সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী
বিমলশঙ্কর পড়ন্ত জমিদার। জমিদারি তো আর নেই, তবে বেশ কয়েক বিঘে জমি আছে আর আছে পেল্লায় পৈতৃক বাড়িটা।
গত তিন মাস ধরে বিমলশঙ্কর অসুস্থ। ডাক্তার এসে যখন জবাব দিয়ে গেলেন বিমলশঙ্কর ছেলে কমলশঙ্করকে ডেকে বললেন, “আমার তো দিন শেষ হয়ে এল। এবার তোমাকেই জমিদারি সামলাতে হবে। একটি কথা তোমাকে বলা দরকার। আমাদের বাড়ি থেকে একটি বাক্স চুরি হয়ে গেছে আমার বাবা অমলশঙ্করের সময়ে। ওই বাক্সটা নাকি বহুমূল্য হীরে জহরত দিয়ে ঠাসা। বাক্সটিকে খুঁজে পেতে বাবা চেষ্টা করেছিলেন অনেক। আমিও অনেক জায়গায় লোক পাঠিয়ে খোঁজখবর করেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। এবার তোমার দায়িত্ব ওই বাক্সটি খুঁজে বার করার। ওটি আমাদের— শুধু আমাদেরই সম্পত্তি। ওতে আর কারো কোন অধিকার থাকতে পারে না। তুমি ওটি খুঁজে বার করতে পারলে অবস্থা ফিরে যাবে।”
বিমলশঙ্করের মৃত্যু হল। কমলশঙ্কর দায়িত্বভার গ্রহণ করেই ডেকে পাঠালো নায়েবকে। বললো,” কাকাবাবু, আপনি আমাদের বহুদিনের পুরনো অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী। আমি আগামীকালই বেরোবো আমাদের বাড়ির হারিয়ে যাওয়া মহা মূল্যবান বাক্সটিকে খুঁজে আনতে। আপনার উপর জমিদারি পরিচালনার ভার রইলো। আমি যথাসময়ে ফিরে আসবো। আশা করি আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না।”
নায়েব বললেন,” জয়স্তু। তবে একটি কথা।এ বাড়ির পিছনে হৃদকমল সরোবর নামে যে পদ্মের পুকুরটা আছে, যার শোভা একসময় রাজা-মহারাজাদেরও ঈর্ষার বিষয় ছিল, দীর্ঘদিন যত্নের অভাবে তার এখন হতশ্রী দশা। তুমি ঘুরে এসে অবশ্যই ওই সরোবরটির বিশেষ যত্ন নিও।”সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় নাড়লো কমলশঙ্কর।
কমলশঙ্কর বাড়ির পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে লাগলো। অমলশঙ্করের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল কাদের, কারা খুব বেশি করে আসতেন এই বাড়িতে, বাড়ির পুরনো খবর আর কে কে জানতেন–এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে লাগলো সে প্রাণপণে। অবশেষে কিছু তথ্য পাওয়া গেল।
একাই বেরিয়ে পড়লো কমলশঙ্কর। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শুরু করলো খোঁজাখুঁজি।কাটতে লাগলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।বহু শ্রম, প্রচুর ধকল, অশেষ দুর্ভোগ। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল হারাধন বিশ্বাসের বাড়ি– মায়াপুর গ্রামে মোহনার কাছে।
যোগাযোগ হল হারাধন বিশ্বাসের নাতির সঙ্গে। তাকে আসার উদ্দেশ্য সব খুলে বললো কমলশঙ্কর। নাতির নাম দিবাকর বিশ্বাস। কমলশঙ্করেরই বয়সী। দিবাকর সব শুনে বললো, “হ্যাঁ, জানি ঠাকুরদা একটা মহামূল্যবান বাক্স চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেটি বাড়িতে আনার পরেই আমাদের পরিবারে একের পর এক বিপর্যয় নেমে আসে। বাক্সটা মনে হয় অভিশপ্ত। এ বাড়ির পক্ষে বড্ড বেমানান। ঠাকুরদাকে আমার বাবা-কাকারা অনেক বুঝিয়েছিলেন বাক্সটা ফিরিয়ে দিয়ে আসার জন্য। ঠাকুরদা বলেছিলেন, তা কোনমতেই সম্ভব নয়। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বাক্সটাতে আমাদের কোন আগ্রহই ছিল না। অনেকটা অবহেলাতেই বাড়িতে পড়ে ছিল সেটা। তারপর একদিন চুরি হয়ে যায়।”
কমলশঙ্কর চোয়াল শক্ত করে জানতে চাইলো দিবাকরের ঠাকুরদার সময়ে বাড়িতে কারা কারা আসতেন কিংবা ওই বাক্সের খবর রাখতেন কে কে। মোটামুটি ভাবে খবর পাওয়ার পর আবার বেরিয়ে পড়লো কমলশঙ্কর। আবার বহু শ্রম, অযুত দুর্ভোগ। কেটে গেল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সুনির্দিষ্ট খবর পেয়ে একটার পর একটা বাড়িতে যেতে লাগলো সে। কিন্তু সবখানেই শুনলো, বাক্সটা সে বাড়িতে এসেছিল বটে, কিন্তু তারপর চুরি হয়ে গেছে।
প্রায় বারো বছর কেটে গেল। এক যুগ। একরাত্রে কমলশঙ্কর আশ্রয় নিলো এক পুরনো মন্দিরে। মন্দিরের পূজারী বৃদ্ধ। সব শুনে কমলশঙ্করকে বৃদ্ধ বললেন, “তোমার নাম যদি ইন্দ্রজিৎ হোতো, তবে তুমি ওই বাক্সের জন্য এত বেশি উৎকণ্ঠিত হতে না।” কমলশঙ্কর এ কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু জানতে চাইলো, বাক্সটি এখন কোথায় আছে সেটি সম্পর্কে বৃদ্ধ পূজারী কোন ধারণা দিতে পারবেন কিনা। গণনা করলেন পূজারী। তারপর বললেন,” বাক্সটি এখন আছে গুপ্তিপাড়ায় সুপ্তিসুখ ঘোষের বাড়িতে। ভোরে উঠেই কমলশঙ্কর এক মুহূর্ত দেরি না করে সুপ্তিসুখের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
অশেষ যন্ত্রণার পর খুঁজে পাওয়া গেল সেই আকাঙ্ক্ষিত বাড়ি। দরজা খুলে দিল সুপ্তিসুখের একমাত্র কন্যা কোজাগরী ঘোষ। অবিবাহিত কন্যাটির আশ্চর্য রূপ লাবণ্যে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলো কমলশঙ্কর। তারপর কোজাগরীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলো সে। কোজাগরী অকপটে বলল,” যা শুনেছেন ঠিকই শুনেছেন। বাবা বাক্সটি চুরি করে এনেছিলেন নিবারণ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে। বাক্সটা সবসময় আগলে রাখতেন বাবা। হাতছাড়া করতে চাইতেন না। মা মারা গেছেন আমার ছোট্টবেলায়। তারপর বাবার ধ্যান জ্ঞান ছিলাম আমি। কিন্তু বাক্সটা পাওয়ার পর মনে হল বাবা যেন আমাকেও ভুলে যেতে বসেছেন। একদিন হঠাৎই বাবা মারা গেলেন। একেবারেই আকস্মিকভাবে। বাবা চলে গেলেন। সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারলেন না। পড়ে থাকলো তার সাধের বাক্স। সবকিছু। এমনকি হুঁকো কল্কেটা পর্যন্ত।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়া হল সেই বাড়িতেই। কোজাগরীর হাতে যেন জাদু আছে। রান্না খেয়ে মুগ্ধ কমলশঙ্কর। কিছুক্ষণ পরে বাক্সটা এনে কমলশঙ্করের হাতে দিলো কোজাগরী।
অসম্ভব খুশি হলো কমলশঙ্কর। এতদিনে পরিশ্রমের মূল্য পাওয়া গেছে। বাবা বেঁচে থাকলে কি খুশিই যে হতেন তা ভেবে চোখে একটু জলও এসে গেল।
ধুলো মুছে বাক্সটা একটু নাড়াচাড়া করতেই বোঝা গেল ভেতরে অনেক মণি মুক্তা রয়েছে। বাক্সটি দেখতেও ভারী সুন্দর। কমলশঙ্কর এবার বললো,” বাক্স তো পেলাম। এ তো তালা বন্ধ। এর চাবিটা কোথায়?”
যেন এর চেয়ে মজার কথা আগে কখনো শোনেনি কোজাগরী। হাসিতে লুটিয়ে পড়ে বলল,” সেটাই তো সবচেয়ে রহস্যের বিষয়। যতদূর জানি, এর চাবিটার খবর কিন্তু কেউ পায়নি। কেউ জানে না চাবিটা আদৌ কোথায় আছে। প্রথম যিনি চুরি করেছিলেন তিনিও জানতেন না। সকলেই আশা করেছিলেন তালাটা ভেঙে বাক্সটা খুলবেন। কিন্তু এযে কি ভয়ানক তালা! শত চেষ্টা করেও কিছুতেই খোলা যায়নি।”
রাতটা সেই বাড়িতেই কাটলো কমলশঙ্করের।ভোরে উঠে বললো সে,” কোজাগরী, শিগগির তৈরি হয়ে নাও।” কোজাগরী বলল,” কেন? কোথায় যাব?”
কমলশঙ্কর বললো,” কোথায় আবার? আমার সঙ্গে। বারোটা বছর শুধু শুধু নষ্ট হলো। বাকি জীবনটা তোমার সঙ্গেই কাটাবো।”
কোজাগরী বলল,” আর, বাক্সের কি হবে?”
কমলশঙ্কর বললো,” ওটাকে বাক্স না বলে মোহিনী-ফাঁদ বলাই ভালো। এ বাক্স কেউ কোনদিন খুলতে পারবেনা। শুধু তালা ভাঙার আশায় দিন কাটিয়ে যাবে। দিন ফুরালে পাড়ি দেবে অজানা কোন এক দেশে। এই বাক্সটা অনেকেই চুরি করেছিলেন। কিন্তু শেষ সময়ে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি কেউ। বাক্সটা এখানেই থাক। শুধু তুমি যাবে আমার সঙ্গে, আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে।”
এক যুগ পরে বাড়ি ফিরলো কমলশঙ্কর।সেদিন পূর্ণিমা। বাড়ির সকলের মহা আনন্দ। নায়েব বললেন,” বাঁচলাম, বাবা। এবার কর্তা গিন্নি ভালো করে সংসার চালাও। আমাকে এবার রেহাই দাও।” কমলশঙ্কর বললো, “আপনাকে রেহাই দেবো কিনা সে আমি পরে ভেবে দেখব। আচ্ছা, ওই হৃদকমল সরোবরের কী অবস্থা?”
নায়েব বললেন,” সংস্কারের অভাবে এখন তা একেবারে শেষ অবস্থায়। তবে এখনো সময় আছে। তাল ঠুকে কাজে নামলে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে আগের অবস্থায়।”
সেই রাত্রেই পূর্ণিমার আলোয় ধোওয়া হৃদকমল সরোবরের সামনে দাঁড়িয়ে কোজাগরী কমলশঙ্করকে বললো,” তোমার নামটা আমি বদলে দেবো। এই নামটা আমার ভালো লাগেনা না।”
কমলশঙ্কর বলল,” কী নাম দেবে?”
কোজাগরী বলল,” ইন্দ্রজিৎ। হৃদকমল সরোবরে নামার দম অমল-বিমল-কমলের থাকেনা। তা থাকে একমাত্র ইন্দ্রজিতের।”