কবি নজরুল ইসলাম ও তাঁর জীবন দর্শন:
কবি নজরুল ইসলাম ও তাঁর জীবন দর্শন:
পৃথিবীর ছত্রিশকোটি মানুষ যখন সাধারণ সরল পথে চলতে চলতে তাঁদের পর্যাপ্ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত নিয়ম, সংস্কার, ধর্মকে নিছক মনের সঙ্গে মিশিয়ে নিজস্ব যাপন ক্রিয়ার পথ ধরে হাঁটছেন নি:সীম প্রাগৈতিহাসিক অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও ভুল ধারণাগুলিকে বর্ম করে,ধর্মের নিগড়ে, সংস্কারের নিগড়ে বেঁধে ফেলেছেন,তখন কিছু কিছু অতিবোধ সম্পন্ন মানুষ সেই দড়ি ধরে টান দেন।আমরা তাঁদের বুদ্ধিমত্তাকে তারিফ করে মহামানব বলে থাকি।
বাংলাভাষার আদিকালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় আবিস্কৃত চর্যাচর্য বিনিশ্চয় থেকেই তার শুরু। যেখানে এক একজন নাথ সাধক এক একজন বিখ্যাত কবি। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক তাঁদের জ্ঞান সুধার মাধ্যমে বঙ্গের তথা ভারতের ধ্যান ধারণা কিছুটা হলেও পালটে ফেলেছেন।এই সাহিত্য সৃজনে বড় বড় মহীরুহের সঙ্গে কিছু কিছু কবিও তাঁদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।সাহিত্যের জগতে কবি কাজি নজরুল ইসলাম সেই রকম একজন মহাপ্রাণ।
কাজি নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার দরিদ্র, অশিক্ষিত হিন্দু প্রধান গ্রামের মুসলিম পাড়ায় ফকির আহমেদ ও জাহিদা খাতুনের পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।গ্রামের পাঠশালায় (মক্তব) নিম্ন প্রাইমারি পাশ করা বালক নজরুল মাত্র নয় বছর বয়সে পিতৃহারা হন। দরিদ্র পরিবারের অভাব মেটানোর জন্য মক্তবের শিক্ষকতা ও মাজারের খাদেম কে জীবিকা হিসেবে গ্রহন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে একটি রুটির কারখানায় কাজ নেন। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে জন্মগ্রহন করায় তাঁর মধ্যে সুফী ভাবনা, ইসলাম ধ্যান ধারণা, হিন্দু দেব দেবীর সামগ্রিক একটা প্রভাব পড়েছিল। ধর্মীয় সুফীবাদ, ঈশ্বরবাদ, ভক্তি রসতত্ত্বের সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর মনে ও জীবনে।ধর্মের পরিবেশে বড় হয়ে ওঠায় ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা পরিলক্ষিত হয়।তৎকালীন সমাজ বাস্তবতাও ছিল ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা যুক্ত। তাই তিনি সাহিত্য রচনায় সচেতন ভাবেই ধর্মীয় অনুসর্গ ব্যবহার করেছেন। নজরুল গবেষক হারুণ অল রসীদের মতে একদিকে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান, অপর দিকে ব্রতচারী হিন্দু, কালীর সাধক। কিন্তু সমস্ত ধ্যান ধারণার ঊর্ধে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানব প্রেমিক এবং সাম্যবাদী।
নজরুল তাঁর সামগ্রিক জীবনে মার্ক্সীয় চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন।যেখানে কালী নয়, রসুল নয়,মানুষই প্রধান হয়ে উঠেছে। সমাজে একশ্রেণি অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, অপর শ্রেণি চিরাচরিত শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই বৈষম্যই বিচলিত করেছিল তাঁকে। যার জন্যই কঠোর হয়েছিল তাঁর কলম।
নজলরুল যে ধর্মমত ও দর্শনে বিশ্বাস করতেন সেটি হল মানব ধর্ম। কারণ তাঁর ধর্মটি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যা ছিল বিশ্বজনীন, সর্বজনীন। সেখানে মানুষ ভাই ভাই। সকল সংকীর্ণতাকে বার বার কুঠারাঘাত করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন— “আমার ধর্ম যেন অন্য ধর্মকে আঘাত না করে,অন্যের মর্মবেদনার সৃষ্টি না করে।”
নজরুলের এই উপলব্ধ দর্শনই হিন্দু মুসলমান উভয়ের রক্তধারায় একসঙ্গে প্রবাহিত। যেখানে জাতির নামে বজ্জাতিও অসহনীয়। ধর্মই কেন মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করবে? এই ধর্ম এবং গোঁড়ামিই কবির অসহ্য ছিল। তিনি প্রতিটি ধর্মের মানুষকে নারায়ন বলে পুজো করেছেন। মানুষ যুগে যুগে মানুষেরই কল্যাণে অবতীর্ণ। কিন্তু মোল্লা, পুরুত নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থতায় মন্ত্রের অর্থ, আয়াতের অর্থ পালটে দেয়।
নজরুল ছিলেন দেশপ্রেমী। তিনি দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে নামাজ পড়া অপেক্ষা জিহাদকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। নজরুলের মতে নামাজ পাঠের মধ্যে মুক্তি নেই। পাপ করে নামাজ পড়লে বুঝি কৈফিয়ত তলব হয়?
নজরুল ছিলেন একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।ধর্মের মূলবাণীকেই মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য ভুল পথে চালিত করছে। মূর্খের দল সেই ভুল মতামতগুলি পড়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত। ভণ্ড এই মানুষেরা দাড়ি-টুপি-টিকির মধ্যে আলাদা আলাদা জাত বিভাজন করে বজ্জাতি করে চলেছে। এই বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে মানবতার আকাশে বাতাসে।
একেশ্বরবাদী নজরুল ঈশ্বরকে কোনো নির্দিষ্ট নামে চিহ্নিত করেননি।কারণ তিনি ঈশ্বর আল্লা, হরি, শিব, নারায়ন যে একই ঈশ্বরে লীন এই বিশ্বাস মনে প্রাণে লালন করতেন। তাই তাঁর মতে ধর্মের বিভাজন মানবতারই বিভাজন। জীবনে যতদিন তাঁর মস্তিষ্ক সচল ছিল, অন্যায় অবিচারকে ধ্বংস করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা চেয়েছেন।যেখানে যেখানে অন্যায় ঘটেছে রণতূর্য হাতে সেখানেই তিনি বিদ্রোহ করেছেন।বহুদিন জেল খেটেছেন। এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যখন তিনি কারাগারে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখলেন—
” আয় ছুটে আয় রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।”
নজরুল সুন্দরের পূজারী। প্রেমের পূজারী। ঈশ্বর তাঁর কাছে সুন্দর ও সত্য, আনন্দ স্বরূপ। কখন ও বেদনাঘন। অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন পরমাত্মার এই উপস্থিতি। এই ঈশ্বর ‘আহুরা মাজদা’ এবং অশুভ ‘আহরীন’ এই দুই এর যুদ্ধে তিনি শুভ’র প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেন যে আমরা বাইরের দৃষ্টিতে যাই অশুভ দেখি তার মধ্যেই মঙ্গলময় বিরাজমান। এই মঙ্গলময়ের অধিষ্ঠান মানুষের মধ্যেই।
নৈতিকতা মানুষের আচরণবিধি। ভাল-মন্দ, ন্যায়-নীতি, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি বিষয় সমূহের নির্দেশিকা হল নৈতিকতা যা সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,ধর্ম প্রভৃতির নিয়ন্তা। কল্যাণকর সমস্ত বিষয় সমূহই নৈতিকতার অঙ্গ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে যাবতীয় হিংসা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত,যুদ্ধ, ক্ষুধা, দারিদ্র, মহামারি, হানাহানি দূর করে সকল ধর্মের সহাবস্থানের মাধ্যমে এবং শোষক শোষিতের বহির্ভূতসমাজ কেন্দ্রিক সহাবস্থানের মাধ্যমেই মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে তাঁর বিশ্বাস।
বিদ্রোহী কবি নজরুল। মানবতার কবি নজরুল। তিনি বিদ্রোহ করেছেন মানুষে মানুষে প্রেমের জন্য, তাই তাঁর কাছে মানবতা ও প্রেম এক হয়ে গেছে।
সব ধর্মগ্রন্থের মূল মন্ত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই সংকলিত। তা হল সাম্য ও মানবতা। কবির লড়াই এই সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। সাম্যের গানে। তাই তিনি আজও সকল ধর্মের মানুষের হৃদয়ে, সকল শ্রেণির মানুষের মনে বিরাজমান।
তথ্য ঋণ—
১) সঞ্চিতা
২) নজরুল মানস: সঞ্জিদা খাতুন
৩) বিদ্রোহী রণক্লান্ত: গোলাম মুরশীদ
লেখক পরিচিতি: শম্পা সামন্ত। কবি, প্রাবন্ধিক।
সম্পাদক, অন্তর্মুখ দ্বিভাষিক আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা।( জার্নাল)