নিবন্ধ: অনেক কালজয়ী গান মাত্র পাঁচ মিনিটেই লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম
অনেক কালজয়ী গান মাত্র পাঁচ মিনিটেই লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম
আধুনিক বাংলা গানের পাঁচ প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ (১৮৭১-১৯৩৪) আর কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।
বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যে এই পঞ্চরত্ন আধুনিক বাংলা গানকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; তাঁরা ছিলেন একাধারে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। গানের ক্ষেত্রে তাঁরা আবার একই সঙ্গে গীতিকার ও সুরকার।
কাজী নজরুল ইসলাম যে গতিতে একটা নতুন গান লিখে শেষ করতেন, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, এ কথা লিখে গেছেন তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি লিখেছেন, একটি গান লিখতে তাঁর সময় লেগেছে কখনও মাত্র পাঁচ মিনিট, আবার কখনও আধঘণ্টা।
নজরুল প্রথমেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে কোনও বিষয় ছাড়াই একটি রাগের সম্পূর্ণ কাঠামো তৈরি করে নিতেন। তার পর যে যে শব্দ ওই সুরের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাপ খায়, সে রকম বাছাই করা উত্তম সুরের সাহায্যে গানটি লিখে ফেলতেন। মোতাহার হোসেন তাঁর ‘স্মৃতিকথা’ বইয়ে আরও লিখেছেন, নজরুল হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গান গাইতে থাকতেন আর গ্রামোফোন কোম্পানির স্ক্রিপ্ট লেখকেরা সেটা সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিতেন অথবা কবি নিজেই গাইতে গাইতে লিখতেন। এভাবেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি রাগের কাঠামোর প্রতিটি অঙ্গের খাঁজে খাঁজে সুন্দর সুন্দর শব্দ বসিয়ে তৈরি করে ফেলতেন একেকটি মন মাতানো গান।
কবি বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর বন্ধুরা নজরুলের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই যেতেন। ওই বাড়িতেই নজরুলকে গান রচনা করতে দেখেছেন বুদ্ধদেব। ‘আমার যৌবন’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, সামনে হারমোনিয়াম, পাশে পানের বাটা, হারমোনিয়ামের ঢাকার ওপরে খোলা থাকে তাঁর খাতা আর ফাউন্টেনপেন– তিনি হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গেয়ে উঠেন একটি লাইন, আর সেই লাইনটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামনে রাখা খাতায় বড়ো বড়ো সুগোল অক্ষরে তিনি লিখে ফেলেন, সেই লাইনটি। তারপর এই ভাবেই তিনি একের পর এক লিখে ফেলেন দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ লাইন। আমার সামনেই আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করে ফেললেন সেই বিখ্যাত গান– ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান পিয়া’। বুদ্ধদেব বসুর মতে, সুরের নেশায় গানের কথা খুঁজে পেতেন নজরুল আর কথার ঠেলা সুরকে এগিয়ে নিত।
সিনেমা ও থিয়েটার জগতে নজরুল ইসলাম প্রবেশ করেন ১৯৩১ সালের প্রথম দিকে। ওই সময় ঠুমরি-সম্রাট ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খান সাহেবের মৃত্যু হলে গ্রামোফোন কোম্পানি নজরুলকে হেড কম্পোজার ও সংগীতশিল্পীদের ট্রেনার হিসেবে নিযুক্ত করে।
নজরুল রচিত গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছেন। গজল, রাগপ্রধান, কাব্যগীতি, উদ্দীপক গান, শ্যামাসংগীত, ইসলামি-সহ বহু বিচিত্র ধরনের গান তিনি রচনা করেছেন।
নজরুল হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গান গাইতে থাকতেন আর গ্রামোফোন কোম্পানির স্ক্রিপ্ট লেখকেরা সেটা তৎক্ষণাৎ লিখে নিতেন অথবা কবি নিজেই গাইতেন এবং লিখতেন। এ ভাবেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি রাগের কাঠামোর প্রতিটি অঙ্গের খাঁজে খাঁজে সুন্দর সুন্দর অক্ষর বসিয়ে তৈরি করে ফেলতেন এক একটি কালজয়ী গান।
নজরুল ইসলাম পুরনো ঢাকায় বনগ্রামের বাড়িতে গান শিখিয়েছেন প্রতিভা সোম বা রানু সোমকে, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করার পরে যিনি হন প্রতিভা বসু। নজরুলের বন্ধু বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের সূত্রে প্রতিভার পরিবারের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়। দিলীপ ছিলেন সাহিত্যিক ও সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। প্রতিভাকে গান শেখাতেন দিলীপকুমার। আর সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছিলেন বন্ধু নজরুলেরই গান।
নজরুল এক সন্ধ্যায় ফিটন গাড়িতে চড়ে হাজির হন রানু সোমের বাড়িতে। অনেক রাত পর্যন্ত গান শেখান। পরদিন সকালে আবার হাজির হন তাঁদের বাড়িতে। নজরুলকে দেখে রানু অবাক হন; কারণ, এতটা তিনি আশা করেননি। ‘জীবনের জলছবি’ বইয়ে প্রতিভা বসু লিখেছেন, রাত জেগে নতুন গান লিখেছেন নজরুল। গানটা হলো, ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনার গাঁয়। ভাঁটির টানে কেন আবার উজান যেতে চায়।’ রানু বলছেন, ‘দেখা গেল তখনো তাঁর বয়ান সঠিক নয়, সুরেরও হেরফের হচ্ছে। ঠিক করছেন গাইতে গাইতে, শেখাতে শেখাতে।’
মনোযোগী ছাত্রী রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসু ও কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলা গানের আদি ও মৌলিক সুর হচ্ছে লোকসুর। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা গান লোকসুরভিত্তিক। কীর্তন, বাউল, শ্যামাসঙ্গীত, ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া বাংলার প্রধান প্রধান লোকসুরের নিদর্শন।
নজরুলের শিল্পিজীবনের সূত্রপাত লেটোদল থেকে; এখানেই তাঁর কবিতা, গান ও নাটক রচনার শুরু; হিন্দুপুরাণ ও রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ঘটে এই লেটো দলে এসেই। ত্রিশাল-দরিরামপুর স্কুলজীবনে নজরুল ময়মনসিংহ অঞ্চলের তথা পূর্ববাংলার লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হন। সৈনিকজীবনে সামরিক ব্যান্ডের দৌলতে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও ফারসি কবিতার সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে গজলের রসবোদ্ধা হন। নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে প্রবেশ করেন কলকাতায় কুড়ির দশকের শুরুতে এবং নিয়মিত গান রচনা শুরু করেন ১৯২৪ সাল থেকে অসহযোগ, খিলাফত, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব প্রভৃতি ইংরেজ সরকারবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়।
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে নজরুল বেশ কিছু উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেন, কালানুক্রমিকভাবে যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘ঘোররে ঘোর আমার সাধের চরকা ঘোর’, ‘শিকল পরা ছল মোদের ঐ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, ‘ওঠরে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’, ‘ধ্বংস পথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’,’আমরা শক্তি আমরা বল’, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’প্রভৃতি। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নজরুলের সঙ্গীত-প্রতিভার প্রথম স্ফূরণ ঘটে উদ্দীপনামূলক গানে। গানগুলিতে তিনি মূলত স্বদেশী সুর ও ঢং ব্যবহার করলেও তাতে দৃঢ বলিষ্ঠতা সংযোজন করেন।
১৯২৬ সালের শেষ দিকে তিনি গজল রচনা শুরু করেন এবং ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় একটানা বহু জনপ্রিয় গজল রচনা করেন। নজরুলের গজলের বিষয়বস্তু মূলত প্রেম হলেও তার ছিল প্রকৃতি মিশ্রিত। সেগুলির বাণী প্রধানত উৎকৃষ্ট কবিতা আর সুর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাগাশ্রিত এবং আঙ্গিকের দিক থেকে প্রায় উর্দু গজলের মতোই। তাতে আগাগোড়া তালের প্রয়োগ নেই ঠিকই, তবে কিছু অংশ তাল ছাড়া মুক্ত ছন্দ ও আলাপের রীতিতে রচিত। বাকি অংশ অবশ্যই তালের কাঠামোতে গ্রথিত।
গ্রামোফোন কোম্পানিতে ধীরেন দাস ও কাজী নজরুল ইসলাম
১৯৩০-৩১ সাল থেকে নজরুল নতুন এক ধারার সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময়ে তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক এবং ইসলামি গান রচনা শুরু করেন। হিন্দু ভক্তিগীতির মধ্যে তিনি প্রথম রচনা করেন ‘জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী’, ‘তিমির বিদারী অলখ বিহারী’, ‘জাগো হে রুদ্র জাগো রুদ্রাণী’ ইত্যাদি। ইসলামি গানের মধ্যে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ’, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি। নজরুল প্রায় এক হাজার ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেন, যার মধ্যে হিন্দু ঐতিহ্যের শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এবং ইসলামি ঐতিহ্যের হামদ্, নাত, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, মর্সিয়া প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের গান রয়েছে। এসব গানের রচনা ত্রিশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল।
সেই সব গান যতই জনপ্রিয় হোক, কালের বিচারে যতই উত্তীর্ণ হোক, সঙ্গীত প্রিয় মানুষ যতই ভাবুন এইসব গান রচনা করতে গিয়ে নজরুলকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে, তা কিন্তু মোটেই নয়। তিনি এইসব কালজয়ী গান মুহূর্তের মধ্যে রচনা করেছেন হাসতে হাসতে, অবলীলায়।