মায়ের সঙ্গে হাঁটছি।
মাও হাঁটছে আমার সঙ্গে। এক হাতে শক্ত করে আমার হাতটা ধরা। এভাবে হাঁটতে ভালোই লাগে। এভাবে ঘুরে বেড়াতে। কত নতুন পথ। কত নতুন ঠিকানায় ঘোরাফেরা। অথচ হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই! আবার যদি হারাইও— মা তো সঙ্গেই আছে। মাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে বেশ লাগে। কত অজানা গন্তব্য।
এই সময় মনে হয় কোথায় আছি, কোথায় যেতে হবে—এসবের যেন কোন ভাবনাই নেই আর। যেন নতুন পথ খুঁজতে খুঁজতে ঠিক ঠিকানা মিলে যাবে কোথাও। পাওয়া যাবে কাঙ্খিত সেই পথ। কিংবা সেই কাঙ্খিত পথ না মিললেও যেন কোন ভাবনা নেই আর। ভাবনা নেই এখন সকাল—দুপুরে কোথায় যাবো, বিকেলে কোথায় থাকবো সে সব ভাবার। মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকায় একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে! আছে এভাবে দিনগুলিকে দেখার, এভাবে রাত। যখনই আমি এসব নিয়ে ভাবি, কতটা যে সময় পেরিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে হয়তো সারাটা রাত, ভাবতে ভাবতে ভোর। একদম ভোরের দিকে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। আবার মায়ের ডাকে জেগে উঠি। হাঁটতে শুরু করি আবার।
এখন যেমন প্রথমে এই রেল স্টেশনটায় এসে নেমেছি। নেমে প্রথমে বড় রাস্তা, বাজার, তারপর ক্রমশ ভিড় পেরিয়ে আরও এগিয়ে এসে এই গলিমুখ। ভিড় কমতে কমতে এখন এদিকটায় অনেকটাই ফাঁকা। আর এখানে এসে আর একটা গলিপথ পেরিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে নতুন কোনও ঠিকানায়। নতুন ঘর। নতুন মানুষকে খুঁজে বের করা।
শুরুতে প্রথম প্রথম বায়না ধরতাম ভীষণ। ভ্যান-রিক্সা স্ট্যাণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে যেতাম শক্ত হয়ে। হয়তো জেদ করতাম কিছুতেই আর হাঁটবো না বলে। মা অবশ্য আমাকে থমকে যেতে দিত না কিছুতেই। বলত, ‘ওই তো আর একটু—’। সামনে এগিয়ে চলা গাড়িগুলোকে দেখিয়ে ঠিক ভুলিয়ে নিয়ে যেত আমার হাত ধরে। আমিও কি অবলীলায় মায়ের কথা শুনে সে সব ভুলে নতুন রাস্তা ধরে চলতে থাকা গাড়িগুলোকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতাম আরও কতটা পথ।
এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে যখন ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াতাম। যে ঘরটায় থাকার কথা লোকটার, অথচ এতদূর এসে দেখি সে হয়তো বাড়িতে নেই। আমি আর মা বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ। হয়তো সেই সকালে এসেছি, এখন দুপুর। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলল। অথচ কিছুতেই লোকটার দেখা নেই। মা হয়তো বারবার বলছে, ঠিক এই সময়েই আসতে বলেছিল ও। অথচ লোকটা সন্ধ্যের মুখে ফিরে এসে কিছুতেই সেকথা মানতে চাইছে না। মা যতই বলছে, লোকটা ততই অন্য কথা বলছে। একসময় দেখছি মা ট্রেনের টিকিট দেখিয়ে বলছে, ‘এই যে আজ সতেরো তারিখ, আজকেই আসতে বলেছিলে’। লোকটা সেই টিকিট হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলে যাচ্ছে, ‘আজ সতেরো নয়, ষোলো—’। এবার দেখছি, মা কাঁদছে। দেখছি, মায়ের পাশে কেউ নেই। শুধু আমি একা অসহায় হয়ে বসে আছি। মাকে কাঁদতে দেখে আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোখ ভরে যাচ্ছে জলে। আবার সেই জল মুছে আমি সেই লোকটাকে ভালো করে দেখছি।
সে রাতে মায়ের সঙ্গে যখন ফিরছি, মাকে দেখছি চোখ মুছে কেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ততক্ষণে কেমন ভেতরে ভেতরে আরও দৃঢ় হচ্ছে মা। হয়তো বলছে, এর শেষ দেখে ছাড়বে। এভাবে পার পেয়ে যাওয়া লোকটাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, মা বারবার বলতে চাইছে, আজ ষোলো নয়, সতেরো—। কিন্তু কিছুতেই সে কথা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। আমি মায়ের পাশে বসা। বুঝতে পারছি মা ভেতর থেকে বলছে, ক্রমশ বলেই যাচ্ছে সেকথা। আর প্রস্তুত হচ্ছে কিছু একটা করার।
আমি মায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দেখতে পাচ্ছি, লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেমন দাঁত বার করে হাসি মুখে। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে এক মুঠো লজেন্স। আমি কিন্তু তখন রাগে এক ঝটকায় সেসব ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি এদিক-ওদিক। রেগে গেলে আমার মাথায় রক্ত ওঠে। আমি তখন আর এমন শান্ত হয়ে থাকতে পারি না। আমি তখন যেন লোকটাকে কিছুতেই ছেড়ে েদওয়ার পাত্র নই। কিছুতেই লোকটাকে হাসতে দেখতে পারছি না। কিছুতেই লোকটাকে মেনে নিতে পারছি না। আমি তখন অন্য আমি।
কিন্তু লোকটা হঠাৎ করে কোথায় যে চলে গেল। মা আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘কিরে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি?’ আমি তখন আবার আমি। সত্যি সত্যি রাগ কোথায় উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে। দেখছি একটা নতুন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। নতুন গন্তব্য। এবার আমাদের নামতে হবে।
মায়ের সঙ্গে নেমে এসেছি নতুন কোথাও। স্টেশন পেরিয়ে নতুন পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছি আবার। এদিকটায় চারপাশটা বেশ খোলামেলা। কয়েকটা মাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাচ্চারা খেলছে। একদিকে বড় ঝিল। দুপাশে সারি সারি গাছ। হাওয়া ভেসে আসছে। সেই হাওয়ায় ভেসে আসছে এক অদ্ভুদ গন্ধ। গন্ধটা কেমন চেনা লাগছে না? অনেকটা মামা বাড়ির রাস্তার মত। সেদিকেও তো এমন অনেক মাঠ। খোলামেলা জমি। দূরে রেললাইনের ছুটে চলা। কালো ধোঁওয়া মাখা ট্রেন। কিছুদূর যাওয়ার পর অদৃশ্য।
মা হাঁটছে আমার হাত ধরে। শুকনো মাটির রাস্তা। দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা ঘর। পরিচিত মুখগুলো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। ক্রমশ কাছে আসছে তারা। মাকে দেখতে পেয়ে এতক্ষণে কথা বলছে কেউ কেউ। জানতে চাইছে, ‘কেমন আছো গো জ্যোৎস্না? ছেলে তো অনেক বড় হয়ে গেল দেখছি।’ ওরা খোঁজ নিচ্ছে মায়ের। খোঁজ নিচ্ছে আমার। কেউ হয়তো ঘরে ডেকে বসাতে চাইছে। হাতের কাজ ফেলে মাকে পেয়ে কথা বলতে চাইছে। কত দিনের জমে থাকা কথা। কেউ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করছে, ‘এখন কোথায় জানি থাকো বললে? কি, কলকাতা?’ তারপর হয়তো বাড়ির খোঁজখবর নেওয়া, আমার স্কুল, শরীর স্বাস্থ্যের হালচাল। মা হয়তো এতক্ষণে ভুলেই গেছে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা। ভুলেই গেছে দিদিমা মায়ের পথ েচয়ে সেই সকাল থেকে হয়তো বসে আছে রান্না করে। নিজেও হয়তো খায়নি এতক্ষণ। মা গেলে মাটির বারান্দায় বসে একসাথে খেতে বসবে।
এখন হয়তো দুপুর। দূরে কোকিল ডাকছে। বসন্ত এখনও পুরোপুরি যায়নি এদিকটায়। মা বসেই আছে। কথা বলছে এখনও। এসব কথা যেন ফুরোবার নয়। অথচ আমি ছটফট করছি মামা বাড়ি যাবো বলে। মামা বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে খেলতে বেরবো বলে। আমার কয়েকটা বন্ধু, হয়তো এতক্ষণে আমাকে না পেয়ে ঘুরে গেছে কয়েকবার। এবাড়ির লোকজন হয়তো বুঝতে পেরে মাকে বলছে খেয়ে যেতে। মায়ের হাত ধরে বসিয়েছে মাটির দাওয়ায়। মাও হয়তো আপত্তি করছে না এখন। হয়তো এতদিন পর এসেছে বলেই।
মাও হয়তো ভাবছে দিদিমা রাগ করবে নিশ্চয়ই। খেয়ে এসেছে বলে এতক্ষণ অপেক্ষার পর অভিমান করবে মায়ের উপর। মা হয়তো বোঝাতে চাইবে, ‘এতদিন পরে কাছে পেয়ে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়লো না ওরা।’ দিদিমা হয়তো তারপরও অভিমানে চুপ হয়ে থাকবে। এমনকি মা খেয়ে এসেছে জেনেও নিজে কিছুতেই কিছু খাবে না আর। অভিমান হলে দিদিমা খাওয়া বন্ধ করে দেবে জানি। এ অনেক পুরনো অভ্যাস।
আমি তখন বুল্টিদের উঠোনে খেলতে বসে যাবো। আরও কত বন্ধু তখন আমার। আমরা গাছে চড়বো। লুকোচুরি খেলবো। আবার হয়তো বুল্টির মায়ের বকা খেয়ে ওদের বারান্দায় সবাই মিলে চুপচাপ শুয়ে থাকবো সারাটা দুপুর। মা হয়তো খুঁজতে আসবে তখন। এসে দেখবে আমি কেমন ঘুমিয়ে আছি ওদের মত করে। মা আশ্চর্য হবে একটু। হয়তো ভাববে আমি তো কখনও দুপুরে ঘুমোই না। কখনও মাকে না বলে কোথাও এতক্ষণ থাকিও না। আর সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরে আসি ঘরে।
সন্ধ্যে হলে মামা বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে। সে আলো অবশ্য বেশিক্ষণ থাকে না। তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাই ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। মা অবশ্য বলে দেয়, ‘নে এবার ঘুমিয়ে পড়।’ আমিও তখন কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাই। আমি তো তখন মায়ের বন্ধু। মায়ের সঙ্গে হাঁটি। মায়ের সঙ্গে যাই কত পথ। মাকে ছাড়া তখন এতটুকু এগিয়ে যাওয়া চলে না।
সকালে ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। বাইরে হয়তো তখনও বেশ সকাল। কেমন শীত শীত ভাব। চারপাশে মাটির দেওয়াল চুইয়ে কেমন হিম ঢুকছে। আমি সেই হিম সকালে মায়ের ডাক শোনামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। মা উনুন ধরিয়েছে এতক্ষণে। কয়লার উনুন। ধোওয়া ছেয়ে গেছে গোটা ঘর। ঠিক তখনই হয়তো মাস্টারদা এসেছে আমাদের পড়াতে। আর পড়াতে বসে বলছে, ‘এত ধোওয়া কেন? চোখ যে মেলতে পারছি না।’ দেখছি মাস্টারের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাস্টার তাকাতে পারছে না কিছুতেই।
মা হয়তো বলছে এই তো একটু সময়। উনুনটা ধরলো বলে। আমিও দেখছে ধীরে ধীরে ধোওয়া সরে কেমন চারপাশ পরিস্কার হয়ে গেছে ততক্ষণে। মাস্টার চোখে জল দিয়ে এসে পড়াতে শুরু করেছে এবার। আমি পড়ছি ইতিহাস ভূগোল। পড়ছি অঙ্ক। হয়তো পড়া না পেড়ে বকুনি খাচ্ছি। মা কিন্তু সবকিছু দেখেও তখন কিছু বলছে না।
(চলবে…)
লেখক পরিচিতি :