যদি বৃষ্টি নামে (ধারাবাহিক উপন্যাস)। প্রথম পর্ব। রাজকুমার শেখ - শৃণ্বন্তু যদি বৃষ্টি নামে (ধারাবাহিক উপন্যাস)। প্রথম পর্ব। রাজকুমার শেখ - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:০৭ অপরাহ্ন

যদি বৃষ্টি নামে (ধারাবাহিক উপন্যাস)। প্রথম পর্ব। রাজকুমার শেখ

আপডেট করা হয়েছে : শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৬:৩৩ পূর্বাহ্ন
যদি বৃষ্টি নামে (ধারাবাহিক উপন্যাস)। প্রথম পর্ব। রাজকুমার শেখ


ধারাবাহিক উপন্যাস।। যদি বৃষ্টি নামে।। প্রথম পর্ব:

 

রাজকুমার শেখ 

 

মা তখন হাসপাতালে ভর্তি।  নিবিড় এর বয়স তখন কতই বা হবে? আট কি নয়। ও বাবার সঙ্গে মাকে দেখতে গেছে। মায়ের আকাশে মুখটা কেমন যেন অচেনা লেগেছিল। নিবিড় ওর মাকে বড়ো বড়ো চোখ করে দেখছিল। ওর মা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে কছে ডাকে। নিবিড় এগিয়ে যায় মায়ের কাছে। ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে থাকে। তার মা কত হাসিখুশি। আজ এমন কেন হল? ছোট্ট নিবিড় ভেবে পায়না।
কিরে নিবিড়,  অত কি ভাবছিস? আমি ভালো হয়ে যাবো।
খুব কষ্ট করে হাসেন রুকসানা। তারপর একটা বড়ো সাইজের টকটকে লাল আপেল তুলে দেন নিবিড় এর হাতে। তারপর বাবা ওকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে আসেন। মা তাকিয়ে থাকেন নিবিড় এর দিকে।
আজ অনেক দিন পর তার মাকে মনে পড়ছে। সেদিন যে আপেলটা ওর হাতে দিয়েছিলেন। অত বড়ো সাইজের টকটকে লাল আপেল আর চোখে পড়ে না তার। আজ মা নেই।  কথাগুলো বুকের গভীরে আটকে থেকে গেছে। যা কোনো দিনই মুছে যাবে না। এখনো ফলের বাজারে গেলে আপেলগুলো দেখি। কি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আপেল। হাতে তুলে নিই।  মা মা গন্ধটা খুঁজি। সেই টকটকে লাল আপেল আর চোখে পড়ে না। বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরি। আসলে যার মা নেই তার জগৎ ফাঁকা। আসলে নিবিড় সুখী মানুষ নয়। তার জীবন অনেক ভাঙাগড়া দিয়ে মোড়া।  নিবিড় কখনো তেমন সুখের মুখ দেখেনি। তার জীবনটাই একটা ঝড়। মাকে হারিয়ে সে আরও বেশি একা। পড়াশোনা শেষ করে ভেবেছিল কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। কিন্তু কোথাও তার স্থায়ী ঠিকানা হয়নি। মাঝে মাঝে বসে মনের কথা লিখবার। কিন্তু সে তার মনের সব কথা লিখে উঠতে পারে না। বসে থাকে চুপচাপ।  ভাবনার অতলে ডুবে থাকে। জীবনটা তার বড়োই ভারবাহী মনে হয়। এত মানুষের ভিড়ে সে একা।
না আজ আর এত ভাবনা নয়। হঠাৎ করে তাজনূরের কথাটা মনে পড়ে গেল। ওকে আজ অফিসে যেতে বলেছে। একটা কাজ আছে। তাজনূর ওর বন্ধু মিলনের বোন। ওর বাবার মৃত্যুর পর অফিসের দায়িত্ব নেয় এই তাজনূর। মিলনের বাড়ি গেলে কখনো সখনো তাজনূরের সঙ্গে নিবিড় এর আলাপ হয়েছে। মিষ্টি করে হেসে তাকে কথা বলে। দেখতেও সুন্দরী।  টিকালো নাকের পাশে কালো তিলটাতে যে কারোর চোখ আটকে যাবে। নিবিড়ও দেখেছিল চোখ ভরে তিলটাকে। সত্যিই সে সুন্দরী।  অবশ্য নিবিড় তাজনূরকে একটু দূরেই রেখেছে। মেয়েটি অত বড়ো অফিস সামলায়। কত মানুষ কাজ করে। নিবিড় অবাক হয়। আর মিলন, সেই কলেজে যেমনটি ছিল, আজও তেমনটিই আছে। আপন ভোলা। তাজনূর না থাকলে সব বন্ধ হয়ে যেত। মিলন বলে, নিবিড়, ও সব আমার জন্য নয়। বোন আছে সামলাক। তুই এক কাজ কর, আমারদের অফিসে জয়েন কর।
আমি!
কেন?  কোনো আপত্তি আছে?
না। তুই বললে করতে পারি। কিন্তু!
কিন্তু কি?
না।  মানে বলছিলাম,  আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে?
সে তাজনূর বুঝবে। তুই রাজি থাকলে বলবো।
ও আর দেরি করে না। দশটার সময় তাকে ডেকেছে।  নিবিড় তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ও বের হতেই বাড়ির সামনে এক আপেল ওয়ালা।
বাবু, আপেল নেবেন?
আপেল!
নিবিড় অবাক হয়ে আপেল গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই মায়ের দেওয়া আপেলটার মতো একটিও নয়।
বাবু, আপেল।
ওর চমক ভাঙে।
না। থাক।
নিবিড় তাড়াতাড়ি অটো ধরে। আজ রাস্তাতে বেশ ভিড়। আজ কোন নেতা এসেছে। অটো ভিড় কাটিয়ে চলছে। ও তাড়া দিচ্ছে।  কিন্তু রাস্তা ফাঁকা নেই। পর কপালে ভাঁজ। বিন্দু বিন্দু  ঘাম। আজ সময় মতো না গেলে ওর চাকরিটা হবে না। মিলন যতই বলুক। কিন্তু তাকে তো সময় মতো পৌঁছাতে হবে। এবার অটোটা নড়ে উঠলো। এমন সময় ও দেখছে রাস্তার পাশে একজন ফল বিক্রি করছে। বড়ো সাইজের একটা লাল আপেল। নিবিড় এর চোখ আটকে যায়। কিন্তু ওর চোখের পলক পড়তেই হুস করে অটো সামনে এগিয়ে যায়। না আর সে আপেলটা নিতে পারলো না। ওর মাকে আবার মনে পড়ে যায়।
ও যখন অফিসে পৌঁছালো তখন দশটা বেজে পাঁচ।  ও মনে মনে বলে, না আজ তাকে আর দরকার নেই।  সব গেল জল হয়ে। আজ ও এই অফিসে প্রথম আসছে। ঝা-চকচকে অফিস।  নিবিড় দাঁড়িয়ে ভাবছে। এমন সময় কেবিন থেকে তাজনূর বেরিয়ে আসছে। ওকে সামনে দেখতে পেয়েই বলে, নিবিড়দা, চলো আমার সঙ্গে।  আজ একটু তাড়া আছে। গাড়িতে যেতে যেতে কথা বলে নেব।।
অগত্যা নিবিড় তাজনূর এর সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসে। তাজনূর বলে, নিবিড়দা, আমি ভাইয়ার কাছে সব জেনেছি। তোমাকে আমার দরকার।
কিন্তু কাজটা কি?
নিবিড় জিগ্যেস করে।
তোমার কাজ সবখানে। আমি যা বলবো তাই করতে হবে। আরে অফিসের কাজ।
বলেই তাজনূর আলতো করে হাসে। ওর গালে টোল পড়ে। কালো তিলটা আজ আরও বেশি উজ্জ্বল।  মিলন যে কি চায় তার সঙ্গে? তা ও জানে না।
নিবিড়দা স্যালারি কত দেব?
নিবিড় অবাক হয়ে তাকায়। মজা করছে না তো ওর সঙ্গে?
আমি তো বলতে পারবো না।
ওকে। ঠিক আছে। আমি ওটা ঠিক করে দেব।কিন্তু শর্ত একটা আছে।
কি?
আমি যখন ডাকবো আসতে হবে। কোনো অজুহাত শুনবো না। রাজি?
একটু সময় নেয় নিবিড়।  কি শান্ত রাস্তা। গাড়ি ছুটছে নির্জন রাস্তা দিয়ে।  ডাইভার এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। আজ সকাল থেকেই কেমন একটা হিম হিম ভাব তার মনে। সময় বয়ে চলে। তাজনূর ওর দিকে তাকিয়ে উত্তরের আশায়।
নিবিড় বলে, ঠিক আছে।  আসবো।
গুড। নিবিড়দা, তুমি নাকি কলেজে পড়ার সময় ভালো গান গাইতে?
এ সব বুঝি মিলন বলেছে?
হুম। আমি গান খুব ভালো বাসি। অবশ্য ক্ল্যাসিক্যাল। এমনি গানও শুনি।
এত সবের মধ্যে গান শোনা হয়?
হুম। একদিন শোনাবে আমাকে তোমার গান?
সে সব চর্চা এখন তেমন নেই।  তবে রবীন্দ্র সংগীত কখনো কখনো গায়।  মন ভালো থাকে।
ওঃ! তাই? আমিও শুনি। বিশেষ করে সকালে। মন ভালো থাকে সারাদিন। চা খাবে?
এখানে!
এখানে একটা খুব ভালো চায়ের দোকান আছে। এ দিক দিয়ে গেলে আমি চা খেয়ে তবে যাই।
বেশ চলো।
গাড়ি থেকে নামে ওরা। তেমন ভিড়ে ছিল না। দু একজন ছিল। তাজনূর গাড়ি থেকে নামতেই একজন ওকে বার বার দেখছে। ও সব পাত্তা না দিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে। সুন্দর জায়গা। নিবিড় কখনো এ দিকে আসেনি। তার কাজের প্রথম দিনটা কেমন কৌতুহল মিশানো। নিবিড় একটু দূরত্ব রেখেই বসে। চা আসে। ও গরম চায়ে চুমুক দেয়।
আজ কি বৃষ্টি নামবে? ওর মনের ভেতর কেমন একটা গুমোট ভাব। কিছুতেই ও স্বাভাবিক হতে পারছে না। এই কি মিলনের বোন? না অন্য কেউ! ওদের বাড়ি গেলে তাজনূর নিজ হাতে চা করে নিয়ে আসতো। মিষ্টি করে কথা বলতো। সে ভাবে নিবিড় ওকে পরখ করেনি। আজ কেমন এক রহস্যময়ী লাগছে। তাজনূরের জানালা দিয়ে আসা বাতাসে ওর রেশমঘন চুল উড়ছে। নিবিড় এর মুখে চোখে এসে পড়ছে। ও হাত দিয়ে চুল গুলো ঠিক করছে না। ওকে নিয়ে ঠিক কোথায় যাচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। মিলনের ওপর ওর খুব রাগ হল। আচ্ছা কাজে ওকে ফাঁসালো। ওর সঙ্গে হবে এক চোট।
ভাবে নিবিড়।
এমন সময় গাড়িটা বড়ো রাস্তা ছেড়ে বাঁয়ে  মোড় নিল। ধুলো রাস্তা।  কাঁচ তুলে দিল। বেশ কিছুটা আসার পর গাড়িটা থামে। ওকে তাজনূর নামতে বলে। ও নামে। অনেকটা ফাঁকা জায়গা। পাশে নদী। বাঁক নিয়ে দূরে কোথায় যেন নদীটা হারিয়ে গেছে। নিবিড় দেখছিল নদীটাকে। বাতাসে জলজ গন্ধ।  এমন সময় তাজনূর বলে, কেমন জায়গাটা?
ওর শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে নিবিড় বলে, সুন্দর।
জায়গাটা না নদী?
দুটোই।
তাই! তাহলে তো এখানে নতুন করে কিছু করা যাবে। জমিটা কি নেওয়া যাবে?
নিবিড় হ্যাঁ বলে দেয়। তাজনূর খুশি হয়।
আমরা নতুন একটা প্রজেক্ট করবো ভাবছি।
খুব ভালো হবে।
ভাইয়া তো কোনো কিছু নিয়ে ভাবে না। এত বড়ো কাজ কি একা করা যায়?
এবার ও বুঝতে পারছে। কেন তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।  নিবিড় মনে মনে বলে, বেটা আমার ঘাড়ে সব চাপাতে চায়।
আজই তাহলে সব ফাইনাল করে ফেলবো। নিবিড়দা, তোমাকে অনেক নড়ো দায়িত্ব নিতে হবে।  তুমি থাকলে আমি ভরসা পাবো।
নিবিড় এর মুখের দিকে তাকিয়ে তাজনূর বলে কথাটা।
নিবিড় আলতো করে বলে, থাকবো।
নদীর শীতল বাতাস এসে দুজনকে আঁকড়ে ধরে। নদী বইছে আপন নিয়মে। আজ এই দিনটিকে সে বহুদিন মনে রাখবে। কিন্তু সে কি এখানেও থাকতে পারবে? কেন যে তার মন কোনো কাজেই বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এখানেও কি সে থাকতে পারবে?
কি অমন করে ভাবছো নিবিড়দা? তুমি যখন আমাদের বাড়ি প্রথম এসেছিলে। সেদিন তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল ভীষণ রাশভারি একটা মানুষ।
ওঃ!  তাই মনে হয়েছিল বুঝি?
তুমি গান জানো। কি সব লিখো। অনেক গুণ তোমার।
 নিশ্চয়ই মিলন বলেছে? এ সব ওর বাড়িয়ে বলা। ওর কথা শুনো না তুমি। ও একটা ফাজিল। সবার পিছনে লাগা চায়।
ভাইয়া কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে। বার বার তোমার কথা বলে। কালই তো বলল তোমার জন্য।  আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার মতো একজনকে পেয়ে।
আমি কি পারবো?
কেন পারবে না? অফিসে নিধু কাকা আছেন। তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে।
ওরা পায়ে পায়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। টলটল করছে জল। এই নদীর নাম ও জানে না। তাজনূরের মুখের ছায়া পড়েছে নদীর জলে। কি মায়াবী লাগছে ওকে। এ ভাবে সে কখনো নদী দেখেনি। আজ আবার নতুন করে সে নদী চিনলো। নদীর কাছে না এলে সে অধরাই থেকে যায়।
কি সুন্দর না?
নদী?
হুম।
যাবে ওপারে?
নৌকো নেই তো। কি ভাবে যাবো?
নৌকো এলে যাবো।
নদীর পাশে বলেই আমার জায়গাটা পছন্দ হয়েছে।
অফিস ফিরবে না?
ফিরবো। আজ আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। লাঞ্চটা রাস্তার পাশে কোনো ধাবাতে করে নেব।  কতদিন এ ভাবে বের হইনি। মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ দেখিনি। মিলন ভাইয়াকে দেখে হিংসে হয়। ও বেশ আছে। আমি আর কত করবো। একটু ফুরসত পাই না।
তাজনূর কেমন অন্য মনস্ক হয়ে যায়। নিবিড় চুপ করে নদী দেখছে। একটিও নৌকার দেখা নেই।  ও  দূরে বাঁকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নদীর জলে দুজন মানব মানবীর ছায়া পড়ে ঢেউ এ দুলতে থাকে।
(ক্রমশ…)


আপনার মতামত লিখুন :

2 responses to “যদি বৃষ্টি নামে (ধারাবাহিক উপন্যাস)। প্রথম পর্ব। রাজকুমার শেখ”

  1. নামহীন says:

    ভালো লাগলো..বানান গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখলে ভালোহতো. ..আগামী পর্বের আশায় রইলাম.. …

  2. নামহীন says:

    ভালো। তবে সেই প্রথার লেখা। পাঠকমজানো। লেখকের নিজের মজে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। ছোটোর আয়োজন বৃহতের সুদূর না-হলে প্রতিষ্ঠান-অপ্রিষ্ঠানের মধ্যে সীমারেখা থাকল কোথায়! মনি,সম্পাদক হিসেবে গদ্যেপদ্যে আরও নতুন সম্ভাবনার খোঁজ কর।চর্বিতচর্বণের এত পরিশ্রমের অর্থই।কোথায়! হয়তো সম্পাদক হিসেবে তোমার পরিচিতি বাড়বে। লেখা র আাদানপ্রদান হবে। পুরস্কার সম্বর্ধনা মঞ্চ উত্তরীয় টিনের অপূর্ব চৌকসে ভরে যাবে টেবিলসেল্ফআলমারি। তাতে নিজের ছাড়া আর কী কার থাকে। আমি তোমাদের নতুন কাজ প্রত্যাশা করেছিলাম বলেই এত কথা। ভালোবাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!