বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম
পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গে জন্মানো এবং কলকাতায় পড়াশোনা করা বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম সারির সাতজন পদার্থ বিজ্ঞানীর নাম বলতে হলে তার মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হবে। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “সে সেরা। আমি তার কাছে কিছুই না।” আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণমান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখা “কৃষ্ণবিবর”, “দ্য আল্টিমেট ফেইট অব ইউভার্স”, “রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি”- বইগুলো অক্সফোর্ড কেমব্রিজ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ উন্নতবিশ্বের আরও শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। কিন্তু আফসোসের কথা, যে দেশে তিনি জন্মেছিলেন, যেখানে তাঁর পড়াশোনার ভিত্তি তৈরী হয়েছিল সেই ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁকে নিয়ে সেভাবে কোনো আলোচনাই চোখে পড়ে না।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেও এক অতি পরিচিত নাম। ১৯৮৮ সালে তাঁর লেখা “আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” বইটি এক কোটি কপিরও বেশী বিক্রি হয়েছে সারাবিশ্বে। কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে, এই বইটি প্রকাশের প্রায় ৫ বছর আগেই ১৯৮৩ সালে জামাল নজরুল ইসলাম “দ্যা আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স” নামে একটি বই লিখেছিলেন এবং দুটি বইয়ের বিষয়বস্তু প্রায় একই। বলা যায়, হকিং এর বইয়ের ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিলেন জামাল স্যারের এই বই।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং
জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বঙ্গের ঝিনাইদহে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সাব–জজ। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায়। দেশ ভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজে। সেখান থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করে আবার ফিরে আসেন কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি এস সি পাস করেন। তারপর ১৯৫৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি এস সি ও এম এস সি পাস করেন। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পি এইচ ডি সম্পন্ন করে তিনি যোগ দেন সেখানকার ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এ সময় তাঁর গবেষণার বন্ধু ছিলেন স্টিফেন হকিং। এরপর তিনি যোগ দেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ‘ক্যালটেক’-এ। সেখানে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ক্যালটেকের পর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। ১৯৭৩ সালে লন্ডনে ফিরে যোগ দেন কিংস কলেজে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। বিজ্ঞানী আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত ইতালির ‘ইন্টারন্যাশনাল থিওরিটিক্যাল ফিজিকস সেন্টারে’ তিনি ফেলো হিসাবে যোগ দেন। এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে তিনি অধ্যাপনা করেন।
বিশ্বের বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও অধ্যাপনার কাজে যুক্ত থাকলেও তাঁর ভিতরে এক অসম্ভব মাটির টান রয়ে গিয়েছিল। সেই টানেই ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ১৯৮৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছিলেন আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র। প্রফেসর আবদুস সালাম এই গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন।
২০১৩ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার নানা কাজে ব্যপৃত ছিলেন। মহান এই বাঙালি বিজ্ঞানীকে আমরা ক’জনই বা মনে রাখি!
তথ্য ঋণ: মহাকাশের যত কথা