তৃতীয়
পর্ব
)সদ্য প্রস্ফুটিত সূর্যের গোলাপি আভা গায়ে মেখে দিগন্তবিস্তৃত বনরাজি খিলখিল করে হাসছে , ভেসে আসছে পাখপাখালির শ্রুতিমধুর কলতান। একটু একটু করে জাগছে পৃথিবী। মন ভালো রাখার সবরকম উপাদান হাতের কাছে মজুত। অথচ একরাশ হতাশা আর আনলিমিটেড টেনশন মাথায় নিয়ে বিছানায় উঠে বসল আকাশ। অজানা একটা আশংকা উৎকন্ঠার রূপ ধারণ করে ক্রমশ মস্তিষ্কে চেপে বসতে চাইছে। বিশেষ করে আননোন নম্বর থেকে আসা ফোন কলটা….!
ওপারের লোকটা ফোন কেটে দিলে পরে দেবু এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ঘটনার অভিঘাতে আকাশের তখন ভূমি নেয়ার অবস্থা। আমজাদও কম অবাক হয়নি। প্রথমত কারও মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না।
কিছুক্ষণ বাদে সামলে উঠে আকাশ বলল, ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছে আগে থেকেই ওরা আমাকে ফলো করে আসছে। কিন্তু দেবুর ফোন নম্বর? এখানে আসার কথা কাউকে বলিনি আমি। তোরাও নিশ্চয় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করিসনি?
আমজাদ চুপ করে ওদের কথা শুনছিল। সে এবার মুখ খুলল, আমার ধারণা তোর মোবাইল ওদের শক্তি বাড়িয়েছে।
আমজাদ দুম করে থেমে গেলে আকাশ তাড়া দিল, কী ভাবছিস তুই?
আমজাদের কথাবার্তা শুনে আকাশের মাথায় চিন্তার জট তৈরি হয়। চট করে সে কোন কথা বলতে পারে না।
দেবু বলল, আমাদের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। সকাল সকাল এখান থেকে পালিয়ে চল।
চট করে উত্তর দিল না আকাশ। একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বলল, এখানে আসা ইস্তক তেমন ইচ্ছা ছিল না, জাস্ট দূর থেকে মুখ দর্শন করে ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন তাকে নিয়ে এতো ঘটনা ঘটে গেল….
কথা শুনে দেবু হাঁ করে স্তব্ধ হয়ে যায়। আমজাদ সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলে না। একটু বাদে সে বলল, তথাস্তু। আই সাপোর্ট য়ু।
প্রপোজ করব বললেই তো আর করা যায় না। তার আগে রোজকে খুঁজে পেতে হবে। মোবাইল না থাকায় জানা যায়নি সে আদৌ বাংলোয় এসে পৌঁছেছে কিনা। এসে থাকলে, কত নম্বর রুমে আছে? সর্বোপরি হবু বরের লোকজন তাকে পাহারায় রেখেছে কিনা তাও জানা দরকার।
রুম একটা, খাট তিনখানা। দেবু-আমজাদ নিজের নিজের খাটে ঘুমিয়ে। তাদের জাগিয়ে তুলল আকাশ। তারপর আর কি? চটপট তৈরি হয়ে নীচে নেমে এল তিনজনে। প্রথম কাজ পেটে কিছু দেওয়া, তারপর মিশন ফরেস্ট বাংলো।
গ্রাউণ্ড ফ্লোরে এসে থমকে দাঁড়াল আকাশ। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমাজাদের পাঁজরের খাঁচায় গুঁতো দিয়ে বলল, রিসেপশনের দিকে তাকা।
আমজাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে আকাশ বলল, তাছাড়া আর কী কাজ থাকতে পারে ওর এখানে? নিশ্চয় রোজের খবর নিয়ে এসেছে।
আকাশের যেন তর সইছে না। কথা বলতে বলতে সে অনেকটা এগিয়ে গেছে রিসেপশনের দিকে। আমজাদ দ্রুত তার কাছে গিয়ে ফিসফিস ফিসফিস করে বলল, বি কেয়ারফুল। সাবধানে কথা বলবি। একদম হঠকারিতা করা চলবে না।
আমজাদের সব কথা শুনতে পেল কিনা সেই জানে। দু-লাফে রিসেপশন কাউন্টারের সম্মুখে পৌঁছে পিছন থেকে সাড়া দিল, গুড মর্নিং মিস।
উত্তরে মুখে কিছু না বলে হাসি দিল আকাশ। মেয়েটিও হাসল। ততক্ষণে দেবুরা পৌঁছে গেছে। তাদের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় হল। তারপর আকাশ ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমন্ত্রণ জানালে মেয়েটি বলল, আমি খেয়ে এসেছি। আপনারা খেয়ে নিন, আমি এখানে অপেক্ষা করছি।
আর আপত্তি করল না সে। দেবুর পাশে, আকাশের মুখোমুখি বসল। আকাশ-রা নিল স্নাক্স-কফি। সে শুধু কফি।
কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল মেয়েটি। কাপটা আস্তে করে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে রাগ-অভিমান ইত্যাদি মিশিয়ে কেমন যেন একটা আলাদা বার্তা লুকিয়ে আছে। পাঠোদ্ধার করতে পারল না আকাশ। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলল, জানেন গতকাল বাসে আমার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে।
হঠাৎ কেন সে রেগে গেল ঠাওর করতে পারল না আকাশ। হতভম্ব হয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাল। আমজাদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইশারা করে, সে কিছু বোঝেনি। দেবু এক কামড় টোস্ট মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে গুঁইগাঁই করে কী বলল বোঝা গেল না।
আকাশ তার ইঙ্গিত ধরতে পারেনি, নাকি সে ঘটনার অভিঘাতে হতবিহ্বল? ঘোর লাগা রুগীর মতো মেয়েটির চলার পানে তাকিয়ে বসে আছে। আমজাদ ধাক্কা দিয়ে বলল, ইডিয়েট রোজ পালাচ্ছে, থামা ওকে।
চমক দিয়ে ঘোর কাটে আকাশের। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ঝড়ের বেগে দারজার দিকে ধাবিত হল। – রোজ রোজ। প্লিজ দাঁড়াও।
ডাইনিং-এ খুব একটা ভিড় নেই। যে কজন উপস্থিত আছে তারা প্রাতরাশের সঙ্গে তারিয়ে তারিয়ে ঘটনার রস আস্বাদন করছে।
একটি বামা কন্ঠের আক্ষেপ শোনা গেল, আহা বেচারা! নিজের গার্লফ্রেণ্ডকে চেনে না।
কোণের দিকে টেবিলে এক বয়স্ক দম্পতি বসেছেন। বুড়ি ফোকলা মাড়ি বের করে ফিকফিক করে হাসছেন। কর্তা বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করলেন, ডিসগাস্টিং।
ততক্ষণে রোজ রিসেপশন কাউন্টার অতিক্রম করে গেছে। আকাশ গতি বাড়িয়ে ডাইনিং স্পেসের বাইরে পা দেওয়া মাত্র পথ আগলে দাঁড়াল গতরাতের সেই ছেলেটি। চকিতে আকাশের কানপাটিতে রিভলবার চেপে ধরে হিসহিস করে বলল, তোমাকে না বারণ করেছিলাম ম্যামকে ডিস্টার্ব করতে।
থমকে দাঁড়াল আকাশ। পরক্ষণে ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা। আকাশ দু-পা ফাঁক করে মাটিতে বসে পড়ে ঘুঁষি চালিয়ে দিল ছেলেটির দুই জঙ্ঘার মধ্যবর্তী স্থানে। বেচারা! সেকি আর জানতো আকাশ ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট? সেকেণ্ডের ভগ্নাংশে অঙ্গ সঞ্চালনা করতে সক্ষম, শরীরটাকে কাগজের মতো দুমড়েমুচড়ে মণ্ড বানাতে পারে।
হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় প্রতি আক্রমণের প্রত্যাশা ছিল না তার। তারওপর সেনসিটিভ অঙ্গে আঘাত। বিনা মেঘে বজ্রাঘাত আর কাকে বলে? অণ্ডকোষ আঁকড়ে ধরে লুটিয়ে পড়ল সে। হাত থেকে রিভলবার কখন ঝরে পড়েছে নিজেই জানে না।
অস্ত্রখানা কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আকাশ। ছেলেটির হা মুখে রিভলবারের নল ঠুসে দিয়ে বলল, য়ু বাস্টার্ড! এরপর যদি দেখি তুমি আমার পথ মাড়াতে চেষ্টা করেছ, রিভলবারের সব কটা দানা তোমার মগজে গেঁথে দেব।
ছেলেটি কোন উচ্চবাচ্য করল না। আকাশ রিভলবারের কোমড় ভেঙ্গে বুলেট কটা বের করে নিয়ে, অকেজো অস্ত্রখানা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে চলল রোজের পিছনে। – রোজ রোজ। দাঁড়াও প্লিজ।