সন্দীপ রায় নীল
বৃষ্টি ভেজা স্বপ্ন
কর্পোরেট অফিসের তিনতলার ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিল পিয়াস। টিপ টা কখন যে খুলে পড়ে গেছে কে জানে! ব্যাগের মধ্যে থেকে আর একটা ডার্কগ্রীন কালারের টিপ বের করে লাগিয়ে নিল কপালে। টিপ ছাড়া এখন তাকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ দেখায়!চিরকালই কনটেম্পোরারি ফ্রেমে বন্দী থাকত তার চোখদুটো। ভাবত বোধহয় টিপটা এর সাথে ঠিক যায় না। কিন্তু অরণ্য বলার পর এখন টিপ না পরলে তার নিজেরই কিরকম একটা অস্বস্তি লাগে।
বহুদিন বাদে বর্ষা নামলো। আজ সকাল থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বৃষ্টি পড়লে মনটা বেশ অদ্ভুত একটা আনন্দে ভরে ওঠে পিয়াসের।করিডোরের জানালার কাঁচের শার্সি ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে। কাজের ফাঁকে বার বারই চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে। ইশ্! এইসময়ে যদি এককাপ কফি আর একটা প্রিয় কবিতার বই নিয়ে বসা যেত!! কিন্তু সে উপায় কোথায়? কাজের যা প্রেসার!!.. এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! তারাই বুঝবে- যারা পিয়াসের মত বৃষ্টি আর কবিতা ভালোবাসে,ভালোবাসে বৃষ্টিফোঁটার মাদকতা প্রতিটি রোমকূপে অনুভব করতে, ঠিক যেমন অরণ্য। গত দুদিন হলো, অরণ্য জ্বরে ভুগছে। অফিসে আসতেও পারছেনা।ফোনে পায়নি,একটু টেনশন হচ্ছিল।শেষপর্যন্ত অফিসের মেইলে খবরটা পেয়েছে। ও না এলে আজকাল ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার।একবছর হলো এই অফিসে জয়েন করেছে অরণ্য। সেই প্রথম দিন থেকেই পিয়াসের সাথে তার বন্ধুত্বের সূত্রপাত। পিয়াসের প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো এই কোম্পানীতে।
একইরকম মানসিকতার মানুষদের মধ্যে, বিনি সুতোয় গাঁথা একটা সম্পর্ক যেন আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। অরণ্যের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই পিয়াস সেটা যথেষ্ট টের পেয়েছে। অরণ্য ঠিক তারই মত স্বল্পভাষী, বাই হার্ট কবিতা প্রেমিক , কাজের ফাঁক পেলেই গান শোনে….। গুনগুন করে ঠিক সেইসব গান-যে গুলো পিয়াসেরও পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে। অদ্ভুত একটা মিল দুজনের রুচিবোধে। রোজ অফিস থেকে বেরোবার আগে কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে বসে একসাথে সময় কাটিয়ে তারপর যে যার মতো বাড়ি ফেরে ওরা। দুদিন ধরে অরণ্য না আসায় মন মেজাজ ঠিক ভালো নেই পিয়াসের। তার ওপরে আজ এত ভালো ওয়েদার.. কত ভালোই না হত, যদি আজ অফিসের শেষে অরণ্যের সাথে একটু সময় কাটানো যেত! বন্ধুত্বের বাইরেও ওর প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করে পিয়াস। কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত কোনওদিন প্রকাশ করেনি সে। কে জানে, অরণ্যের মনে তার জন্যে আদৌ সেরকম কোনোও জায়গা আছে কিনা! পিয়াস নিজের সমস্ত আবেগ নিজের মনের গভীর অন্ধকারেই লুকিয়ে রেখেছে। কাউকে জানায়নি । মা কেও না। কেমন একটা কুন্ঠাবোধ কাজ করে মনের ভেতর।তবুও কেমন যেন ভীষণরকম অস্থির লাগে মাঝেমধ্যেই।
অরণ্য তার থেকে বছর তিনেকের ছোট। দেখতেও বেশ ভালো। ফর্সা,লম্বা… এককথায় বেশ সুদর্শন। চেহারার দিক থেকে সে-ও অতটা খারাপ নয়,অন্তত আত্মীয় স্বজনেরা আর অফিস কোলিগদের সেটাই মত,তবে রংটা একটু চাপা। তবুও তার মা কে বেশ কিছুদিন ধরে শুনে আসতে হচ্ছে– “এই মেয়ে কে তাড়াতাড়ি পার করে দাও গো সুতপা,নাহলে…?”.. খুব রাগ ধরতো ওর।‘পার করা’ মানে টা কি? সেকি অক্ষম নাকি যে তাকে পার করতে হবে। পিয়াসের মা সুতপাদেবী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। বাবা মারা গেছেন বারো বছর আগে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে জয়েন করার কয়েক সপ্তাহ পরেই তার ছোটমামা একজন সুপাত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন সুতপাদেবীকে। সেই পাত্রপক্ষ একদিন দল বেঁধে পিয়াসকে দেখতেও আসে। মেয়েকে সামান্য চাপা রংকেও যতটা সম্ভব সুন্দর করে তোলা যায় – সে ব্যাপারে সেদিন চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি তার বাড়ির লোক। কাকিমা তিন চারটে বাছাই করা শাড়ি নিয়ে এসে তার গায়ে ফেলে পরখ করে দেখছিল- কোন রঙটায় আরও একটু উজ্জ্বল দেখাতে পারে তাকে। পিসি নিয়ে এসেছিল বেশ নামী দামী ব্র্যান্ডের বহুমূল্যবান সব প্রসাধনী। পাশের বাড়ির জেঠিমা খুব ভালো সাজাতে পারেন। তিনিও সেদিন সুতপাদেবীর অনুরোধে এসে নিজের সমস্ত পারদর্শিতা উজাড় করে দিয়েছিলেন পিয়াসকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টায়। কিন্তু এতসব কিছু সত্ত্বেও, সেদিন তাকে দেখামাত্রই ভ্রু কুঁচকেছিলেন পাত্রের মা। খুব রুক্ষ গলায় বলেছিলেন সুতপাদেবীকে- “ছবি যেটা পাঠিয়েছিলেন, তাতে তো গায়ের রঙ টা বোঝা যায়নি!!আমি আমার ছেলের জন্য ফর্সা সুন্দরী বউই আনব।”
নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল শ্রেয়ার সেদিন। সে কি এতটাই ফালতু আর সস্তা? শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য্য আর শরীরী রংই কি একজনের যোগ্যতার মাপকাঠি ? পিয়াসের শিক্ষা, রুচি, স্বভাব – এসবের কোনও দাম নেই এদের কাছে? সেদিনই মা কে জানিয়ে দিয়েছিল …. আর কোনওদিন ওভাবে সেজেগুজে কারোর সামনে নিজেকে এক্সহিবিট করবে না সে। দরকার নেই তার বিয়ের পিড়িতে বসবার। সুতপাদেবী যদিও অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন মেয়েকে… কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। হাজার বোঝানো সত্ত্বেও কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে লেশমাত্র বিচ্যুত করা যায়নি পিয়াসকে। বয়স বাড়তে বাড়তে এখন একতিরিশে পা দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর… অরণ্যও কি আর পাঁচজনের মত ওকে শুধুমাত্র বাইরের রূপ-রংটা দেখেই বিচার করবে? ওকে দেখে তো সেরকম মনে হয়না.. আর অরণ্য যদি ওকে পছন্দ করেও- ওর বাবা মা? ওনারা কি মেনে নেবেন পিয়াসকে? বেশ কিছুদিন ধরে এসব নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। তবে আস্তে আস্তে প্রস্তুত হচ্ছে সে। আর দেরি নয়। এবার ও বলেই ফেলবে অরণ্যকে সবকিছু,তার নিভৃত মনের অন্তরালে ক্রমশ জন্ম নেওয়া এক অপূর্ণতা মাখা স্বপ্ন। সমস্ত কুন্ঠাবোধ এবার কাটিয়ে উঠতে হবে।
… অনেকক্ষণ ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আজ আর বাসের জন্যে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছেনা । এসময়টা বেশ ভিড় থাকে বাসে। চটপট একটা শেয়ার ক্যাব বুক করে নিল পিয়াস। সেক্টর ফাইভ থেকে বারাসাত যাবে সে। ওঠার সময় গাড়িটিকে খালিই পেল সে। বন্ধ গাড়ির ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। বৃষ্টির অঝোর ধারাগুলো ক্যাবের জানালায় আছড়ে পড়ছে, প্রানপনে আঁকড়ে ধরতে চাইছে কাঁচটা কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে বড্ড অসহায়তায়। এসব ভাবতে ভাবতে কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছিল সে।
হঠাৎ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার কল করলো অন্য এক সহযাত্রীকে- “আপনার লোকেশনে দাঁড়িয়ে আছি স্যার।” কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষার পরে একটা ছাতা মাথায় দুই যুবক-যুবতীকে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মেয়েটা এসে পিছনের সিটে পিয়াসের পাশে বসলো। ছেলেটি বসলো সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটটাতে।
“সেই ভিজিয়েই ছাড়লে তো আমাকে? বার বার বলেছিলাম আর একটা ছাতা নাও…”
-মেয়েটা আবেগী স্বরে বললো বসার পর। ছেলেটা কিছু উত্তর দেওয়ার জন্যে ঘাড় ঘোরাতেই দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো পিয়াসের সাথে। আরে, এ যে অরণ্য! গাড়ির ভেতর প্রায়ান্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হলোনা…পিয়াসের।
-“একি তুমি? আজ ক্যাবে বাড়ি ফিরছো?”
পুরো ব্যাপারটায় কেমন যেন হকচকিয়ে গেল পিয়াস। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।কোনওভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো…
-“আসলে আজ এত বৃষ্টি হচ্ছে তাই আর কি… কিন্তু তুমি এখানে কোথায়…..?”
-“বলছি। সব বলছি,তবে তার আগে আলাপ করিয়ে দিই। মহুল – আমার ফিয়ন্সে, জামশেদপুরে থাকে ..এখানে এসেছে একটা ইন্টারভিউ এর জন্যে …তোমাকে বলবো বলবো করেও বলা হয়নি ওর কথা…..”
কথার মাঝখানেই অরণ্যকে থামিয়ে বলে উঠলো মেয়েটা- “আর তুমি হলে পিয়াস দি…. তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে হেসে অরণ্যের দিকে তাকালো পিয়াস। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে একটু ঠাট্টামিশ্রিত ভঙ্গিতে বললো-“কি ব্যাপার? তোমার নাকি জ্বর?”
পিয়াসের কথায় চোখ টিপে হেসে অরণ্য কৌতুকপূর্ণ স্বরে বললো- “ওসব গ্যাটিস না দিলে ওই কুমড়োপটাশ বস ছুটি দেবে? আগামীকাল জয়েন করবো..”
বৃষ্টিটা আজ থামছেই না একেবারে। বেগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গাড়িও এগিয়ে চলেছে।
“তুমি এখানে কতদিন আছ?” – ফের মহুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো পিয়াস।
– “এই উইকটা থাকবো। এখানে কৈখালিতে আমার মাসির বাড়ি। ওখানেই আছি এখন.. দেখি এই জব টা যদি পেয়ে যাই, তাহলে তো….”
-“এই আর একটু এগিয়ে নামবো দাদা..বাঁদিকে দাঁড়াবেন”- ড্রাইভারকে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি থামাতে বলে পিয়াসের দিকে ঘুরে তাকালো অরণ্য। -“চলি গো পিয়াস.. ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আর,কাল দেখা হচ্ছে অফিসে।”
দুজনেই নেমে গেল গাড়ি থেকে। পিয়াস অত্যন্ত সাবলীলভাবে ওদের বিদায় জানালো। বৃষ্টিটা আরও জোরে এলো যেন। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আর একটা অদ্ভুত রকমের কষ্ট বেরিয়ে এলো পিয়াসের। এক মুহূর্তের মধ্যে তার স্বপ্নকে খুন হতে দেখল সে।বুকের ভেতর তীব্র কষ্ট হচ্ছে। তবে, বেশ মিষ্টি দেখতে মহুলকে। ভালো মানাবে ওদের। ফোনটা ভাইব্রেট করছে ব্যাগের ভেতর। মায়ের ফোন। কলটা রিসিভ করে ক্লান্ত গলায় বললো-“আমি ক্যাবে ফিরছি মা, বাড়ির সামনেই নামবো। চিন্তা কোরো না।”
শহরের কোলাহলের সাথে বৃষ্টির শব্দ মিশে একাকার হয়ে কিরকম একটা মনখারাপের আবরণ তৈরি করছে চারপাশে। এখন যেন বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে খুবই অসহ্য লাগছে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।রুমালটা নিয়ে চোখ ঢাকলো পিয়াস। গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে।অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা চোখের জল হঠাৎ নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিলো রুমালটাকে…..। ড্রাইভারের ফোনে ঠিক তখনই বেজে উঠল—
“…কিসমতে বানানো তোর লেখা
আমিও ভুল করে কাটাকুটি খেলায়,
তোর কিছু সাজানো নাম ধরে,
আমিও ভুল করে—-
ডেকেছি,শেষ বে…..লা…..য়……”।।