আষাঢ়ের অলি মনোরমা
বাইরে বৃষ্টি। হটাৎ শুরু হলো। অলি বাইরে ঘরে বসে গল্পের মধ্যে ডুবে গেছে। মেঘলা আকাশ সঙ্গে গল্পের বই রূপকথার কম্বিনেশন। বইটা সদ্য কলকাতা বইমেলা থেকে কেনা। প্রেমের গল্প। জানালা খোলা। ঠান্ডা হাওয়া আছে প্রেমিকার মত। মাঝে মাঝে বৃষ্টির জল এসে পড়ছে মেঝেতে। ঝাপসা চারদিক। বৃষ্টির কুয়াশা। সকাল বলে মনেই হচ্ছে না। চোখটা সরিয়ে নজর ঘুরল অলির, কে যেন পাশের গাছ তলায় দাঁড়িয়ে। মনোরমা। অলি তাকে চেনে। পাশের পাড়ায় বাড়ি। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। আগে কথাবার্তা তেমন নাহলেও অলি হাঁক দিল,”ঘরে আসুন। বাইরে ভিজে যাবেন তো।”প্রথমে আসতে চায়নি মনোরমা। কিন্তু অলি এমন আন্তরিক ভাবে ডাকলো যে অগ্রাহ্য করতে পারলো না মনোরমা। প্রায় ভেজা শাড়িতে ঘরে এলো। চেয়ারটা এগিয়ে দিল অলি। আঁচলটা বুকে জড়িয়ে একপাশে বসলো মনোরমা। গল্পের ভেতরে আবার ডুবে গেল অলি। বৃষ্টিটা এবার বাড়লো।যাকে ইংরেজিতে বলে বিড়াল কুকুরের বৃষ্টি। আমগাছের নীচে সাইকেলটা ভিজছে। তাড়াতাড়িতে ওটা আর আনা হয়নি।
“আপনি খুব বই পড়েন না?”নীরবতার দেওয়াল ভাঙলো মনোরমা।
প্রস্তুত ছিল না অলি। কিছুটা হতচকিত। নিজেকে সামলে বলল,”পড়তে ভালো লাগে।”
“ভালো অভ্যাস। চারপাশে কত বই আপনার।”অবাক মনোরমা। অলির ঘরের বইয়ের পাহাড়। বেশির ভাগই ম্যাগাজিনের।”আপনার তো দেখছি ম্যাগাজিনের শখ।”
হালকা হাসলো অলি।”আসলে ম্যাগাজিনে প্রতি ভালবাসা। এগুলো সহজে পাওয়া যায় না।তাই সংগ্রহ করে রাখি।”
“এতো বই তা বলে!”
“লেখালিখি করি তাই দরকার হয়।”
“জানি আমি।”
“কি জানেন?”প্রশ্ন করলো অলি।
“আপনি লেখক। শুধু লেখক নন, ভালো কবিতা লেখেন।”বলল মনোরমা
আগ্রহ বাড়লো অলির।”এসব আপনাকে কে বলল?”
“নিবেদিতা।”
চুপ করে গেল অলি। কলেজের ভালবাসা। যাকে বর্ণনা করার জন্য রাতের পর রাত কবিতার লাইন চুরি করেছে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্ড বানাতে একবার বোলপুর গিয়েছিল। নিবেদিতা প্রতিদিন লাইব্রেরী যেতো। ওর জন্যই অলির প্রতিদিন লাইব্রেরি যাওয়া। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। নিবেদিতার পড়ার আগে বইটা শেষ করতে হবে, যাতে নিবেদিতা বলতে না পারে “তুই একটা গাধা রাম।”একবার শরত বঙ্কিম শেষ করার প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। কথা ছিল, অলি শরত পড়বে আর মনোরমা পড়বে বঙ্কিম। পড়ার শেষে একে অপরকে গল্প শেয়ার করবে। নিবেদিতা মনে করতো,এক জীবনে তো আর সবকিছু পড়া সম্ভব নয়। তবু যদি বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদ পাওয়া যায় তাতে খারাপ কি? আস্তে আস্তে অনেক বই পড়া হয়ে গেল। তবু মনের খিদে মিটলো না। বুঝতে পারতো অলি। একদিন বলেও ছিল, আগে নিজেকে চেনো। তাহলে অন্যকে চিনতে সহজ হবে। নাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। কথাটা ভালো লেগেছিল মনোরমার। কিন্তু নিজেকে জানার উপায় কি তার জানা নেই। অলি বলেছিল তোকে নিয়ে গল্প লিখবো। আয়নার মত দেখবে তখন। গল্পের নাম দেব _আমার নিবেদিতা। প্রতিদিন সকালে লেখা হতো সে গল্প। তবু গল্প শেষ হল না। ডাইরি মাঝ পথে থেমে গেল। করোনা কেড়ে নিল নিবেদিতাকে।
আষাঢ়ের বৃষ্টি কিছুটা কমলো। ঝিরঝির ভাবটা রয়ে গেছে। দু একজন রাস্তায় ছাতা মাথায় বেরিয়েছে। মাঠে জল ভর্তি। রাস্তায় কাদা। সাইকেলটা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে গেল। শুনতে পেল মনোরমা। তবু চেয়ারেই বসে রইলো। ইচ্ছে করলো না যেতে। ভেজা পাতার প্রান্তে জমছে বৃষ্টি বড়ি।” ডাইরিটা আমার কাছে।”হালকা স্বরে বললো মনোরমা।
তাকালো অলি। কিছু বলল না। বলার মত কোন শব্দও ছিলো না তার। “আপনার সব লেখা, ডাইরি নিবেদিতা আমাকে দিয়েছে। তখন আমিই ওকে দেখাশোনা করতাম। কভিদের পর তো আমি চাকরি পেলাম।আমি তখন আশাকর্মির কাজ করতাম।”
নীরবতা মনের ভেতরে যে কত গভীর হতে পারে আজ সেটা অনুভব করছে অলি। বইটা বন্ধ করলো। ভালো লাগছে না। একটু একা থাকার ইচ্ছে করছে। অথচ মনোরমাকে চলে যেতে বলতেও পারছে না।
“গল্পটা কিন্তু শেষ হয়নি।” অস্পষ্ট দাবি মনোরমার।
“গল্পটা যার সে তো আর নেই। লিখবো কাকে নিয়ে?” অভিমান অলির গলায়।
“ঝরা পাতার দেশে কি আর বসন্ত আসে না?”প্রশ্ন করল মনোরমা।
বিব্রত অলি। বুঝতে পারল না মনোরমার কথা। কিন্তু কথার ভিতর যে দর্শন আছে সেটা খোঁজার চেষ্টা করলো খানিক। নিজেকে বুঝে উঠার আগেই মনোরমা আবদার করলো, “আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে?”
হাসল অলি।”যাকে চিনি না তোকে নিয়ে কিভাবে গল্প লিখবো?”
“কেন? লেখক তো তার ভাবনার প্রশয়ে চরিত্র বানায়।”
“তার সঙ্গে বাস্তবও থাকে।” প্রত্যয় অলির গলায়।
মুখ ভার করলো মনোরমা। আবার বৃষ্টি নামলো। এক ঘন্টা হয়ে গেলো মনোরমা আটকে আছে। বৃষ্টিতে ডুবে গেছে সাইকেল। কেউ একজন বলে গেলো, “কার সাইকেল কে জানে? তার হুঁশ নেই। চুরি করে নিলে বুঝবে।”
“জানো আমাকে নিয়ে কেউ কোনোদিন গল্প লেখেনি। নিবেদিতার কাছে যখন শুনেছিলাম তখন খুব হিংসা হয়ে ছিল। এভাবেও জীবনের গল্প লেখা যায়?আমি লুকিয়ে আপনার ডাইরির পাতা পড়তাম। খুব অবাক হতাম। একজন কতোটা ভালোবাসলে তবেই লেখা যায়। আমি যদি টাকা অফার করি তাহলে লিখবেন?” আবেগের স্রোতে ভাসলো মনোরমা।
কথাটা ভালো লাগলো না অলির। মনোরমা বুঝতে পারল।”আপনার সাইকেলটা ডুবে গেল যে। বাড়িতে চিন্তা করবে।”
“রাগ করলেন?”জানতে চাইলো মনোরমা।
“রাগ কেন করবো? খারাপ লাগলো। টাকা দিয়ে গল্প হয়না ।”
“জানি সেটা। ভালবাসা দিয়ে হয়। এ জীবনে ভালবাসা আসবে না আর।”
“কেন আসবে না? আপনি শিক্ষিকা। বয়স কম।” বললো অলি।
“সংসার চালাতে শিক্ষিকা। হায়ার সেকেন্ডারি পর কোর্স করলাম। কাস্ট ছিল। চাকরি পেলাম।এখন সংসার আর দুই ভাইয়ের চাপ।আর পারছি না জানেন।”
“চেষ্টা করুন সব হবে।”আশ্বস্থ করলো অলি।
“আপনি চেষ্টা করুন তাহলে গল্পটাও শেষ হবে।”
“সব চেষ্টা কি সমান? আপনার এতো ইচ্ছে গল্পের জন্য?”
“আমি গল্পের শেষ দেখতে চাইতাম। আচ্ছা,বাকি গল্পটা আমাকে নিয়ে লেখা যায়না?” প্রস্তাব দিলো মনোরমা।
“তাহলে তো আপনাকে জানতে হবে, চিনতে হবে।”
“বলুন কি জানতে চান?” আগ্রহী মনোরমা।
“জানতে বা চিনতে হলে ভালোবাসতে হবে। আমি তো আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। আপনি পারবেন আমাকে ভালোবাসতে?” পাগলের মত বলে গেলো অলি।
“মৃত গাছে ফুল হয় না। আমার ভালবাসা নিবেদিতা হতে পারবে না।”
চুপ করে গেল দুজনে। জানালার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খাল। ভেসে আসছে দিন ছুটির কাগুজে নৌকা। দুটো _একটা নীল আর একটা হলুদ। হটাৎ হলুদটা আটকে গেল। নীল নৌকা এগিয়ে গেল অনেকটা। বৃষ্টি কমছে। বৃষ্টিতে ভিজছে কাগুজে নৌকা। ভিজে নৌকা কখন মিশে যাবে জলে তার খবর শিল্পীও জানে না।
“কেউ বলেনি, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবার কাছেও কোনোদিন উপহার পায়নি। নিজের মেয়ে বলেই পরিচয় দিত না। আজ সেই মেয়ের তাকাতেই সংসার চলছে। আমার কথা কেউ বলল না জানেন। নিজের কোথা তো আর নিজে বলা যায় না। লজ্জা লাগে। অন্য কেউ বললে ভালো লাগে।” বলল মনোরমা।
“জীবনের উপর কথা বলার অধিকার দিয়েছেন কাউকে?” প্রশ্ন অলির।
“না।সে ভাবে কেউ আসেনি।”
“তাহলে? কেউ আসে না। নিজে থেকে দরজা না খুললে কেউ আসবে না। ভালোবাসবেন দেখবেন আগন্তুক একদিন আপনার বন্ধু হয়ে গেছে। “বললো অলি।
কথাগুলো ভালো লাগল মনোরমার। এমন কথা শুনিনি আগে। “ধরুন যদি আপনাকে সেই অধিকার দিয়ে থাকি। তাহলে লিখবেন?”
“লিখব। গল্পের নাম দেব – নিবেদিতার বন্ধু।”
“আমার কথা লিখবেন তো?”
“লিখবো। গাছের শরীরে লতা যেমন জড়ানো থাকে।”
“বেশ। যদি সবটুকু জানাতে পারি তখন না হয় লতা ঝরে যাবে।”
“সেটাও সম্ভব। ভালবাসা সব পারে।”
“কবে দেখা হবে আবার?”
“যেদিন গল্প খুঁজবে শব্দ।”বললো অলি।
খুশি হলো মনোরমা। “আসতে আমাকে হবেই। নিজেকে চিনতে হলে ধরা দিতে হবে।”
আষাঢ়ের মেঘে নিম্নচাপ। বৃষ্টি কমল। কালো মেঘের আঁচল। শুনশান রাস্তা। সাইকেল ডুবে গেছে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলো মনোরমা। যাবার আগে চৌকাঠে দাঁড়ায়। মৃদু স্বরে অনুরোধ,”পারলে সাইকেলটা তুলে রাখবেন। কাল এসে নিয়ে যাবো। আমার গল্পে সাইকেলটা যেন থাকে। দেখবেন।”
নির্বাক অলি। কথা হারিয়ে গেলো যা ভেবেছিল বলবে। দরজা বন্ধ করলো। সাদা পাতায় আঁকিবুঁকি। সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া সময় ঝরা কাঠগোলাপ। নিজেকে এলিয়ে দিল অলি। আবার নামলো বৃষ্টি। সাইকেলটা হয়তো ভেসে যাবে এবার। ওর গল্প তো আষাঢ়ের।