গোলাপ কাঁটা
– কোথায় তোরা?
তোরা বলতে দেবু ওরফে দেবাশিস আর আমজাদ। আকাশের কলেজের বন্ধু।
দেবু বড়লোক বাপের একমাত্র সন্তান। বাবুয়ানায় অভ্যস্ত, দূর্বল চিত্ত। অপরদিকে আমজাদ চাষী ঘরের ছেলে। লেখাপড়ায় চৌকস, চাষের কাজেও সমান পটু। তেমনই সাহসী, একা পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ধরে সে।
দিন পাঁচেক আগে আকাশ বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিলে আমজাদ প্রথমে না করে দিয়েছিল। কিন্তু আকাশ নাছোড়, জোরাজুরি করতে থাকে। তখন খানিকটা নিমরাজি হয়ে সে বলেছিল, সামনে চাষের মরশুম। এইসময় কী করে যায় বল দেখি?
– আমি তোকে আসতে বলছি, ব্যাস আর কোন কথা হবে না।
– তোকে নিয়ে এই এক ঝামেলা।
– ঝামেলা! বেশ তবে আসিস না।
– আসব না বলেছি কী আমি? কিন্তু….
– কী?
– হঠাৎ বেড়াতে যাবার প্রোগ্রাম। সেকি এমনি এমনি?
– তবে নাতো কী? ইচ্ছে হল সবাই মিলে কটা দিন হৈ-হুল্লোড় করে….
– উঠলো বাই কটক যায়! ইচ্ছা হল অমনি রুম বুক করে ফেললি। নিশ্চয় অন্য কোন মতলব আছে তোর?
– থাকেই যদি, তোর কোন আপত্তি আছে?
– থাকলেই বা শুনছে কে? পরক্ষণে আমজাদ পুনরায় বলে, হ্যারে নারী ঘটিত কোন ব্যাপার স্যাপার নয়তো?
হোঁচট খায় আকাশ। তবে তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। পর মুহূর্তে সামলে উঠে ধমকের সুরে বলে, তুই আসছিস না তাহলে?
– কে বল্লে আসছি না? শ্লা তোরা এনজয় করবি, আর আমি বাড়িতে বসে….। – তা শুধু তোর জন্যই এ্যারেঞ্জ করেছিস না আমাদের কপালেও কিছু জুটবে? হা হা হা।
আমজাদের রসিকতায় যথেষ্ট বিরক্ত হলেও সেদিন আর কথা বাড়ায়নি আকাশ। দিনক্ষণ জানিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিল।
স্টেশন চত্ত্বরের বাইরে একটা চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে, চা খেতে খেতে দেবুর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। ওদেরও ট্রেনে আসার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে না পারায় ট্রেন ধরতে পারেনি। সে কথা জানিয়ে দেবু বলল, বাসে আসছি আমরা। তুই বাসস্ট্যান্ডে চলে আয়। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁচাচ্ছি আমরা সেখানে।
– ওকে ডিয়ার। ফোন কেটে দিল আকাশ। তারপর একটা টোটো ডেকে নিয়ে উঠে বসল। – বাসস্ট্যান্ডে চল।
একদিক দিয়ে ভালোই হল। গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের বাসে করেই যেতে হবে। সারাদিনে মাত্র তিনখানা বাস দেবীপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। একটা সকাল আটটায়, একটা দুপুরে, শেষেরটা সন্ধ্যা ছ’টায়। দুপুরে যে বাসটা যায় সেটার যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেওয়ায় দু’দিন বন্ধ আছে। ফরেস্ট বাংলোয় ফোন করে গত পরশু এসব কথা জেনেছে আকাশ।
প্রশ্ন হল বাসটা পুনরায় রাস্তায় নেমেছে কি? না নেমে থাকলে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে ভীষণ অস্বস্তিকর, আকাশ মনে মনে ইশ্বরকে স্মরণ করে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা যেন করতে না হয়।
– ভাই দুপুরের বাসটা দেবীপুর যাচ্ছে? পথ চলার অবসরে আকাশ টোটো চালককে জিজ্ঞাসা করলে ছেলেটা বলল, কাল পর্যন্ত যায়নি স্যার। আজ যাবে কিনা বলতে পারছি না।
চালকের কথার পিঠে কথা যোগ করার প্রয়োজন অনুভব করল না আকাশ। কানে হেডফোন গুঁজে মিউজিক প্লে করে দিল। সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে রবি ঠাকুরের গান – তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে….
রেল স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব বেশ খানিকটা। টোটো করে পৌঁছাতে বিশ মিনিট সময় লাগল। তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অনুসন্ধান অফিসের দিকে ছুটে চলল আকাশ। দুপুরের বাসটা যাচ্ছে কিনা আগে জানা দরকার।
কপাল ভালো বলতে হবে, পক্ষান্তরে বলা যায় ইশ্বর তার প্রার্থণা শুনেছেন। বাস যাবে, তবে ঘন্টাখানেক দেরি করে। তা হোক, সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করার ধকল থেকেতো বাঁচা গেল। প্রফুল্ল চিত্তে সে তিনখানা টিকিট কিনে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ততক্ষণে দেবুরা পৌঁছে গেছে। সবাই মিলে লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে হোটেলের সন্ধানে চলল, বাসস্ট্যান্ডের বাইরে রাস্তার ধারে।
বারোটা দশের জায়গায় একটা চল্লিশে ভেঁপু বেজে উঠল। যাত্রীরা সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বাস ছাড়ার সংকেত পেয়ে ছুটে এল সবাই। মুহূর্তের মধ্যে বাসের দরজার সামনে ভিড় জমে গেল। হুড়োহুড়ি গুঁতোগুঁতি চিল্লাচিল্লি, সে এক অরাজক অবস্থা। কে কার আগে বাসে উঠতে পারে, প্রতিযোগিতা চলছে যেন। আকাশরা তাতে সামিল না হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল, যতক্ষণ না ভিড় হালকা হয়। সিট বুক করা আছে, বসার জায়গা নিয়ে চিন্তা নেই।
সিট পড়েছে পিছনের দরজার কাছাকাছি। আকাশ আর আমজাদ বসল পাশাপাশি। আগের সিটে জানালার ধারে বসে আছে এক তরুণী। সার্ট-প্যান্ট পরিহিতা, চোখে রঙিন সানগ্লাস। হাতে স্মার্টফোন।
দেবু বসল তার পাশে।
– ক্যাম্পে যোগ দিতে যাচ্ছিস কবে? স্ট্যান্ড ছেড়ে বাস দেবীপুর অভিমুখে দৌড় শুরু করলে পরে আমজাদ জিজ্ঞাসা করল।
– পনেরো তারিখ থেকে প্রাক্টিস শুরু, আগের দিন রিপোর্ট করতে হবে।
– এটা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শিপ, না আন্তর্জাতিক? আগের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল দেবু।
– জাতীয়। এখানে যারা ভালো ফল করবে তাদের মধ্য থেকে চারজনকে আন্তর্জাতিক স্যুটিং চ্যাম্পিয়ন শিপের জন্য নির্বাচন করা হবে। আই হোপ, আই এ্যাম ওয়ান অফ দোজ ফোর।
আকাশ ভালো শুটার। জাতীয়স্তরে দুবারের চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়েছে একবার। এবছর প্রচুর পরিশ্রম করেছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের দিকে লক্ষ্য রেখে। ভালো ফলের আশা সে করতেই পারে।
আমজাদ দেবু কাছের মানুষ, বন্ধুকে ভালো করে চেনেজানে। তাদের বিচলিত হবার কিছু নেই। কিন্তু বেশকিছু বাসযাত্রী জাতীয়স্তরের চাম্পিয়নের সঙ্গে এক বাসে সফর করছে জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে উঠে আলাপ করতে এগিয়ে এল। কেউ হাত মিলিয়ে বিদায় নিল। কেউ বা এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে আবদার করে, অটোগ্রাফ প্লিজ। কাউকে নিরাশ করল না আকাশ।
দেবুর পাশে উপবিষ্ট সেই তরুণী, আকাশ স্যুটিং চাম্পিয়ন শোনার পর থেকেই ঘাড় কাত করে তাকিয়ে ছিল। ভিড় পাতলা হলে সিটের ওপারে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, উইস য়ু সাকসেস এ্যাট ইন্টারন্যাশনাল লেবেল টু।
– থ্যাংকস আ লট।
তরুণীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আকাশ বন্ধু আমজাদের দিকে ফিরে বলল, কি যেন বলছিলিস তুই?
– এইসময় তোর প্রাকটিসে লেগে থাকা উচিত ছিল। তা না করে জঙ্গল বিহারের লালসা জাগল কেন তোর মনে?
– চাপ নেবার আগে কদিন হালকা থাকতে চাই। ঘুরব-ফিরব, গল্পগুজব করে সময় কাটাব। আর….
– কী?
– একজনের সঙ্গে দেখা….
– কে সে? আকাশের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল আমজাদ।
– এক ফেসবুক ফ্রেন্ড।
– ফেসবুক ফ্রেন্ড?
– হ্যাঁ, ফেসবুকে পরিচয়। তারপর মেসেঞ্জারে বাক্যালাপ। সেখান থেকে….
– প্রেমের সূচনা। টিপন্নি কাটল দেবু ।
– প্রেম! একবুক গরম বাতাস নির্গত করে আকাশ বলতে থাকল, জানি না একে প্রেম বলা যায় কিনা । সম্পর্ক দৃঢ় করার তাগিদ আমার দিক থেকে অবশ্যই আছে, ঠিক ততটাই সে অনাগ্রহী। নিয়মিত মেসেঞ্জারে আসে, ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটিং করে। অথচ দেখা করার কথা বললে নানা বাহানায় এড়িয়ে যায়। এভাবে কখনও প্রেম হয়? এখন ছাড় ওসব কথা….
– ছাড়াছাড়ির কথা পরে ভাবা যাবে। চট করে দেবীর একখানা পিক দেখা দেখি।
– নারে, তার কোন ছবি আমার কাছে নেই।
– সে কিরে! প্রেম করছিস অথচ প্রেমিকার ছবি নেই কাছে?
দেবুর কথার পিঠে আমজাদ আরও যোগ করল, ফেসবুক প্রোফাইল কিংবা মেসেঞ্জার, কোথাও কি সে পিক এ্যাড করেনি?
– না! পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস উদ্গিরণ করে সে আরও বলল, সে দেখতে কেমন আমি জানি না।
পরিবেশ পরিস্থিতি ভুলে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠল আমজাদ, রূপে পাগল গুণে পাগল, এরকম অনেক পাগলের কথা শুনেছি। কিন্তু তুই কিসে বধ হলি ব্রাদার?
– বাক্যবাণে! ছোট করে উচ্চারণ করল আকাশ। তারপর কোলের ব্যাগটাকে বুকে চেপে ধরে উদাস কন্ঠে বলতে থাকল, মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে ভয়েস কল আসে। কি মিস্টি গলার স্বর, তেমনি কথা বলার স্টাইল। আর পারসোন্যালিটি….
– পারসোন্যালিটি! না দেখে তুই তার পারসোন্যালিটি পরিমাপ করে ফেললি? পাগল আর কাকে বলে।
আমজাদের কথায় রাগ করল না আকাশ। একগাল হেসে বলল, কি জানি হয়তো বা তাই। কিন্তু একথা তুই অস্বীকার করতে পারিস না কথাবার্তায় মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে।
– বেচারা! দেবুর পাশে উপবিষ্ট সেই তরুণী চুকচুক করে উঠলে বিরক্ত হল আকাশ। চকিতে তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, প্রেম করেছেন কখনও?
– আমি?
– হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
জবাবে তরুণী কিছু বলল না। এক ছটাক নিঃশব্দ হাসি উপহার দিল শুধু। আকাশ বলতে থাকল, প্রেমে পড়েননি তাহলে আর কী বুঝবেন? প্রেমে পড়েছে তারাই একমাত্র জানে এই যন্ত্রণা কত বেদনাদায়ক।
আকাশের বলার ভঙ্গিতে তরুণীর না হেসে পারল না। হাসতে হাসতে সে জানতে চাইল, মেয়েটা বুঝি দেবীপুরে থাকে?
– না। উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলের কোন এক গ্রামে তার বাড়ি। থাকে রাজধানী শহরে, বাবার চাকরি সূত্রে।
– আমরা তবে জঙ্গলে মরতে যাচ্ছি কেন?
আমজাদের প্রশ্নের উত্তরে আকাশ বলল, ও দশদিনের ট্যুরে বেড়িয়েছে। আজ সন্ধায় দেবীপুর ফরেস্ট বাংলোয় আতিথ্য নেবে। আগামীকাল দিনটা সেখানে অতিবাহিত করে, পরদিন সকালের গাড়িতে অন্যত্র চলে যাবে। এই সূযোগে যদি একঝলক দেখতে পায়, সেই আশায়….
– দেখবেন শুধু, প্রপোজ করবেন না?
– প্রপোজ! আকাশ চমকে উঠে তরুণীর দিকে তাকালে সে পুনরায় বলল, আমিও ফরেস্ট বাংলোয় উঠব। খোঁজপাত্তা নিয়ে যদি তার সন্ধান পায়….। ও ইয়েস, কি নাম যেন তার?
– রোজ।
– রোজ কী?
– আমি ওটুকুই জানি। সেটা তার আসল নাম, নাকি মেকি বলতে পারব না।
– ঠিক আছে। খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাব।
– আমরা ফরেস্ট কুইন রিসোর্টে উঠব। প্লিজ….
– বললাম তো জানাব। উঠে দাঁড়াল তরুণী।
কথায় কথায় বাস দেবীপুর স্ট্যান্ডে এসে গেছে আকাশ-রা বুঝতে পারেনি। তরুণীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে নামার তোড়জোড় শুরু করল।
তখন গোধূলিবেলা। আকাশে আবির রঙ ছড়িয়ে দিয়ে দিবাকর ধীরে ধীরে অন্তরালে চলেছেন। পাখিরা কুজন করছে ডালে ডালে। একে একে সবাই বাস থেকে নেমে এল। কাছেই ফরেস্ট বাংলো। তরুণী সেদিকে ধাবিত হলে আকাশ পিছু ডাকল, হ্যালো মিস।
– বলুন? ঘুরে দাঁড়াল তরুণী।
– কথায় কথায় আপনার নামটাই জানা হয়নি। নেম প্লিজ….
– আছেন তো এখানে ক’দিন। পরিচয় পর্বটা না হয় আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল।
এক মুঠো হাসি ছড়িয়ে দিয়ে তরুণী দ্রুত হেঁটে চলল বাংলো অভিমুখে।