদূত’
শাপভ্রষ্ট যক্ষ। নির্বাসিত রামগিরি পর্বতে। প্রেয়সীকে ছেড়ে থাকতে হবে এক বছর।বর্ষা সমাগত। আকাশে মেঘপুঞ্জ। বহু দূর, অলকায়
প্রেয়সী। মিলনেচ্ছায় উন্মুখ যক্ষ। কিন্তু উপায় নেই। অতএব “মন মোর মেঘের সঙ্গী “। মেঘকে দূত রূপে আমন্ত্রণ। যক্ষের বার্তা নিয়ে মেঘের ভেসে যাওয়া। রামগিরি থেকে অলকা,যেখানে প্রিয় বিরহে অধীর অপেক্ষায় দিন গুনছে যক্ষের প্রেয়সী। মোটামুটিভাবে এই আখ্যানের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে মহাকবি কালি দাসের মেঘদূত।
মহাকবি কালিদাস কেন বিরহী যক্ষের দূতরূপে মেঘকেই বেছে নিলেন? সচেতন পাঠকের মনে এ প্রশ্ন আসতেই পারে। পাখি, বাতাস, নদী বা আরও অন্য কোনও মাধ্যম তো দূত হতে পারতো । এদেরও তো মেঘের মতো চলৎশক্তি আছে।শুধু বর্ষার আবহে যক্ষের বিরহ গাথাকে রসসিক্ত করবেন বলেই কী তার এই চয়ন!
আসলে মেঘ যেমন বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিতে পারে, ছায়া দিয়ে প্রাণও জুড়িয়ে দেয়। মরুসম বিরহী হৃদয়ে মেঘ ঝরা বৃষ্টির সাথে সাথে শীতল ছায়াটুকুও যে লাগে। নইলে তৃষিত হৃদয় জুড়ায় কী করে!
সাদামাটা ভাবে দেখলে বিরহী যক্ষের বিরহ গাথাই মেঘদূত কাব্যের মূল উপজীব্য। তবে একটু মনযোগ দিয়ে পাঠ করলে এর পাশাপাশি আরও কিছু রত্নরাজি চোখে পড়ে। যক্ষ তার প্রেয়সীর সঙ্গলাভে উন্মুখ। তার মধ্যে ব্যাকুলতা আছে। মেঘ যাতে তার প্রেয়সীর অভিমুখে ভেসে যেতে পারে তার পথনির্দেশও আছে। তবে সেই পথে নদী, পশুপাখি,গাছগাছালি, মানুষজন ও জনপদ যা কিছু আছে তার ওপর মেঘের সুশীতল ছায়া ও বৃষ্টি ধারা বর্ষিত হোক- এটাও যক্ষের চাওয়া। আবার পথশ্রমে মেঘ যাতে না ক্লান্ত হয়,মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেয়-একথাও মেঘকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যক্ষের প্রেম তার প্রেয়সীর প্রতি, সেই সাথে মেঘ ও বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিও। প্রেমের ব্যাকুলতা প্রেয়সীকে নিয়ে, প্রেমভাব জগত সংসারের প্রতি।
ক্ষুদ্র প্রেমের গন্ডী ছাড়িয়ে বৃহত্তর প্রেমের এই সার্থক উত্তোরণ কাব্যটিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।
শুধুমাত্র নিজের চাওয়ার মধ্যে যক্ষের চাওয়া থেমে থাকে না। মেঘের সাথে তার প্রেয়সী বিদ্যুতের মিলন হোক এটাও যক্ষের কামনা।ব্যক্তিগত কামনার সাথে সার্বিক প্রার্থনা। এখানেই যক্ষের বিরহ ও প্রেম বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। রসোত্তীর্ণ হয় মহাকবির ‘মেঘদূত ‘।