প্রাপ্তি
গদগদ স্বরে স্ত্রীকে ডেকে বাসুদেব বাবু বললেন,” স্বর্ণকে মনে আছে মিতা– আমার কাছে পড়তো? ও এখন এডিএম হয়ে গেছে। ভাবতে পারো এই বয়সেই অতিরিক্ত জেলাশাসক! হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছে,স্যার আপনার পায়ের কাছে বসে একদিন লেখাপড়া করেছি। সেই জন্যেই আজ এতদূর আসতে পেরেছি।”
মিতা অর্থাৎ মিতালি ব্যানার্জি কোন উত্তর করলেন না।
বাসুদেব বাবু বললেন, “কিছু বললে না তো?”
একটু খিটখিটে ভাবেই উত্তর দিলেন মিতা,” তোমার ছাত্ররা তো দেশে বিদেশে বড় বড় জায়গায় আছে। তাতে তোমার কী হলো? তোমার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন কিছু এলো কি? কোথায় কোন ছাত্র কী হয়েছে তুমি একেবারে আহ্লাদে আটখানা। তুমি কী পেলে বলতো?”
সমস্ত আবেগগুলো হঠাৎ উধাও হয়ে গেল বাসুদেব বাবুর মন থেকে। মনে হল অনেক কথা। প্রায় ছত্রিশ বছর আগে বিএসসি পাস করেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন ভবতারিণী উচ্চ বিদ্যালয়ে।চাকরি করতে করতেই বিএড করেছিলেন। কিন্তু এমএসসি করা আর হয়ে ওঠেনি, যদিও অংকের শিক্ষক হিসেবে তার বিপুল প্রসার, বিস্তর নাম ডাক। ক্লাস ফাইভ থেকে একেবারে টুয়েলভ পর্যন্তই ক্লাস নিতে হয় তাকে, যদিও সরকারি নিয়ম অনুসারে ইলেভেন টুয়েলভে ক্লাস নিতে হলে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রয়োজন। যাক গে সে কথা। হাতে ধরে অংক শিখিয়েছেন বহু ছাত্রকে। তারা নানান জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনি আজও ওই গ্রাজুয়েট স্কেলেই রয়ে গেলেন। সত্যিই তো কী পেলেন তিনি? তাকে নিয়ে কোন হুটার বাজানো গাড়ি রাজপথে চলে না। তিনি এসে দাঁড়ালে কোন আধিকারিক সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে ওঠেন না। মনটা বেশ দমেই গেল বাসুদেব বাবুর।
রাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়। আজ ওষুধ খেয়েও ঠিকমতো ঘুম এলো না। হয়তো ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। সকাল সকালই উঠতে হলো। এখন তীব্র দাবদাহের কারণে কয়েক দিন ধরে মর্নিং স্কুল চলছে। সকাল পোনে সাতটায় হাজিরা। সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ বেরোতে হবে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে গেলেন স্কুলের দিকে। স্কুলে ঢুকতেই সব ভুলে গেলেন বাসুদেব বাবু। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা কিছুই মনে এলো না। প্রায় হাজার খানেক ছাত্র কলকল করছে চারদিকে। মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য ফুল ফুটে আছে বিদ্যালয় জুড়ে। একটু পরে শুরু হবে ক্লাস। এদের শিখাতে হবে। এদের মধ্যে আদর্শবোধ জাগাতে হবে। একটু পরেই শুরু হবে রোজকার লড়াই— রোজগারের লড়াই নয়।
প্রথম পিরিয়ডে ছিল সেভেন সির ক্লাস। ‘শিখবি না শিখিয়ে ছাড়বো’এমন ভঙ্গিতে অংক করাচ্ছিলেন বাসুদেব বাবু। হঠাৎ চোখে পড়ল শেষ বেঞ্চে শুভাশিস ঘুমিয়ে রয়েছে। ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়তে খুব বেশি দেরি নেই। ডেকে তুললেন শুভাশিসকে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো সে। বাসুদেব বাবু বললেন,” ঘুমাচ্ছিস কেন? রাত্রে ঘুমাসনি?”
খুব ভয় ভয় করে ছেলেটি বলল,” না স্যার।”
” কেন?”
” বাবার খুব জ্বর এসেছিল। সারারাত মা বাবার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল আর আমি পাশে চুপ করে বসে ছিলাম। মা বারবার বলল, যা গিয়ে শুয়ে পড়। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে শুতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভোরের দিকে বাবার জ্বরটা নামলো। একটু পরেই আমি স্কুলে চলে গেলাম। সারারাত ঘুমাই নি তো তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
বাসুদেব বাবু সহানুভূতির সঙ্গে বললেন,” আজ তাহলে না এলেই পারতি। একদিন স্কুলে না এলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।”
শুভাশিস অকপটভাবে বলল, “আপনার ক্লাসটা করার জন্যই আসা। কিন্তু সেটাই তো করতে পারলাম না।” চোখের কোণটা যেন চিক চিক করে উঠলো ছেলেটার।
বাসুদেব বাবু জিজ্ঞাসা করলেন,” তোর বাড়ি কোথায়?”
ছেলেটি বলল,”ঘোষপাড়া চার নম্বর কলোনিতে।”
“তোর বাবা কী করেন?”
“বাবা কলের মিস্ত্রি। কয়েক দিন ধরে জ্বর চলছে তো, তাই কাজে যেতেও পারছে না।” একটু চিন্তিত মুখে বাসুদেব বাবু বললেন,” আচ্ছা। ঠিক আছে। তুই বস।”
সন্ধ্যে নামার একটু পরে বাসুদেব বাবু খুঁজে বার করলেন শুভাশিসদের বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়তেই অল্পবয়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন।
” আপনি নিশ্চয়ই শুভাশিসের মা?”
বাসুদেব বাবুকে মহিলা বিলক্ষণ চিনতেন। একেবারে অবাক হয়ে সসম্মানে বললেন,”স্যার, আপনি ভিতরে আসুন। শুভ দেখে যা কে এসেছেন।”
বাসুদেব বাবু ঘরে গিয়ে বসলেন। ঘরজুড়ে অভাবের চিহ্ন,তবে তার মধ্যেও রুচির ছাপ রয়েছে স্পষ্ট। শুভাশিস কাছে এসে দাঁড়াতেই বাসুদেব বাবু বললেন,” তোর বাবা কেমন আছেন?”
শুভাশিস বলল,” আজকে আর জ্বর আসেনি। তবে শরীর খুব দুর্বল।”
” ঠিক আছে। আমি যাবার সময় বাবাকে দেখে যাব। তুই এখন এক কাজ কর। আজকে তো আমার ক্লাসটা করতে পারিস নি। খাতা পেন নিয়ে আয়। অংক বইটাও আনিস। আজ ক্লাসে যা করিয়েছি তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি।”
চল্লিশ মিনিটের ক্লাসে যা শিখিয়েছেন তা শেখাতে শেখাতে দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেল। ছেলেটার আগ্রহ দেখে বাসুদেব বাবু একেবারেই অবাক। বললেন,” আমি এখন রোজই আসবো তোকে অঙ্ক শেখাতে।”
ছেলেটাকে অংক শেখাতে শেখাতে তার মধ্যে অগ্রগমনের বীজ বুনতে শুরু করে দিয়েছিলেন বাসুদেব বাবু। ছেলেটা অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিল। একদিন বাসুদেব বাবু বললেন,” তোর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় কোনটারে?”
শুভাশিস বলল,” অংক আর অঙ্কন।”
“ভালো বলেছিস তো! দুটোই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একসাথে। অংকের সঙ্গে অঙ্কনের কোন বিরোধ নেই।”
বেশ চলছিল লেখা পড়া। বেশ চলছিল অংক শিখানো। হঠাৎ আগস্ট মাসের মাঝামাঝি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল শুভাশিস।ডাক্তাররা ঠিকমতো ধরতে পারলেন না রোগটা। ভেলোর যেতে হলো শেষ পর্যন্ত। বাবা মার সঙ্গে ভেলোর যাওয়ার সময় স্যারকে প্রণাম করে শুভাশিস বলল,” স্যার ফিরে এসে আবার শুরু হবে আমাদের অংক শেখা।”
শুভাশিস ফিরল না। শূন্য হাতে ফিরে এলেন ওর নিঃস্ব বাবা মা। খবর পেয়ে ওদের বাড়ি দেখা করতে যেতেই বাসুদেব বাবুর পায়ে পড়ে হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন ওরা। আকাশকে যেন বিদীর্ণ করে তুলল সব হারানো দম্পতির কান্না। বাসুদেব বাবু চোয়াল শক্ত করে বসে রইলেন।
যখন উঠে আসবেন তখন শুভাশিসের মা একটা ড্রয়িং শীটে আঁকা ছবি বাসুদেব বাবুর হাতে দিয়ে বললেন,” এই ছবিটা আঁকছিল শুভ শিক্ষক দিবসে নিজে আপনার হাতে দেবে বলে।”
ছবিটা হাতে নিয়ে বাসুদেব বাবু দেখলেন শুভাশিস খুব যত্ন করে তার মাস্টারমশাইয়ের ছবি এঁকেছে। জীবনের শেষ ছবি এঁকেছে শুভাশিস।একটু অসম্পূর্ণ রয়েছে ছবিটা। নিচে লেখা আছে ‘আমার আদর্শ’।
বাড়ি ফিরলেন বাসুদেব বাবু। থমধমে মুখ। গিন্নি এসে বললেন,” কী হলো? এরকম মুখ চোখ করে আছো কেন?”
ছবিটা এবার ঘরের টেবিলে নামিয়ে রেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন উনষাট বছর বয়সের বাসুদেব বাবু। কান্না থামলে বললেন,”মিতা, আমরা মাস্টারমশাইরা হয়তো অনেক কিছুই পাই না। কিন্তু আমরা যা পাই আর কেউ তা পায় না।”