যদি বৃষ্টি নামে
৪.
– এখানে কে দায়িত্ব এ আছে?
-কেন?
– কেন আবার! আমরা যা বলছি সেটার উত্তর দে।
লালু এ কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে যায়। হরিণক্ষেতে এসে ও বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ছিল। কাজের সাইটে দেখভাল করছিল। নিবিড়দার সঙ্গে ও বেশ মজা করে ছিল। হঠাৎ করে এমন আপদ এলো কোথা থেকে? লালু ভেবে পায়না। এমন সময় নিবিড়দাও নেই। সাহেব বাঁধের দিকে গেছে। লেবারদের ছুটি করে নিবিড়দা রোজ ঘুরতে যায়। আজও গেছে। লালু কি বলবে ওদের ও ভেবে পাচ্ছে না।
– কিরে জবাব দিচ্ছিস না। শালাকে দেব চড় কষিয়ে।
– দাদা, যে দায়িত্ব এ আছে সে একটু ওদিকে গেছে।
– এলে বলবি আমাদের চাঁদাটা দেবে। এখানে কাজ করলে চাঁদা লাগবে। বুঝলি?
লালু দুদিকে ঘাড় নাড়ে।
– বলবি, কান কাটা গুলি এসেছিল। আমাকে দেখা করতে বলবি। এই চল সব।
ওরা গাড়িতে উঠে চলে যায়। লালু ওদের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেছে। সব মস্তান দেখে মনে হয়। ওরা ভালো লোক না। লালু বুঝে গেছে। এমন সময় নিবিড়দাও নেই। ভয় তো ওর করবেই। ওর হাঁটু এখনো কাঁপছে। আর কিছুক্ষণ কান কাটা থাকলে ওর খবর ছিল। লালু ফোনও করতে ভয় করছে। যদি আবার ওরা ফিরে আসে! না ও আর ফোন করবে না। যা করার নিবিড়দা করবে। তাবে বিষয়টা অফিসে জানানো দরকার। লালু একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে কান কাটা চলে গেছে কিনা। না ওরা চলে গেছে। ও ভেবেছিল হরিণক্ষেতে এসে ও বেশ সুখে আছে। এখানে অফিসের হুকুম নেই। বেশ ছিল ও। কিন্তু কোথা থেকে কান কাটা গুলি এসে সব ভেঙে দিয়ে গেল। নিবিড়দা যে কোথায় চলে যায়! না এখানে ও একা থাকবে না। কিন্তু না থেকে উপায় কি? সব পড়ে আছে। একটা কিছু হারালে তার কৈফিয়ত কে দেবে? ভারি জ্বালা!
লালু মনটা শক্ত করে। তারপর ও ফোনটা পকেট থেকে বের করে। বের করতেই অমনি কলির ফোন। লালু মনে মনে বলে, শালি আর ফোন করার সময় পেলনি।
– বল, কি বলছিস? বেশ বিরক্ত হয়ে বলে লালু।
– তুমি কি সব সময় রেগে থাকো?
– যখন তখন ফোন করবি না। বলে দিলাম।
– তোমার বড্ড গায়ে জ্বালা। বউ কি ফোন করতে পারবে না?
– কাজের কথায় আয়।
– আমার টাকা লাগবে।
-এই তো সেদিন দিলাম। আবার!
– মা আসবে। খরচপাতি আছে।
লালু ফোনটা কট করে কেটে দিল। কলির কথা শোনার ওর সময় নেই। ও নিবিড়দাকে ফোনে সব বলে। নিবিড় ছুটে আসে। ও বেশ অবাক হয়। এমন তো এর আগে ঘটেনি। বেশ অনেক দিন ধরেই ওরা আছে। এই কান কাটা গুলি আবার কে? ও মনে মনে ভাবে।
নিবিড় কাজের সাইটে চলে আসে। লালু ছুটে আসে।
– নিবিড়দা, ওরা ভালো লোক না। হুমকি দিয়ে গেছে।
– তুই ভাবিস না। আমি আছি। দেখি কি করা যায়।
– ওরা দেখা করতে বলেছে।
– ওরা কোথায় থাকে কিছু বলেছে?
– রোডের কাছে একটা ধাবা আছে। সেখানে ওদের পাবা।
– ও। ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। কিছু হবে না।
এ কথা শুনে লালু একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
নিবিড়দা, রাতে কি খাবে?
– যা ইচ্ছে নিয়ে আসিস। আমি একটু তোর ম্যাডামকে ফোন করি।
– নিবিড় তাজনূরকে ফোনে সব জানায়। তাজনূর ভীষণ চিন্তাতে পড়ে যায়। নিবিড় ফোনের এ পাশ থেকেই বুঝতে পারে। নিবিড় সব সামলে নেবে বলে। তারপর ও ফোন কেটে দেয়।
সূর্য ডুবে গেছে কখন। লালু রাতের খাবার আনতে গেছে। আজ বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। ওর সেই ছোট বেলার কবাডি খেলার কথা মনে পড়ে। ওদের পাড়ার জেলু চাচার ছেলেকে নিবিড় মেরেছিল। জেলু চাচার ছেলে রফিক জোর করে দান নিত। মারতো ওদেরকে। একদিন নিবিড় ওকে ধরে মারে। বেচারা অসুখে পড়ে যায়। তার জন্য নিবিড়কে বকা খেতে হয়। আজ আবার কবাডি খেলতে ইচ্ছে করছে। চাঁদের আলোতে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। সাহেব বাঁধের গায়ের গাছের পাতা গুলো চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। আজ কবাডি খেলতে ওর খুব মন চাইছে। কান কাটার সঙ্গে খেললে কেমন হয়? বেশ জমবে। যাবে নাকি এখন? এখন হয়তো ওরা থাকবে না। কাল যাবে ও কবাডি খেলতে। রফিক এর যে হাল করেছিল। সে হাল কান কাটার করবে।
মনে মনে ভাবে ও।
তাজনূর ওকে বেশ সমস্যাতে ফেলে দিল। বেশ ছিল ও। এখন ময়দান ছেড়ে ও পালাতেও পারবে না। দেখা যাক কি হয়!
– নিবিড়দা, খেয়ে নাও। লালু ডাকে।
– লালু, চল কাল কবাডি খেলতে।
– কবাডি! কোথায়?
– কেন, কান কাটার সঙ্গে!
– মরেছে! ওরা খারাপ লোক। তুমি যেও না। ওরা তোমাকে মারবে।
– দুস! কিচ্ছু করতে পারবে না। কবাডি খেলার অভ্যেস আছে।
– তুমি আমাকেও মার খাওয়াবা। আমি পালাবো।
– ওরে বোকা। ভয় পেলে ওরা আরও পেয়ে বসবে। আয় খেয়ে নিই। খিদে পেয়েছে। ফোন করতে হবে। এখানে এসে বেশ ভালোই লাগছে। খুব সুন্দর জায়গা। চাঁদখানা দেখছিস! মায়াবী আলো। মন কেমন করে নারে?
– লালু এ সবের কোনো মানে বুঝতে পারে না। ওর মুখের দিকে হাঁকরে তাকিয়ে থাকে।
– হাঁ করে থাকিসনি। নে খেয়ে নে। মুখে কিছু ঢুকে যাবে।
– তুমি কখন কি যে বলো। তার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না।
– তোকে বুঝতে হবে না। শুধু মাথা নাড়বি। তাহলেই হবে। হাঁদারাম কোথাকার। তোর বউ থাকে কি করে তোর সঙ্গে? তোর সঙ্গে ঘর করা যায়? তুই খুব বেসুরো। এমন রাতে বউকে আদর করতে হয়। গান শোনাতে হয়। তা না হলে বউ থাকে? বাপের বাড়ি পালাবে। রাত কাটবে কি করে রে?
– নিবিড়দা, তুমি একটা কি গো? কথায় কথায় বউ কে টেনে আনো।
– কেন? লজ্জা লাগছে? ওরে কেলু চাঁদ! পিরিতি বোঝো আর আদর বোঝো না! তোর কি হবে বল? চাপরাশি আর কতদিন করবি? বড়ো হবার শপথ নে। রাজার মতো বাঁচ।
– তুমি কি যে বলো নিবিড়দা! আমি কি চেষ্টা করিনা? হচ্ছে কই? সবখানে বাধা। তারপর ওপর কলির কথা। আর ভালো লাগেনা।
– আগে খা। তারপর বউকে যা বলার বলবি।
নিবিড় খেতে থাকে। কিন্তু ওর মাথায় কান কাটার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। ওকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। শালা যেন এ মুখো আর না হয়।
মনে মনে বলে কথাটা।
খাওয়ার শেষে আজ ওর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া না দিলে হয় না। কিন্তু ও কবেই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কলেজে পড়ার সময় এক একটা কখনো সখনো খেত। এখন একটু সিগারেট টানতে ওর মন করছে। কিন্তু না খাওয়ায় ভালো। শরীর খারাপ করে লাভ নেই। যখন ছেড়ে দিয়েছে তা আর দরকার নেই। নিবিড় আবার সাহেব বাঁধের দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদ ওকে টেনে নিয়ে যায়। এমন জোছনা সে অনেক দিন দেখেনি। এখানে না এলে মনে হয় দেখা হত না। নদীর জলে চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে জল। সাহেব বাঁধের ওপর দিয়ে ও অনেকটা হেঁটে যায়। কেউ নেই। সুন্দর পরিবেশ। নিবিড় নদীটাকে দেখছে।
এখানেই কথা থাকে। ওদের স্কুলে যাবে একদিন। ওর বাবা কত কষ্ট করে কথাকে মানুষ করেছে। এখনো মানুষটি কাজ করেন। বয়স হয়েছে। রোদ বৃষ্টি মাথায় করে কাজ করে চলেছেন। নিবিড় এর দেখে কষ্ট হয়। এ জীবনের কতই না রূপ! হরিণক্ষেতে এসে ওর অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। কত মানুষ আসে কাজের জন্য। কিন্তু সবাইকে ও কাজ দিকে পারে না। এমনিতেই অনেককে কাজ করছেন। অফিসের কথা মেনেই ওকে চলতে হয়। মন করলেও কাউকে কাজ দিতে পারে না। তা ছাড়া এখানে লেবার কন্ট্রাক্টর আছে। সেই- ই লোক আনে। বাকি কাজ নিবিড় দেখে। এখনো অনেক সময় লাগবে অফিস গড়ে উঠতে। নিবিড়কে এখানেই থাকতে হবে। তাজনূর হয়তো কাল আসতে পারে। সে কাজ এগিয়ে রাখে। তার আগে কান কাটাকে দেখতে হবে।
নিবিড় আসার সময় ফোনটা আনেনি। ফোনের জন্য ওর ভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ফোন ওর ভালো লাগে না। অবশ্য রাতে একবার তাজনূর ফোন করে। মিলনের তো পাত্তা নেই। ওর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।
নিবিড় ঘাসের বিছানায় বসে। শিশির পড়ছে টুপটুপ করে। গাছের পাতা ভিজে গেছে। চাঁদ আছে বলে আজ ওর ঘুম আসবে না। আজ ও চাঁদের আলোতে ভিজবে। অনেক দিন পর এমন মায়াবী জোছনা পেয়েছে সে। অন্য কিছু আজ ভাবতে চায় না। শুধু চাঁদ দেখবে। আকাশ। কথা থাকলে বেশ গল্প করা যেত। কাল এলে ওকে বলবে। কথা সত্যিই খুব ভালো মেয়ে। হরিণক্ষেতের এই রাত কখনো ও ভুলবে না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। [পরের পর্বে…]