মেঘদূত কথা
পাপিয়া অধিকারী জগতের কাব্যপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে প্রেমকাব্য এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে । আর সেই প্রেমকাব্যের মহিমাকে অনন্যতা দান করে বিরহের অমর কাব্যকথা । মহাকবি কালিদাসের “মেঘদূত” সেই বিরহকাব্য কথার শিরোমণি । যুগে যুগে কালে কালে বিরহী হৃদয়ের অশ্রু সজল গহন মনের গোপন বেদনাঘন কথাটিকে চিরকালীন রূপ দান করেছে এই কাব্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “মেঘদূত” কবিতায় মহাকবির “মেঘদূত” এর প্রাণস্পন্দিত রূপটিকে ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে —
“… মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে। “
বৈশিষ্টের বিচারে কাব্যটিকে প্রাচীন টীকাকারগণ একাধারে কেলি কাব্য, ক্রীড়া কাব্য, দূতকাব্য, খণ্ড কাব্য বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং বর্ষা কাব্য, গীতিকাব্য, বিরহ কাব্য বলে পরিচয় দিয়েছেন আধুনিক কাব্য বিশারদগণ । জগতে আর কোনো কাব্য এতো বৈচিত্র্যময়ভাবে বৈশিষ্ট্যান্বিত হয়েছে কিনা সংশয় জাগে। এই কাব্যের প্রায় পাঁচশত পংক্তি (১১৫ – ১২১ টি শ্লোক) “মন্দাক্রান্তা” ছন্দের চলনে লীলায়িত রূপ লাভ করেছে।
“বিরহ” এই একটিমাত্র অনুভূতিকে অবলম্বন করে একটি কাব্য রচনার চিন্তা তৎকালে (আনুমানিক ৪ র্থ — ৫ম শতক) শুধু নয়, আধুনিক কালেও যথেষ্ট বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এখানেই মহাকবি কালিদাসের কবিত্বকলার মৌলিকত্ব ও জনপ্রিয়তার কিঞ্চিৎ আভাস আমরা পেতে পারি। “মেঘদূত” সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় বিরহ কাব্য। এই কাব্যের লোকপ্রিয়তা শুধু এদেশ নয় সমগ্র বিশ্বের মাটি ছুঁয়েছিলো।
সংস্কৃত সাহিত্যে “মেঘদূত” কালিদাস পরবর্তী নতুন কবিদের পথ দেখালো দূতকাব্য রচনায়। গড়ে উঠলো কাব্যের এক নতুন ধারা । সংস্কৃত সাহিত্যে ৫০ টি দূতকাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়। পাওয়া যায় অসংখ্য প্রক্ষিপ্ত শ্লোক ( অর্থাৎ যে শ্লোকগুলি কবিকৃত নয় অথচ পরবর্তীকালে মূল কাব্যে সংযোজিত)। প্রথামতো, সংস্কৃত টীকাকাররা টীকা রচনা করলেন এই কাব্যের। এ বিষয়ে মল্লিনাথ সুরি (১৪ শতক) -র নাম জগত প্রসিদ্ধ। তাঁর সারাজীবনের সাধনার ফল “মেঘদূত” কাব্যের টীকা। এই রকম ৫০ টি টীকা রচিত হয়েছে এই একটিমাত্র কাব্যকে ঘিরে। জার্মান কবি ফ্রেডরিখ শিলার (১৭৫৯ – ১৮০৫) প্রমুখ “মেঘদূত ” অনুসরণে তাঁদের কাব্য রচনা করেন। আধুনিককালে অর্থাৎ অষ্টাদশ – ঊনবিংশ শতকে এই কাব্যের শতাধিক অনুবাদ রচিত হয়েছে। এখনও রোম্যান্টিক কবি- সাহিত্যিকদের চিরবিস্ময় ও চির উদ্দীপনার অমরাবতী স্বরূপ এই কাব্য ।
“মেঘদূত” কাব্যের দুটি খণ্ড –“পূর্বমেঘ” ও “উত্তরমেঘ”। অনেকের মতে এই বিভাগ কবি নিজে করেন নি। “পূর্বমেঘ” ( বিরহী যক্ষের নির্দেশানুসারে মেঘের অলকাপুরী যাত্রার সম্ভাব্য পথ এবং নিসর্গ বর্ণনা) মূল কাব্যের ভূমিকা স্বরূপ এবং “উত্তরমেঘ” ( চন্দ্রালোকিত অট্টালিকা শোভিত যক্ষরাজাদের বিলাসক্ষেত্র অলকাপুরী এবং যক্ষ-প্রিয়ার বর্ণনা) হলো মূল কাব্য । আবার অনেকে মনে করেন, “পূর্বমেঘ” অংশটিই সমগ্র কাব্যের প্রাণস্বরূপ — এর সাবলীলতা ও সরস মাধুর্যতা অনেক বেশি । তুলনায় “উত্তরমেঘ” অনেকাংশেই আড়ষ্ট ও কৃত্রিম বলে মনে হয় ।
প্রথমে “পূর্বমেঘ”। অলকাপুরীতে কুবেরের কাননে কাজ করার সময় কর্তব্যে অবহেলার কারণে নব বিবাহিত যক্ষ এক বছরের জন্য নির্বাসিত হলেন রামগিরি পর্বতে। আষাঢ়েের প্রথম দিবসে আট মাসের প্রিয়া বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হলো।
” আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ ”
(আষাঢ় মাসের প্রথম দিবসে পর্বতগাত্রে ক্রীড়া রত প্রমত্ত হস্তীর ন্যায় রমনীয় মেঘখণ্ডকে অবলোকন করছিলেন)
বিরহবেদনায় যক্ষ শীর্ণকায় – হাতের বলয় খুলে যায়। এমতাবস্থায় আষাঢ়ের নব মেঘমালা দর্শনে মেঘকে সম্ভাষণ করে যক্ষ অনুরোধ করলেন অলকাপুরীতে অবস্থানরত প্রিয়াকে তাঁর কুশলবার্তা পৌঁছে দিতে। অর্থাৎ মেঘকে দূত নিযুক্ত করলেন। তিনি যাত্রা পথ বলে দিলেন সেই মেঘদূতকে।
বেতসকুঞ্জ, আম্রকূট পর্বত, বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশে শীর্ণ রেবা নদী, দশার্ণ দেশ, দশার্ণ দেশের রাজধানী বিদিশা, বননদী, উজ্জয়িনী, নির্বিন্ধা নদী এবং সব শেষে কৈলাসের কোলে অলকাপুরী। অলকায় কুবেরের গৃহের উত্তরে এক মন্দার তরুর সামনেই যক্ষের গৃহ। কিন্তু এ বর্ণনা তো আর কোনো ভূগোল বিশেষজ্ঞের কলমে রচিত হয় নি। রচিত হয়েছে বিশ্ব বরেণ্য এক মহাকবির সৌন্দর্য বিদগ্ধ অমর মানসলোকে। সে বর্ণনার বিচ্ছুরিত জ্যোতি যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি প্রেমিক হৃদয়ে নব রসের সঞ্চার ঘটিয়েছে।
কথায় বলে, “উপমা কালিদাসস্য”। মেঘের যাত্রাপথের নিসর্গের বর্ণনায় কবি যে সব উপমা চিত্র এনেছেন, যে রঙে রাঙিয়েছেন তাকে, তাতে বিরহী যক্ষের অন্তঃপুরটি পাঠকের সামনে সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়েছে। সেখানে আছে কামনার রঙে রঞ্জিত এক সজল দৃষ্টি, যা মানস ভ্রমণে অলকাপুরীতে তার প্রিয়ার নিকট উপনীত হতে চায়। পাঠকেরাও সে মানসভ্রমণে পরিতৃপ্তি লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর “মেঘদূত” প্রবন্ধে বলছেন — “আবার সেই প্রাচীন ভারতখণ্ডটুকুর নদী গিরি নগরীর নামগুলিই বা কী সুন্দর !… নামগুলির মধ্যে একটি শোভা সম্ভ্রম শুভ্রতা আছে । সময় যেন তখনকার পর হইতে ক্রমে ক্রমে ইতর হইয়া আসিয়াছে, … অবন্তী – বিদিশার মধ্যে প্রবেশ করিবার কোনো পথ থাকিত তবে এখনকার চারি দিকের ইতর কলকাকলি হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যাইত । “
এবার “উত্তরমেঘ”। “উত্তরমেঘ”-এ আছে অলকাপুরীর বর্ণনা । সে বর্ণনা যেন সৌন্দর্যের উষ্ণ প্রস্রবণ। অলকার প্রাসাদগুলির সঙ্গে কবি মেঘের তুলনা করেছেন। অলকার রমনীগণ সৌদামিনীসম। সঙ্গীতকালীন মৃদঙ্গের ধ্বনি যেন মেঘনাদ। সুউচ্চ আকাশচুম্বী প্রাসাদকক্ষে সর্বদা মেঘের আনাগোনা। প্রাসাদের মণিদীপ্ত উজ্জ্বল ভূমিভাগ যেন জলমগ্ন মেঘরাজি। আছে বিলসিত রতিমন্দির।
অলকার বৃক্ষরাজি সদা সর্বদা লীলাকমল, কুন্দপুষ্প, লোধ্রপুষ্প, করবী, কুরুবক, শিরীষ, কদম্ব পুষ্পশোভিত। আনন্দেই একমাত্র নয়নাশ্রু গোচর হয়। যৌবন ছাড়া সেখানে কোনো বয়স নেই ।
কুবের ভবনের বাইরে আছে অপ্সরা ও কিন্নর শোভিত “বৈভ্রাজ” উপবন। অভিসারিকাগণের রাত্রির অন্ধকারে অভিসার যাত্রার দৃশ্য অপূর্ব সুষমা মণ্ডিত। রমনীদের সাজ সজ্জার উপকরণ প্রদান করে কল্পবৃক্ষ।
অলকায় কুবেরের গৃহের উত্তরে ইন্দ্রধনু তোরণে শোভিত যক্ষের গৃহ। গৃহে আছে মরকত শিলার সোপান বাঁধানো এক দীঘি। বৈদূর্য মণিময় মৃণালে স্বর্ণকমল প্রস্ফুটিত এবং হংসদলের বাস সেখানে। দীঘির তীরে এক ক্রীড়াপর্বত । সে পর্বতে আছে এক ময়ূরের কেকাধ্বনি মুখরিত কুঞ্জ। মূলগৃহদ্বারে শঙ্খ ও পদ্মের চিহ্ন দেখে যক্ষের গৃহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সেখানেই আছে যক্ষপ্রিয়া – তন্বী শ্যামা শিখর দশনা। কঠিন বিরহে তার রূপ হয়েছে তুষার পীড়িত কমল বা মেঘাবৃত চন্দ্রমার ন্যায় । কী করছেন তিনি ? কল্পনার দৃষ্টিতে যক্ষ দেখছেন, প্রিয়া যক্ষের কথা স্মরণ করে গান গাইছেন। আবার অন্যমনস্কতায় ভুলেও যাচ্ছেন সে গীত। বিরহের প্রথম দিন থেকেই তিনি একটি করে পুষ্প দ্বারের পাশে এক বেদীতে রাখেন এবং গণনা করে দেখেন বিরহের আর কতদিন বাকি । এটিই তার চিত্তবিনোদনের একমাত্র উপায়।
এইরূপ বর্ণনার পরে যক্ষ, মেঘকে বন্ধু সম্ভাষণ করে নিবেদন করেন যে তার কুশলবার্তা টুকু যেন তার প্রিয়াকে প্রদান করে যক্ষপ্রিয়ার কুশল বার্তা তাঁকে পৌঁছে দিয়ে যায় মেঘ। সুহৃদ মেঘের প্রতিও আছে যক্ষের শুভেচ্ছা বার্তা। মেঘ যেন বর্ষার দিনগুলিতে আরও শক্তিলাভ করে। বিদ্যুৎ প্রিয়ার সঙ্গে তার যেন ক্ষণিকের তরেও বিচ্ছেদ না হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মহাকবি কালিদাসের “মেঘদূত” এ সৌন্দর্যের অমরলোক রচনা করলেও সেই অমরলোকের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেল বিরহ বিধুর একবিন্দু নয়ন সলিল । রবীন্দ্রনাথের “মেঘদূত” প্রবন্ধের এই কথা কয়টি দিয়ে শেষ হোক মেঘদূত কথা —
” হে নির্জন গিরিশিখরের বিরহী, স্বপ্নে যাহাকে আলিঙ্গন করিতেছ, মেঘের মুখে যাহাকে সংবাদ পাঠাইতেছ, কে তোমাকে আশ্বাস দিল যে, এক অপূর্ব সৌন্দর্যলোকে শরৎপূর্ণিমারাত্রে তাহার সহিত চিরমিলন হইবে ? তোমার তো চেতন অচেতনে পার্থক্যজ্ঞান নাই, কী জানি যদি সত্য ও কল্পনার মধ্যেও প্রভেদ হারাইয়া থাক। “
তথ্য সূত্র :
১) রাজশেখর বসু অনুদিত “মেঘদূত”
২) “কালিদাসের মেঘদূত”, বুদ্ধদেব বসু
৩) “মেঘদূত” প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪) “মেঘদূত” কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর