২.
সেই কোন সকালে বের হয়েছিল জমিল। জমি কাদান চলছে। এবার বৃষ্টিপাত ভালোই হচ্ছে। বর্ষার ধানটা মনে হয় ভালোই হবে। সে মনে মনে ভাবে।
বিঘা দুয়েক মাঠান জমি টুকুই তার সম্বল। যে টুকু ধান হয় তা দিয়ে কোনো রকমে চলে। অন্য সময় জমিল নানান কাজ করে। সংসারটার ফাঁক ফোকর সে জোড়া লাগাতে পারে না। ফাঁক থেকেই যায়।
ওর বউ বানেরা বলে, সংসারটা আর চলবি না গো! এবির তুমি অন্য কাজে যাও।
জমিল মুখে কিছু বলে না। চুপ করে বসে বানেরার কথা শোনে।
কি গো রা কাড়লি না?
কি বলবো বল বানেরা। তুকে বিয়া করি এনি কোন সুখটো দিতি পারলিম? কপালে সুখ না থাকলি সুখ কি পাওয়া যায় বানেরা? ও সব খোদার হাত। সে দিলি সব হয়। তা না হলি আমাদের সব ধান জমি চলি গেল নদীর তলায়। আমাদের মতো আরও কত মানুষের। এই গাঁ ছেড়ি কত মানুষ চলি গেল। জমি না থাকলি কি খাবে বল?
বানেরা কোনো উত্তর করে না। শুধু জমিলের ছলছলে চোখ দুটোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এই ভাঙা গড়ার দুনিয়ায় দুটি মানুষ অনেক কষ্টে বেঁচে আছে। বানেরার বাপ কত কষ্ট করে তার বিয়ে দেয়। অপর জমিতে সে জন খাটে। বানেরার পড়বার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার বাপ সংসার চালাতে গিয়ে বানেরার পড়ার খরচ চালাতে পারেনি। বানেরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ওদের রাস্তা দিয়ে সব সার বেঁধে সব স্কুলে যাচ্ছে। ও তখন সংসারের কাজ করে। রাস্তা তার বন্ধ। তবু বানেরা রাতে শেবার আগে পুরোনো বই গুলো উল্টে দেখতো। বইয়ের ছবি গুলো এঁকে দিত তার মনের তটে আঁকিবুঁকি। ও হাত বোলাতো বইয়ের পাতায়। অনেক রাত অবধি ও ঘুমোতে পারতো না। বাঁশবনে শিয়াল ডাকতো। ছোট্ট বানেরা বই পাশে রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তো।
নদীতে জমি গুলো চলে যাওয়ার পর ওদের ঠিক মতো খাবার জুটতো না। জমিল কচুপাতা তুলে এনে দিত বানেরাকে। তাই সেদ্ধ করে নুন মিশিয়ে খেয়ে খেতো। বানেরা সব মুখ বন্ধ করে সয়ে গেছে। তার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শুধুই কি তাদের একা কষ্ট? পাশের মানুষ গুলোও তাদের খেতি জমি হারিয়েছে। তাদেরও দুবেলা খাবার জোটে না। কেমন এক হাহাকার নেমে এসেছে তাদের গাঁয়ে। নদী যেমন উপকার করে তেমনি আবার ভাসিয়ে দেয় সব।
ভাবে জমিল।
সেই ছেলে বেলাতে ওর মা সকিনা পান্তা ভাত পাঠাতো মাঠে। ওর বাপ চাষ দিত জমিতে। সোনার ফসলে ভরে যেত মাঠ। সবুজ সবুজ গন্ধ। জমিলের কি ভালো লাগতো। সেই সব পুরোনো কথা গুলো মনে পড়লে বুকটা টনটন করে ওঠে। আজ তার মা বাপ বেঁচে নেই। রেহান চাচারা চলে গেল অন্য জায়গায়। এখন তারা কে কেমন আছে কে জানে। জমিল আর যেতে পারে না রেহান চাচার বাড়ি। মানুষট খুব ভালো বাসতো তাকে। রেহান চাচা ভালো গান বাঁধতো। কত মানুষ আসতো চাচার বাড়ি। জমিল গান শুনতো। পাশের গাঁয়ে ও বোলান শুনতে যেত। যাত্রা। রায় বাড়িতে পুজোর সময় কবি গান, নাটক, বাউল আরও কত রকমের পালা হতো। রায় বাড়ির ছোট বাবু খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। জমিলরা সব দল গুছিয়ে যাত্রাপালা দেখতে যেত। ছোটবাবু ওদের না খাইয়ে ছাড়তেন না। জমিলের বাপ ছোট বাবুদের চাষাবাদ করতো। ফসলকুটো উঠলে দিত। এখন ছোট বাবু শহর থেকে আর আসেন না। সেই উৎসব আর তেমন হয়না। কেমন সব চুপচাপ। গাঁ গ্রাম উজার হবার জেগাড়। নদীর মতিগতি কেউ বলতে পারেনা। তার গর্ভে চলে গেছে এক সময়। বর্ষা এলেই কেমন এক ভয়ে দিন রাত কাটে। এই বুঝি ঘর বাড়ি তলিয়ে যাবে। তারা স্বস্তিতে বাস করতে পারে না। জমিলদের যাবার কোনো জায়গা নেই। ভিটেবাড়ি ছেড়ে যাবেই বা কোথায়! চরম এক সংকটে তাদের দিন কাটে।
জমিল কাদা মাখা হাত ধুয়ে এসে জল খাবার খেতে বসে। পাসালি জমিতে অমর চাচা চাষ দিচ্ছে। গরুর সঙ্গে কি যেন সব বলছে! মানুষটা বড়ো একা। অমর চাচার এক ছেলে। তার মারা যাওয়া অনেক দিন হল। নদীর জলে ভেসে যায়। সেবার ভাঙনে অনেক মানুষ ঘর ছাড়া হয়। অমর চাচার ছেলে ভাঙনের মুখে পড়ে। সে আর ফিরতে পারেনি। এখন সব কাজ চাচাকেই সামলাতে হয়। নাতি বউমাকে নিয়ে সাবেক বাড়ি ছেড়ে এখন অন্যতর আছে। বাড়িটা নদীর কাছে। যে কোনো সময় কিছু ঘটে যেতে পারে। গাঁয়ের মানুষ নদী দেখলেই ভয় পায়। যে নদী কে আপন মনে করতো।
ও চাচা, এসো গো জল খাবার খেয়ি নিই।
অমর চাচা বলদ দুটোকে রেখে উঠে আসে। পায়ে কাদা। ক্যানেলের জলে হাত মুখ ধোয়। এসে বসে জমিলের পাশে। জমিল শুকনো রুটি আর পেঁয়াজ এগিয়ে দেয়। অমর চাচা হাত বাড়িয়ে নেয়। মানুষটা আর তেমন কাজ করতে পারে না। জমিল কখনো কখনো চাষ করে দেয়। মানুষটা আর সংসার চালাতে পারে না। যার কাঁধে সংসারের ভার ছিল। সে তো আর বেঁচে নেই। জমিল কখনো মানুষটাকে ফেলে একা খায় না।
জমিল বাপজি, আর পারিনে বাপ। বউ মা নাতিটার কি হবি বাপ? এই ভেবি ভেবি আমার ঘুম আসে না বাপ।
হাতে রুটি। খেতে ভুলে যায়। শূন্য মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। গরু দুটো আলের ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে। কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে চাচা। জমিল তাকে রুটিটা খেয়ে নিতে বলে ।
সব ঠিক হয়ি যাবে চাচা।
আর ঠিকরে বাপ! ভাঙন সবখানি বাপ। বউটার মুখের দিকে তাকাতি পারি না।
চোখে জল চিকচিক করে ওঠে অমর চাচার। জমিল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলে মানুষটাকে শান্ত্বনা দেবে? ঘর পোড়া গরু। তার জীবনেও তো ঘটে চলেছে কত কী-ই। কিন্তু জমিল থেমে নেই। নদীর সঙ্গে তার মোকাবিলা। জমিল এই মাটি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
চাচা,খেয়ি নাও। লাঙল দিতি হবি আবার। কাজটা না হলি কাল ধান রোয়া হবিনি।
অমর চাচা রুটি খায়। জমিল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটির জন্য ওর মায়া হয়।
মাঠের শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। তাল গাছের সারি। কোথাও কোথাও বাবলা গাছ। আর কিছুদিন পর সবুজ ধানে ঢেকে যাবে মাঠ। অমর চাচা চলে গেল চাষ দিতে। জমিল আরও কিছুটা সময় বসে থাকে। বেলা গড়িয়ে যায়। গরু দুটোক ও ছেড়ে দিয়েছে। কাদান জমির জলে ছপাক ছপাক করে পা ফেলে গরু দুটো এদিক ওদিক গিয়ে আলের ঘাস খাচ্ছে।
অমর চাচার গলা শোনা যাচ্ছে। গরুকে, হা– হা– লে—লে করে তাড়া দিচ্ছে। মসমস করে লাঙল চলছে মাটির বুক চিরে। ক্যানলের জল ঢুকছে জমিতে। ভালো কাদান না হলে ধান চারা লাগবে না। ভালো ফলন হবে না। এই জমিটুকু চাষের জন্যে না থাকলে ওদের কি হতো? জমিল পথে বসতো। ওদের সুখ বলতে এই জমি। সবাই তো তার চোখের সামনে চলে গেল। নদীর পাড়ে বাচ্চাদের স্কুলটাও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। এখন অনু দিদি গাছ তলাতে বাচ্চাদের পড়ায়। বৃষ্টি এলে আর পড়া হয়না। সব ঘরে ফিরে যায়। ওদের জন্য একটা কিছু করতে হবে। ভাবে জমিল। অভাবী সংসারের ও বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি। বাপের সঙ্গে নাঙ্গল বাইতে যেত ও। স্কুলের পাশ দিয়ে গেলেই খুদেদের চেঁচামেচি শোনা যেত। অনু দিদি পড়াচ্ছেন। জমিল একটু দাঁড়িয়ে দেখতো স্কুলটাকে । ওর বাপ তাড়া দিত, আয় জমিল, অনেক কাজ বাকি আছি। উখানে কি?
জমিল হাঁটতে শুরু করে। তাদের মাটি সব। সেখানেই তাদের আসল শিক্ষার জায়গা। ফসল কেমন করে ভালো ফলবে। পোকা মারতে হবে বিষ দিয়ে। কখন ফসল তুলতে হবে ঘরে। এই তাদের জীবন। আজ অনু দিদির কথা মনে করে ও। বানেরার সন্তান হলে তাকে সে পড়াবে অনেক দূর । মোড়ল বাড়ির আয়েশার মতো তাকে কলেজে পাঠাবে। জমিল থেমে যাবে না। সে যেমন মাটিতে ফসল ফলায়। তেমনি তার তার সন্তানকেও নতুন পথ দেখাবে।
মাঠের মিঠে বাতাসে ওর স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে। আলো আসবেই। নদীর ভাঙন কখনোই জীবনকে আটকাতে পারে না। সে এগিয়ে যায়। আবারও নদীর চর পড়বে। জমিগুলো জেগে উঠবে। ফসল আবার ফলবেই ফলবে। সবুজ ক্ষেতে ভরে যাবে। যেমন আগে ভরে থাকতো সবুজ ফসলে।
জমিল কেমন এক ভাবনায় ডুবে যায়। চাষের কথা ভুলে যায়। ওর ভাবনা গুলো একদিন ডানা মেলবে।
ও বসে থাকে। মিঠে বাতাসটাতে আজ যেন কিসের একটা নেশা লেগে আছে।
(পরের পর্বে…)