পাপিয়া অধিকারির অনুগল্প: বোধন - শৃণ্বন্তু পাপিয়া অধিকারির অনুগল্প: বোধন - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০২ পূর্বাহ্ন

পাপিয়া অধিকারির অনুগল্প: বোধন

আপডেট করা হয়েছে : সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৩:৩৪ পূর্বাহ্ন
পাপিয়া অধিকারির অনুগল্প: বোধন

অনুগল্প: বোধন

পাপিয়া অধিকারী

 

  এবার শরতের শুরু থেকেই বেশ কুয়াশা মাখা শীত শীত ভাব। আষাঢ় শ্রাবণ বেশ উদার হাতেই প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে স্নিগ্ধ সজীবতায় ভরিয়েছে। চারিদিকেই পান্না রঙের ঘনিয়ে ওঠা অবকাশ। তবু, কাছ থেকে দূরে, কোলাহল থেকে নির্জনতায় এমন এক বিষাদ বিরাজ করছে যা থেকে মন সহসা মুক্তি পায় না। 

  ভোরের এই সময়টাতেই পরা, রাতের দলবদ্ধ পালা জাগরণ শেষে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে। চোখে ঘুম ছেয়ে আসতে চাইলেও ভোরের শান্ত সৌন্দর্যকে তার দু চোখ ফেরাতে পারে না। চারপাশের সবুজেরা পরার মনেও একটু সবুজ রং ভরে দেয়। তবু সাইকেলের প্যাডেলে জোরে চাপ দেয় সে। 

  হঠাৎই শিউলি তলায় ঘাসের উপর চোখ আটকে গেলো, লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে শুয়ে থাকা বৃদ্ধাটিকে দেখতে পেলো পরা। যেন কুয়াশা মাখা সদ্য গাছ বিচ্যুত এক শিউলি। সাইকেল থামিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সে। ঘুমোচ্ছেন। কপালে হাত রাখতেই যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এলেন। উঠে বসে পরার সরল আয়ত চোখদুটিকে একবার ছুঁয়ে নির্বাক চেয়ে রইলেন দূরে।  বৃদ্ধাটিকে ভালো করে দেখল পরা। অজস্র বলিরেখায় লুকোনো ঈষৎ রক্তাম্বর ওষ্ঠাধর। কুঞ্চিত কপালে কতোকালের কতো রহস্য ঢেকে বড়ো গোলাকার রক্তিম এক টিপ । শুভ্রকেশ সীমন্তে ঈষৎ গৈরিক বর্ণ সিঁদুরের সমুজ্জ্বল আভা শরত-শিউলির সৌন্দর্য মণ্ডিত। দু চোখের দৃষ্টিতে প্রতিবিম্বিত হয় গভীর উদ্বিগ্নতা । ব্যথাতুর দৃষ্টি দূরে সীমানাহীনতায় বিলুপ্ত । শিরা সজ্জিত দুটি পরম মমতার হাতে ধরা একটি ছোটো কাপড়ের পুঁটুলি। 

  “কে তুমি বুড়ি মা ? ” – নিস্তব্ধতা ভাঙলো পরা। যেন শুনতেই পেলেন না। উত্তর না দিয়েই বৃদ্ধা পরাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “কী নাম মা তোমার ?” পরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতেই উত্তর দিলো – “পরা, মানে পারভীন”। মৃদু মন্ত্রোচ্চারণের মতোই আবার পরার কানে ভেসে এলো – “এই এতো সকালে ঘুম ভাঙালে আমার, কী করো এতো সকালে ?” কৌতূহলী পরা বললো,”বাড়ী ফিরছিলাম। আমরা পালা করে রাত জাগি। অনেকগুলো দল আছে আমাদের,  সারা গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।” এবার বৃদ্ধা পরার চোখের দিকে চাইলেন। পরার মনে হলো কী যেন আছে ওই দুটি চোখে,  বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুঝি জ্ঞান হারাবে। বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন,”দল ! কীসের ?” বছর আঠারোর পরা আবিষ্টস্বরে উত্তর দেয়, “আলো দেখানোর দল। স্কুলের বড়দি বলেন, রাতের গভীরে অন্ধকারে আকাশের তারারা ফুটে ওঠে । আমাদের আলো দেখায়।  কখনও কোনো তারা যদি পথ ভুলে যায় , খসে পড়ে, তাদেরও আলো দেখাতে হয় যাতে তারা মাটিতে নিরাপদে নেমে আসার পথ খুঁজে পায়। কেউ যেন… ” বলেই পরার ঠোঁট দুটি কেঁপে ওঠে। বৃদ্ধাও যেন ঈষৎ  বিচলিত । নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জোর করে পরা বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করে,”এবার তুমি বলোতো বুড়ি মা, তুমি কে? এখানে এলেই বা কীভাবে?” এবার বৃদ্ধা মুখ নামিয়ে নিলেন। তারপর হঠাৎ তর্জনী তুলে পিছনের দিকে নির্দেশ করে বলেন, “ঐ যে কাল রাতে আলোর মিছিল.. “।  “ও, বুঝেছি। এবার তুমি এসো তো আমার সঙ্গে।  সারারাত এই ঠান্ডায়… ” বলে পরা দু হাত দিয়ে বৃদ্ধাকে শিউলি তলা থেকে ওঠানোর চেষ্টা করতেই বৃদ্ধা পরার হাত দুটি চেপে ধরে বলে ওঠেন, ” আমাকে ক্ষমা কোরো মা ।” পরা অবাক বিমূঢ় তাকিয়ে থাকে। সজল চোখে বৃদ্ধা বলে চলেন, “এই পায়ের তলার মাটিটাকে তোমাদের বাসযোগ্য করতে পারলাম কোথায় ? জানি না আরও কতো সময় লাগবে ! সে সময়ের মধ্যে আরও কতো আলোর মিছিল…  ” আর বলতে পারলেন না বৃদ্ধা। মুখ নিচু করলেন। 

  কয়েকটি মুহূর্ত নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে রইলো। এবার বৃদ্ধা তার হাতের পুঁটুলিটি পরার হাতে গুঁজে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,”এটা তুমি রাখো। তোমরাই এর সম্মান রাখতে পারবে। আমি জানি।” পরা অবাক গলায় অস্ফুটে বলে উঠলো, “কী এটা ?” বৃদ্ধা কোনো উত্তর দিলেন না। পরা ধীরে ধীরে পুঁটুলিটি খোলে। দেখে অদ্ভুত উজ্জ্বল নীল বর্ণের সতেজ একমুঠো অপরাজিতা ফুল পরম যত্নে কাপড়ে জড়ানো। 

    দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ, কাঁসরের ধ্বনি।  ভোরের কুয়াশা ছিঁড়ে সবে মাত্র মাটিতে পা রেখেছে সূর্যরশ্মি।  পরার চোখ আর্দ্র , ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। কম্পিত গলায় পরা জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি বুড়ি মা, বলবে না আমাকে ?” ক্ষণিক থেমে এবার বৃদ্ধা ধীর দৃঢ়কন্ঠে বললেন, “আমি বসুন্ধরা । আজ মহাষষ্ঠী, মর্ত্যে দেবীর বোধন।” বলে পরার উদ্দেশ্যে  দুটি হাত জড়ো করে কপালে ঠেকালেন। 

[সমাপ্ত]


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!