নজরুলের কবিতা নিয়ে কিছু কথা
নজরুলের কবিতা নিয়ে কিছু কথা
১
মোট ৭৭ বছরের জীবন কাজি নজরুল ইসলামের ( ১৮৯৯ -১৯৭৬)। তার মধ্যে ” সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ” কাটাতে পেরেছিলেন মাত্র ২২/২৩ বছর। ১৯৪২ সালে ” পিক্স ” রোগে আক্রান্ত হবার ফলে তার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা চলে যায়। তার অগাধ সৃষ্টি ক্ষমতাও, দুর্ভাগ্যবশত:, নষ্ট হয়ে যায়, বাঙলা সাহিত্যের একটা বিশেষ ধারার কবিতার বিকাশকে হয়তো অপূর্ণ রেখেই। নজরুলকে কেউ কেউ স্বভাব কবির তকমা দিয়েছেন। তার প্রধান কারণ বোধায় নজরুলের অতি দ্রুত, ক্ষিপ্র ও অবাধ কাব্য উৎপাদনী প্রতিভা। সব দেশেই , বাঙলায় তো বটেই, একসময় স্বভাব কবিদের খুব চল ও মর্যাদা ছিল। কথায় কথায় পদ রচনা সহজ কাজ ছিল না, এখনো নয় যদিও। আধুনিক কবিতা যাকে বলা হয়, সেটার উদয়ের কালে এবং পরবর্তীতে তার বিকাশের সাথে সাথে স্বভাব কবিত্বের শক্তিকে একটু খাটো চোখেই দেখা হতে শুরু হয়। তাহলেও এটা মনে হয়, স্বভাবে কবিত্ব শক্তি না থাকলে , স্বভাব-কবিতা বা আধুনিক কবিতা কিছুই রচনা করা সম্ভব নয়। নজরুলের স্বভাব কবিত্বশক্তির একটা দৃষ্টান্ত দিই। লিচু চোর নামের এই কবিতাটি আমাদের স্কুলবেলায় পড়তে হয়েছিল। তখন কবিতাই হয়তো ঠিকঠাক বুঝতাম না। তবু তার অমন উদ্দাম ছন্দ মনে স্থায়ি দাগ কেটে গিয়েছিল। পরে, অনেকটা বড় হয়ে জেনেছিলাম যে এই চমৎকার কবিতাটি নজরুলের স্বভাব কবিতা হিসেবেই দেখা যেতে পারে। কেন, সেই বৃত্তান্তটা ছোটো করে বলি: আলি আকবর নামে একজন ছোটদের পাঠ্যবইয়ের একটি পান্ডুলিপি তৈরি করে একদিন নজরুলকে দেখাতে এনেছিলেন, সম্ভবতঃ মতামত নিতে। পড়েটড়ে নজরুল ওনাকে মুখের ওপর বললেন, পান্ডুলিপিতে ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। তারপর নজরুল তৎক্ষণাৎ মুখে দু-খিলি পান পুরে ‘ লিচু চোর ‘ ছড়াটি লিখে দিলেন , যার প্রথম চার লাইন এইরকম:- বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে / সেকি ব্যস করলে তাড়া / বলি, থাম — একটু দাঁড়া। আলি আকবরের বিস্ময়ের সেদিন কি অবস্থা হয়েছিল সেটা কল্পনা করে নিতে আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নজরুল ইসলামের স্বভাব কবিত্বের শক্তি নিয়ে আরেকটি কথা বলে এই ব্যাপারে থামব। সংসারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দুখু মিঁয়াকে ( আমাদের নজরুলকে ) ১০/১২ বছর বয়সেই আসানসোলের রুটির কারখানায় কাজে ঢুকতে হয়েছিল। ওরকম কঠিন শ্রমের কাজ নিয়েও ওই বয়সে দুখু মিঁয়া লিখে ফেলেছিলেন এমন সব লাইন:- মাখতে মাখতে গমের আটা / ঘামে ভিজল আমার গা-টা। নজরুলের কাব্য প্রতিভায় তাই তার স্বভাব কবিত্ব শক্তির ভূমিকা নিয়ে নানা দিক থেকে আরো গভীর আলোচনার প্রয়োজন অনুভূত হওয়া উচিত বলেই মনে হয়। শুধু লিচু চোর কেন , নজরুল নিয়ে গভীর চর্চা যারা করেন তারা কেউ কেউ বলেছেন নজরুলের বেশিরভাগ ছড়াই, যেমন খুকি ও কাঠবেড়ালি বা খাঁদু-দাদু বা প্রভাতী, এগুলো নাকি বিচিত্র অবস্থায় তাৎক্ষণিক ভাবনার ফসল।
২
নজরুল রচনাবলী খানিকটা উল্টেপাল্টে দেখলেই নজরে আসে যে নজরুল সাহিত্যের প্রায় সব স্বীকৃত শাখায় হাঁটাচলা করেছেন। তবুও একথা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে নজরুল দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তাঁর ছড়া কবিতা ও গানে। এবং এখানেও নজরুল তাঁর স্বভাব কবিত্বের কিছু উল্লেখযোগ্য ফসল ফলিয়েছেন। মানুষ ও কবি উভয় হিসেবেই নজরুলের জীবন ছিল উদ্দামতায় পূর্ণ। যেমন জীবনে তিনি ছিলেন দিলদার, প্রাণখোলা , স্পষ্টবক্তা একজন মানুষ তেমনি তার এইসব বৈশিষ্ট্য প্রাণোচ্ছল উর্মি হয়ে ছড়িয়ে আছে তার কাব্যে ও গানে। তিনি জীবনকে চিনেছেন, ভোগ করেছেন তাঁর অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে। ১৯১৭ সালে তাঁর আঠার বছর মত বয়স, তিনি যোগ দিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীতে কাজ করতে করতেও তিনি লিখে চলেছেন অজস্র কবিতা। ১৯২২ সালে বিজলী পত্রিকায় প্রকাশ পেল তাঁর ‘ বিদ্রোহ ‘ কবিতাটা। যদিও কেউ কেউ বলেন, যেমন প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়, যে এই কবিতাটি ‘ মোসলেম ভারত ‘ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল। এই কবিতাটি বিপুল সাড়া ফেলে ছিল। বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি ও কাব্য সমালোচকের মনে হয়েছিল, ” ‘ বিদ্রোহী ‘ পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিক পত্রে —- মনে হলো এমন কখনো পড়িনি। অসহযোগে অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন প্রাণ যা কামনা করছিল, এ যেন তা-ই; দেশব্যাপী উদ্দীপণার এ-ই যেন বাণী।” শুধু বুদ্ধদেব বসু নয় ঐসময়ে আরো অনেকেরই মনে প্রাণে আলোড়ন তুলেছিল নজরুলের ‘ বিদ্রোহী ‘। প্রায় বিদ্রোহী ‘ র মত আরো বেশ কিছু কবিতা নজরুলের আছে, যেমন ‘ ধূমকেতু ‘ , ‘ কামাল পাশা ‘, ‘ রণভেরী ‘ ইত্যাদি। ‘ অগ্নিবীণা ‘ কাব্যগ্রন্থের এইসব কবিতা মূলত: অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, দুর্বল অসহায় মানুষের ওপর ক্ষমতাশালীদের প্রতাপের বিরুদ্ধে ধিক্কার ও প্রবল সংগ্রামের ডাক। এছাড়াও নজরুল অন্য ধরনের কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেমের কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন বিষাদের কবিতা, পুত্র হারানোর শোক ইত্যাদি এইসব নিয়েই তিনি কবিতা ও গান রচনা করে গেছেন। তা সত্বেও নজরুলের কবিতার প্রভাব অন্ততঃ এই বঙ্গে ক্রমহ্রাসমান, নজরুল বিস্মৃত হতে হতে আটকে আছেন কোন রকমে। বাঁধভাঙা পুনরুর্জ্জীবন নজরুলের আর ঘটবে কিনা সে কথা তো ইতিহাস বলবে ।
৩
নজরুলের কবিতা নিয়ে বর্তমানে যে অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায় তার নানা কারন থাকতে পারে। কিন্তু অন্ততঃ দুজনের মত এব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য। একজনের নাম আমরা আগে করেছি , তিনি বুদ্ধদেব বসু। আরেকজন হলেন কবি জীবনানন্দ দাস। ” বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবচেয়ে বড় কবিত্ব শক্তি নজরুল ইসলামের ” —- এই কথা বলার পরও নজরুলের কবিতার ” প্রধান গুণ — এবং প্রধান দোষ ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁর অদম্য স্বত:স্ফূর্ততাকে। বুদ্ধদেবের মতে এই অদম্য স্বত:স্ফূর্ততা থেকেই নজরুলের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল এক ” চিন্তাহীন অনর্গলতা ” । ইংরেজ কবি বায়রন সম্পর্কে জার্মান কবি গ্যেটে যা বলেছিলেন নজরুল সম্পর্কেও বুদ্ধদেব সেই অভিমতই পোষন করতেন। বায়রনের মতই নজরুলও ” যে মুহুর্তে চিন্তা করতে শুরু করতেন, তিনি শিশু হয়ে যেতেন। ” এক কথায় বুদ্ধদেবের মতে নজরুলের কবিতায় চিন্তার দাঢ্য ছিল না।
আমার মনে হয়েছে যে আরেকটু গভীরভাবে জীবনানন্দ দাশও একই মত পোষন করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে নজরুলের সময় জনমানস ” চমৎকার কবিতা চাচ্ছিল ( আজও জনমানস রকমফেরে তাই-ই চায় যদিও)”। নজরুল, জীবনানন্দ বলছেন, সেই ” মন স্পর্শ করতে পেরেছিলেন” প্রবলভাবে, যদিও তাঁর মধ্যে ” মননপ্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতা ” ছিল না। তাই নজরুলের কবিতা ” চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়। “
৪
এখন এই প্রত্যেকটি কথা নিয়ে হয়তো তর্ক হতে পারে। যে কবিতা পড়ে বা শুনে মন যদি বলে ওঠে — চমৎকার তাহলে সে কবিতা কিসের নিরিখে মানোত্তীর্ণ না হতে পারে? এখানে তাহলে চমৎকার বলতে কি চমক-সর্বস্বতা বোঝানো হচ্ছে? মনে হয় সেটা নয়। কারণ সে যুগে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ নিজে, নলিনীকান্ত সরকার ও আরো অনেকে নজরুলের কবিতায় যখন দোলায়িত হতেন তখন একথাই বুঝতে হয় যে তাঁর কবিতায় চমক থাকলেও তাঁর কবিতার সবটাই চমক-সর্বস্ব ছিল না। তাহলে জীবনানন্দ নজরুলের কবিতা ” মানোত্তীর্ণ ” হয় নি বলতে ঠিক কি বুঝিয়ে ছিলেন? এটা জীবনানন্দের এ প্রসঙ্গে বলা কথা থেকেই বুঝতে হবে । নজরুল নিয়ে লেখাতেই জীবনানন্দ বলছেন, ” … নিজেকে বিশোধিত করে নেবার প্রতিভা নেই এ-সব কবিতার বিধানে, শেষ রক্ষার কোন সন্ধান নেই।” যা বুঝলাম তা হল যে জীবনানন্দ যাকে মহৎ কবিতা বলেন তার মধ্যে পাঠক নিজেকে তার আবেগ আর মননের অস্বচ্ছতা থেকে ” বিশোধিত ” করে আত্ম-সংকট থেকে মুক্তির অন্ততঃ একটা সাময়িক স্বস্তিবাচন খুঁজে পান। জীবনানন্দের ইঙ্গিত হয়তো এই যে, নজরুলের কবিতা আমাদের আবেগের উদ্দামতায়, বাঙলা -ফার্সি শব্দের চোখ ধাঁধানো সব মিশ্রনের ধাক্কায়, ছন্দ থেকে ছন্দে সাবলীল গতায়াতে আমাদের মুগ্ধ করেন কিন্তু তা সত্বেও তাঁর কবিতায় যুগের নিদারুণ যন্ত্রনাময় আত্ম-সংকটের জাল ছিঁড়ে বেরোবার কোন গভীর প্রণোদনা পাই না।
৫
মনে রাখতে হবে এই কথা বলার পর জীবনানন্দ বলছেন, ” পরার্থপরতার চেয়ে স্বার্থসন্ধান ঢের হেয় জিনিস ….. কিন্তু কবিমানসের আত্মোপকার প্রতিভাই তাকে নির্মাতার ওপরের ভূমিকায় ওঠাতে সাহায্য করে, কবিতাকে তার অন্তিম সংগতির পথে নিয়ে যায়।” কিন্তু নজরুল যেমন জীবনে তেমনই কবিতায় পরার্থপরতাকেই চরম মেনেছেন। সুস্থ হয়ে উঠে যদি আবার কলম তুলে নিতে পারতেন তাহলেও হয়তো কবিতায় ওই পরার্থপরতাকেই চরম বলে মানতেন, জীবনানন্দের তত্ব না মেনে। কে জানে, আবার হয়তো জীবনানন্দের কথা মত আত্মোপকারিতার যথাযথ সাধনের ভেতর দিয়ে নজরুলও শুধু চমৎকার কবিতা নয় জীবনানন্দীয় ভাষায় যা মানোত্তীর্ণ কবিতা, নজরুল তেমন মানোত্তীর্ণ কবিতা লিখে তাঁর কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসার পথটা আরেকটু প্রশস্ত করে দিতে পারতেন।