Kate Chopin (Katherine O’Flaherty) (1850-1904)
আজকের পর্বে আমরা আমেরিকার নারীবাদী (feminist) আন্দোলনের আগ্রদূত ক্যাথারিন শপিনের লেখার সাথে পরিচিত হবো।
Kate Chopin (1850- 1904)
Louisiana ষ্টেটের অধিবাসী এই ক্যাথলিক Creole* মহিলার লেখার বিষয় ও অভিগমন উনবিংশ শতাব্দীর গোঁড়া ও বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকার সমাজে সমালোচনার ঝড় তোলে। অনেকে তার লেখাকে ব্যাভিচারি ও নীতিবিরোধী বলেও ঘোষণা করে।
ক্যাথারিন আমেরিকার প্রথম feminist লেখক, তার ছোটগল্প আর নভেলে তিনি সর্বপ্রথম নারী স্বাধীনতা আর নিজস্বতার পক্ষে সরব হন। এই প্রসঙ্গে তার The Awakening বইটি পরবর্তী কালে পাঠক সমাজে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে।
ক্যাথারিন তার লেখক জীবনে খুব বেশি লেখেননি। লেখার মধ্যে প্রধানত দুটি নভেল, At Fault (১৮৯০) আর The Awakening (১৮৯৯) উল্লেখযোগ্য। তার সাথে রয়েছে প্রচুর ছোটগল্প যা দুটি সঙ্কলনে একত্রিত করা হয়, Bayou Folk (১৮৯৪), আর A Night in Acadie (১৮৯৭)।
১৮৫০ সালে Missouri ষ্টেটের St. Louis শহরে ক্যাথারিন এক ফরাসি-আইরিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ের পর তিনি Louisiana ষ্টেটের New Orleans শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই কারণে তার বেশির ভাগ গল্পে Louisianaর মানুষ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিবাহিত নারীর একঘেয়ে জীবন, সংসারের ভার, আর পুরুষের প্রতি আনুগত্যর বিরুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম লেখা শুরু করেন। যেমন The Awakening বইটির কথাই ধরা যাক। উনবিংশ শতাব্দীতে Louisianaর সমুদ্রতীরের বাসিন্দাদের নিয়ে এই গল্পের নায়িকা Edna Pontellier, New Orleans শহরের ধনী ব্যবসায়ী স্বামী Léonce Pontellier আর দুই ছেলে Etienne আর Raoulকে নিয়ে তার সংসার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে Ednaর মনে নারীত্ব আর মাতৃত্বের প্রচলিত দর্শন নিয়ে এক ঘোর দ্বন্দ্ব লাগে, সে আর সামাজিক নিয়ম কানুনের কাছে নারীর নিজস্বতাকে বলি দিতে চায় না। একবার গরমের ছুটির সময় তারা সবাই Gulf of Mexicoর তীরে Grand Isleএর এক রিসর্টে বেড়াতে যায়। রিসর্টের মালিক এক মহিলা, Madame Lebrun. সেখানে Lebrun আর তার দুই ছেলে Robert আর Victorএর সাথে Pontellier পরিবারের পরিচয় হয়। Louisianaয় Edna তার প্রিয় বন্ধু Adeleএর সাথে অনেক সময় কাটায় যে তাকে সবসময় মায়ের ও সংসারে গিন্নির দায়িত্ব নিয়ে অনেক উপদেশ দেয়। কিন্তু এই ছুটিতে এসে Edna Lebrunএর সুপুরুষ ছেলে Robertএর প্রেমে পড়ে যায়। Robert Ednaর ভীষণ অনুরাগী, সবসময় তার সঙ্গ চায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই Robert এক বিবাহিত মহিলার সাথে তার প্রেমের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যবসার দোহাই দিয়ে মেক্সিকো চলে যায়। এই সময় Ednaর মনে তার মায়ের ও বিবাহিত জীবনের অবশ্যক দায়িত্বের সাথে নারীর নিজস্ব চাওয়া আর প্রেমের মানুষ বেছে নেবার স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। গরমের ছুটি শেষ হবার পর Pontellier পরিবার ফিরে আসে New Orleans শহরে। Edna ভাবতে শুরু করে যে সে এখন থেকে নিজের চাওয়া পাওয়াকে বেশি গুরুত্ব দেবে, তার যাতে আনন্দ আর সুখ সে তাই করবে। নিজেকে সে একটু একা করে নেয় আর সংসারের কিছু দায়িত্ব থেকে দূরে চলে যায়। মানসিক রোগ সন্দেহে স্বামী Leonce তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার Ednaকে একটু একা থাকারই উপদেশ দেয়। এরপর ব্যবসার কাজে Leonce New York যাবার সময় দুই ছেলেকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে একা থাকাকালীন Edna তার নিজের জীবনকে ভালভাবে বিশ্লেষণ করে আর নতুন পাড়ায় একটি ছোট বাংলো ভাড়া করে। সেখানে থাকার সময় Alcee Arobin নামের এক মহিলার সাথে নানা প্রণয় ক্রিয়ায় সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। Edna এই সময় প্রথম নারীর জীবনে যৌনতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে যদিও ক্রমে Alceeর সাথে তার সম্পর্ক বেমানান হয়ে পড়ে। এর পর Edna পরিচয় হয় Mademoiselle Reiszএর সঙ্গে। এই মহিলা এক বিখ্যাত পিয়ানোবাদিকা। তিনি Ednaকে সঙ্গীতের জগতের সাথে পরিচয় করান। তিনি Ednaকে আরও বলেন যে সমাজের প্রত্যাশা আর ধর্মের কড়া নিয়মকানুন সর্বদা মাথা পেতে মেনে নেয়ার পরিবর্তে সে যেন নিজের জীবনের ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রতি বেশি জোর দেয়। এই মহিলা আরও জানান যে তিনি Robertকে চেনেন আর Robert তাকে নিয়মিত চিঠি লেখে। Edna আকুল হয়ে সেই চিঠি পড়ে আর জানতে পারে যে Robert এখনো তাকে গভীর ভাবে ভালবাসে। কয়েক মাস পরে Robert New Orleansএ আসে আর স্বীকার করে যে সে সত্যিই Ednaকে ভালবাসে। দিন কয়েকের জন্য বন্ধু Adeleকে প্রসবকালে সাহায্য করার সময় Adele আবার Ednaকে মায়ের দায়িত্ব নিয়ে উপদেশ দেয়। Ednaর মনে আবার সেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। বাড়ি এসে সে দেখে Robert তাকে ছেড়ে চলে গেছে যাতে Ednaকে আর সমাজের কটু কথা শুনতে না হয়, সে Ednaকে সত্যিই খুব ভালবাসে। Edna পাগলের মত Grand Isleএ গিয়ে Robertকে খোঁজে। তাকে না পেয়ে এই জীবনের সব দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য Edna Gulf of Mexicoর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। ক্যাথারিনের এই বইটি সেই সময়ে সমালোচকদের প্রশংসা ও নিন্দা দুইই অর্জন করে।
*Creoles: Louisianaর ফরাসী জাতিগত গোষ্ঠী যারা প্রথম ফরাসী Louisiana উপনিবেশে বাসা গড়ে। আমেরিকার দখলে আসার পরেও এই গোষ্ঠীতে ফরাসী ও স্প্যানিশ সংস্কৃতি আর ভাষার প্রভাব রয়ে গেছে।
ক্যাথারিনের ছোটগল্পের ডালি থেকে তিনটি গল্পের উল্লেখ করলাম। Desiree’s Baby আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬০-৬৫) আগে বর্ণভেদ-বিশ্বাসী Louisianaর ফরাসী creole জমিদার মহলের গল্প। গল্পের নায়িকা Desiree ধনী Valmondé পরিবারের এক পালিতা কন্যা। জমিদার Valmondé তার খামারের গেটের কাছে এক সকালে রেখে যাওয়া শিশু Desireeকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে বড় করেন। বিয়ের বয়স হলে Desireeর সাথে আর এক ধনী creole পরিবারের পুত্র Armand Aubignyর বিয়ে হয়। তাদের প্রথম বাচ্চা হলে সবাই লক্ষ্য করে যে শিশুর গায়ের রঙ একটু কালোর দিকে (যাকে সেই সময়ে লোকে quadron, one-quarter African বলতো)। যেহেতু Desireeর বাবা মার সঠিক পরিচয় জানা নেই, Armand ও বাড়ির সবাই ধরে নেয় Desiree প্রকৃত সাদা আমেরিকান নয়। Desiree অস্বীকার করলেও কেউ কান দেয় না। মা Madame Valmondéকে চিঠি লিখলে তিনি Desireeকে বাচ্চা নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে আসতে বলেন। Armand বউকে গালি দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। Desiree নিঃশব্দে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে Louisianaর অন্ধকার জলার মধ্যে উধাও হয়ে যায়। বউয়ের সব জিনিশপত্র আর তাদের প্রেমপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার সময় Armandএর হাতে একটা চিঠি আসে, সে চিঠি Armandএর মা তার বাবাকে লিখেছিল। সেই চিঠিতে Armandএর মা তাদের ছেলের African জন্মসূত্রের গোপন ইঙ্গিত বাবাকে দিয়ে গেছেন, যা Armand কোনদিন জানতে পারে নি। গল্পের শেষে Desiree’s জন্ম ইতিহাস বলা হয় নি। সে অভাগী যে তার বাচ্চা নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে তা কেউ জানে না। সেই সময়ের আমেরিকায় গ্রামাঞ্চলের মানুষের বর্ণবিদ্বেষ যে কি ভীষণ তীব্র ছিল আর সমাজে যে সর্বদাই দোষ প্রথম পড়ে মেয়েদের ওপর এই দুই সত্য গল্পটিতে অনবদ্য ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
১৮৯৪ সালে The Story of an Hour গল্পটি প্রথমে The Dream of an Hour নামে Vogue পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে গল্প সঙ্কলনে নামটা একটু বদলে দেওয়া হয়েছিল। গল্পে Louise Mallard নামের এক গৃহবধূ যখন শোনে যে তার স্বামী Brently Mallard ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে আর যখন সে আবিষ্কার করে যে তার স্বামী জীবিত আছে, সেই এক ঘণ্টার কথা বলা আছে। গল্পের শুরুতে হৃদরোগের রুগী Louiseএর বোন Josephine দিদিকে খবর দেয় যে জামাইবাবু এক ট্রেনের অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। Louise খবরটা শুনে শোকে আপ্লুত হয়ে দোতালার ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দেয়। ক্রমে মৃত্যুর প্রাথমিক ধাক্কা চলে গেলে Louiseএর মনে আগামী স্বাধীন জীবনের আশা ও আনন্দের আভাস উঁকি দিতে শুরু করে। যদিও স্বামীর সাথে তার কোন ঝগড়া বা মনমালিন্য ছিল না, তবু এক মুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন তাকে নতুন অনুভূতির স্বাদ এনে দিল। Louise ঈশ্বরের কাছে দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা করে আগামী নতুন জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামতেই দেখে তার স্বামী সেই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে এসেছে। স্বামীর এই আচমকা আবির্ভাবের ধাক্কায় Louise হার্ট ফেল করে মারা যায়। গল্পটি মেয়েদের বিবাহজীবন, মৃত্যু, আর ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষার এক অনবদ্য বিশ্লেষণ। বিশেষ করে তৎকালীন গোঁড়া সমাজে বিবাহিত জীবনে সাধারণ মহিলার শ্বাসরোধী বন্দিজীবন আর প্রতিবন্ধতার এক নিদারুণ ইঙ্গিতও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। স্বভাবতই ১৮৮০ সালের আমেরিকায় গল্পটি তর্কের ঝড় তোলে।
The Storm গল্পে এক ঝড়ের সন্ধ্যায় স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে স্বামী Bobint তার চার বছরের ছেলে Bibiকে নিয়ে দোকানে যায় চিংড়ি মাছ কিনতে, কিন্তু ঝড়ের তেজ বেড়ে যাওয়ার পর তারা দোকানে আটকে পড়ে। বউ Calixta জানলার ধারে বসে তার সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল, সে বাইরে ঝড়ের এই তোলপাড় অতটা খেয়াল করে নি। এই সময় আচমকা দরজায় হাজির হয় Calixtaর পুরনো প্রেমিক Alce, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য Calixta তাকে ঘরে নিয়ে আসে। ঝড়ের রাতে স্বল্প আলোয় আলোকিত ঘরের জানলায় উৎকণ্ঠিত Calixaর রূপের মোহে মোহিত হয়ে Alce সব ভুলে Calixtaকে কাছে টেনে নেয় আর মুহূর্তের মধ্যেই দুজনের সব বাঁধা ভেঙ্গে যায়, তারা প্রেম নিবেদনের আদিম উন্মাদনায় মত্ত হয়ে যায়। ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ কমে গেলে Alce তার ঘোড়ায় চড়ে চলে যায় আর Bobint ও Bibi ফিরে আসে। Calixta আবার তার গৃহিণীর ভূমিকায় ফিরে আসে, ছেলের ভিজে জামা পালটে দেয়, স্বামীকে কফি দেয়, আর রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। Alce তার বউ ও ছেলেমেয়েদের সাথে আবার নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে যায়। ঝড় চলে যাওয়ার পর সবাই খুশি। লেখক এখানে বলতে চেয়েছেন শুধু ঝড় নয়, ঝড়ের সময় যা ঘটেছিলো সব পার হয়ে গেছে, সবাই আবার তাদের সুখী জীবনে ফিরে গেছে। ১৮৯৮ সালে গল্পটি পাঠক সমাজে মিশ্র পর্যালোচনা পায়, সেই সময়ে মানুষ এই পরকীয়া যৌনতার গল্প শুনতে তৈরি ছিল না।
জীবিতকালে ক্যাথারিন পাঠক সমাজে তেমন সাড়া না জাগাতে পারলেও, মৃত্যুর দুই শতকের মধ্যেই সমালোচকের দল তাদের সুর বদলায়। এমন কি তারা এও মেনে নেয় যে “some of Chopin’s work is equal to the best that has been produced in France or even in America”. ১৯০৪ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়েসে ক্যাথারিন শোপিন পরলোক গমন করেন।