চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
তাঁর ডাকনাম ছিল রানি। তখনকার দিনে কোন মেয়েকে একা একা বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হত না। বিশেষত সেই মেয়ে যদি অবিবাহিত যুবতী হয় তাহলে তো কথাই নেই! তা সেই যুবতী রানি একদিন নির্দিষ্ট এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে একটি চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে লিখলেন, “আপনি (আমাকে) নেওয়ার জন্য (যেদিন) লোক পাঠাবেন, সেই দিন আসতে পারব, কোন বাধাই আমাকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না।” না, কেউ তাঁকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
তিনি ১৯৩০ সালে ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। সেই সময় বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তর গুনু পিসিমার সাথে পরিচয় হয়। পিসিমা ছিলেন সব দলের বিপ্লবীদেরই পৃষ্ঠপোষক। রানি ১৯৩২ সালে ডিস্টিংশান পেয়ে বি এ পাশ করে চট্টগ্রামের অপর্ণাচরণ দে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। তার দু’বছর আগেই প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশ শাসকদের সম্মুখ সমরে পরাস্ত করার সুবাদে বিশ্ববাসী জেনে গেছে চট্টগ্রামের নাম। সবাই নাম শুনেছে বীর যোদ্ধা মাস্টারদা সূর্য সেনের। মাস্টারদার দলে যোগ দিয়ে দেশের মুক্তি সংগ্রামে সামিল হওয়ার বড়ই বাসনা রানির মনে। ওদিকে মাস্টারদারও বহুদিনের স্বপ্ন ছিল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে বদলা নেবেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার। ১৫ জনের বাছাই করা বাহিনী তৈরি করে রানিকেই অভিযানের সেনাপতি নির্বাচন করলেন মাস্টারদা। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সেই অভিযানে গিয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে অসম যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে এদেশের প্রথম নারী শহীদের গৌরব অর্জন করেন সেই বীরাঙ্গনা রানি, যার পোশাকি নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
আত্মাহুতির আগের দিন মায়ের উদ্দেশে একটি চিঠিতে প্রীতিলতা লিখেছিলেন, “মাগো, তুমি কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য — স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!”
আজ বীরাঙ্গনা সেই নারীর ১১৩ তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে, শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচার অবসানের যে-স্বপ্ন বুকে নিয়ে তিনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, স্বাধীন দেশের শাসকেরা তা পূরণ করতে পেরেছে কি? নাকি একই শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচারের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন তারা?