শেক্সপিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবি —- এর চেয়ে ক্লিশে-ক্লীষ্ট বাক্য বাঙলায় কেন, আজকের দিনে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষাগুলোর কোনটাতেই শোনা বা দেখা যাবে না। কিন্তু গত শতাব্দীর ১৯০৬ সালে এই ধারণাকেই একেবারে ভুল বলেছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয়। তিনি লিখলেন: I remember the astonishment I felt when I fi rst read Shakespeare. I expected to receive a great esthetic pleasure, but on reading, one after another, the works regarded as his best, King Lear, Romeo and Juliet, Hamlet, and Macbeth, not only did I not experience pleasure but I felt an insuperable repulsion and tedium, and a doubt whether I lacked sense, since I considered works insignificant and simply bad, which are regarded as the summit of perfection by the whole educated world; or whether the importance that educated world attributed to Shakespeare’s works lacks sense. . . . I have again read the whole of Shakespeare . . . and have experienced the same feeling still more strongly, no longer with perplexity but with a firm indubitable conviction that the undisputed fame Shakespeare enjoys as a great genius . . . is a great evil—as every falsehood is. প্রথমবার শেক্সপিয়ার পড়ে তার বিরক্তি ও বিরাগ জন্মেছিল। তিনি বুঝতে পারেননি কেন শিক্ষিত সমাজ শেক্সপিয়ারকে এত গুরুত্ব দেয়, এও মনে হয়েছিল তাঁর যে এইসব শিক্ষিত মানুষদের জ্ঞানগম্যি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। এর পরেও পরবর্তী জীবনেও তিনি পুরো শেক্সপিয়ার পুনরায় পড়ে ছিলেন এবং এবারে তিনি আরো কঠিন কথা শেক্সপিয়ারের নাটক সম্পর্কে করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, শেক্সপিয়ারের প্রতিভার খ্যাতি ” … is a great evil —- as every falsehood is. ” কে বলবে, কেন টলস্টয়ের শেক্সপিয়ার পড়ে তাঁর প্রতিভাটাকেই ‘ ঈভিল ‘ মনে হয়েছিল? শোনা যায়, দুই সমান ক্ষমতাধর শিল্পীর মধ্যে নাকি তীব্র পারস্পরিক ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতা থাকে। কিন্তু সেটা এই পর্যায়ে যেতে পারে? শেক্সপিয়ারের প্রতি টলষ্টয়ের এমন মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করে ছিলেন জর্জ অরওয়েল। এসব সত্বেও কিন্তু জগৎ টলষ্টয়ের সুরে সুর মেলায় নি, যেটার একটা ছোট প্রমান পাওয়া যায় বি বি সি ‘র একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে। সেই সমীক্ষা বলছে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম দশজন সেরা ব্রিটনদের মধ্যে শেক্সপিয়ার ও ডারউইন আছেন। শেক্সপিয়ার পন্ডিতদের মধ্যে সম্ভবতঃ এখন আর কোন দ্বৈমত্য নেই যে শেক্সপিয়ার এখনো বিশ্বের এক নম্বর নাট্যকার।
অথচ শেক্সপিয়ারকে অপছন্দ করার ব্যাপারে টলষ্টয় একাই কি দায়ী? এনিয়ে আরেকজনের একটি করুণ কাহিনীর উল্লেখ করব। সে কাহিনীর নায়ক চার্লস ডারউইন। ১৮৮২ সালে তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮১ সালে ডারউইন ছোটবেলা থেকেই তাঁর গভীর সাহিত্য প্রেমের কথা বর্ণনা করেছেন, তাঁর গভীর শেক্সপিয়ার অনুরাগের কথা বলেছেন। আর তারপরেই বলছেন সেই মর্মান্তিক কথাগুলো: But now for many years I cannot endure to read a line of poetry: I have tried lately to read Shakespeare, and found it so intolerably dull that it nauseated me. I have also almost lost any taste for pictures or music.” তাঁর ভেতরে এলো সে এক মর্মন্তুদ রূপান্তর যখন তিনি আর এক লাইন কবিতা পড়া সহ্য করতে পারেন না; বলছেন তিনি, সম্প্রতি আমি শেক্সপিয়ার পড়ার চেষ্টা করলাম, দেখলাম শেক্সপিয়ার কীরকম অসহ্যরকমের একঘেয়ে, নীরস ও নিরানন্দ ( dull ) ,এতটাই যে আমার বমিবমি ভাব লাগলো। ছবি ও সঙ্গীত সবকিছুতেই আমার প্রায় আর কোন আগ্রহই নেই। ডারউইন তাঁর এই সাহিত্য রুচি হারিয়ে ফেলা নিয়ে বেশ গভীরভাবে ভেবেছেন। সেই ভাবনা থেকে উঠে আসা কিছু কথার দিকে তাকালে মানুষটার নিদারুণ কষ্টটা একটু অনুভব করা যায়। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হলো সেই ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে ডারউইন এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক মনে হয়, যদিও সেই প্রাসঙ্গিকতার ধার ও ভার আজকে আর হয়তো ততটা জোড়ালো নয়। ডারউইন বলছেন , প্রচুর তথ্যের ভাঁড়ার থেকে সাধারণ সূত্র বার করার এক যন্ত্র হয়ে গেছে আমার মনটা। কিন্তু আমি ভেবে উঠতে পারছি না যে তাতে মনের যে অংশের ওপর আমাদের উচ্চ রুচি ( কাব্য রুচি, সাহিত্য রুচি, সঙ্গীত রুচি, নাট্য রুচি ইত্যাদি) নির্ভর করে সেই অংশটা শুকিয়ে গেল কি করে…”। এই ভাবনার শেষের দিকে তিনি বলছেন, ” আমাদের স্বভাবের এই আবেগের দিকটা এমনভাবে দুর্বল হয়ে গেলে সেটা আমাদের বুদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর হবে, আমাদের নৈতিক চরিত্রের পক্ষে ক্ষতিকর হবে, এবং এর ফলে আমরা আমাদের সব সুখকে হারিয়ে ফেলব । ” যদিও ডারউইন এখানে তাঁর মাতৃভাষার শব্দ ‘ Happiness ‘ ব্যবহার করেছেন কিন্তু আমার মনে হয় এই ‘ হ্যাপিনেস ‘ ঠিক আমরা সুখ বলতে যা বুঝি সেটা নয়। এই Happiness এ্যারিষ্টটলের ‘ Eudaimonia ‘ ।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তায় এই চিন্তাই বিচিত্রভাবে এসেছে, বিবেকানন্দের চিন্তাতেও এমন মনোভাবের যাতায়াত এসেছে, তবুও ‘ সায়েন্স ও আর্ট ‘ এর ভেতর কোনটা শ্রেষ্ঠ এই প্রতিযোগিতায় আমরা অনেকদিন ভুগেছি। এই রোগের প্রকোপ আগের মতো আর না থাকলেও একেবারে উবে গেছে কি?