পঞ্চম পর্ব
একেই বলে পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে ল্যাজেগোবরে হওয়া। কোথায় প্রেয়সীর কোলে মাথা রেখে রসালাপ করবে? সে সূযোগ তো পেল-ই না, উল্টে অঘটনের ঘনঘটায় জেরবার অবস্থা।
মোবাইল হারানো থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি পরপর সাজিয়ে ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে আকাশের মাথায় কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হল, রোজের হবু বর কীভাবে জানল আমি এখানে এসেছি? জলাশয়ে পাওয়া মৃত মেয়েটির পরিচয় কী? তাকে খুন করা হয়েছে, না সুইসাইড কেস? গুণ্ডা ছেলেটির হাতের বালা এখানে এল কীভাবে?
অভিমানে আহত মেয়েরা অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে, অনেক সময় তা পাগলামির পর্যায় অতিক্রম করে প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে বাঁধন ততটাই মজবুত হওয়া চায়।
বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত, মডার্ন কালচারে অভ্যস্ত মেয়ে লোকলজ্জা বদনামের ভয় গুটিয়ে থাকবে একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই পারত? তা না করে….
আকাশের আচরণে অবাক না হয়ে পারল না আমজাদ। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। আকাশ ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার অবকাশ নেই। অগত্যা দেবুকে ডেকে নিয়ে ডানদিকে অগ্রসর হল।
রাস্তাটি ডানদিকে অগ্রসর হয়ে জলাশয়ের পাড়ে গিয়ে মিশেছে। দ্রুত হেঁটে গিয়ে তারা সেখানে পৌঁছালো।
লাশ জলাশয় থেকে তুলে এনে ভ্যানরিক্সার উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। তরুণীর বয়স কুড়ি-একুশের বেশি হবে না। মুখ বাদে সারা শরীরে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সাদা চাদর। দুজন পুলিশ কনস্টেবল রয়েছে পাহারায়, তা সত্ত্বেও ভ্যানরিক্সা ঘিরে ভিড় জমে উঠেছে। ভিড় ঠেলে সামনের সারিতে চলে এল তারা।
একটু বাদে দশাসয় চেহেরার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। দেবীপুর ফরেস্ট রেঞ্জের বড়কর্তা তিনি, পরিচয় ব্যক্ত করে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আর বলবেন না স্যার নাকালের একশেষ। হায়ার অথরিটির ডাকে রাজধানীর উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম ভোর ভোর। খবর পেয়ে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরছি। পথ্যিমধ্যে রেল ক্রসিংয়ের জ্যামে আটকে পড়ায় দেরি হয়ে গেল।
এরপর পুলিশ অফিসার রেঞ্জারকে অপেক্ষা করতে বলে, উপস্থিত মানুষজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মেয়েটির পরিচয় ইত্যাদি সমন্ধে ধারণা পেতে ব্রতী হলেন। কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। সবার এক কথা, মেয়েটিকে তারা আগে কখনও এখানে দেখেনি।
অফিসার লাশ মর্গে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে রেঞ্জারকে ডেকে, এখানকার নিয়মকানুন নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।
একটা লোক ভ্যানরিক্সার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, সেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি। রেঞ্জারের সঙ্গে ডায়ালগ শেষ করে পুলিশ অফিসার গাড়িতে উঠে বসলে তিনি এগিয়ে গেলেন, স্যার মেয়েটিকে আমি গতকালের শেষ বাস থেকে নামতে দেখেছি।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন অফিসার। ডায়েরি বের করে লোকটির নাম-ধাম-পেশা, ইত্যাদি টুকে নিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটি আপনার দোকানে আসে তখন কী ওর সঙ্গে কোন লাগেজ, আই মিন ব্যাগট্যাগ কিছু ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি কোন উত্তর দিল না। একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বলল, ট্রলি ব্যাগের রং ডিপ গ্রীন। আর পিঠেরটা….! সম্ভবত ছাই কালারের, সঠিক মনে করতে পারছি না স্যার।
দোকানির মাল বেচা নিয়ে গরজ। খদ্দের কোথেকে আসছে, কী পরে আছে বা তার সঙ্গে কী সব জিনিসপত্র আছে, লক্ষ্য করার দায় নেই। তবুও তিনি খেয়াল করেছেন। বিশেষ কোন কারণ ছিল কী, নাকি যুবতী সুন্দরী বলে তার প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন? অফিসার জানতে চাইলে লোকটা বলল, চেহেরা দেখে কী আর পেট ভরবে স্যার? আসলে সে সময় দোকানে অন্য কাস্টমার ছিলো না।
বেশকিছু উৎসুক মানুষ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দোকানির কথপোকথন শুনছিল। দেবু-রা ভিড়ে মিশে ছিল। পুলিশের জিপ চলে যেতে সেখান থেকে সরে এসে দেবু বলল, কি বুঝলি?
বেলা হয়েছে অনেকটা। হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে পর্যটকরা ঘুরতে শুরু করেছে। রাস্তার ধারের স্টলগুলো পসরা সাজিয়ে বসেছে – চা-বিস্কিট, ঘুগনি-পরোটা, মুড়ি-তেলেভাজা। ঘুরছে ফেরিওয়ালারা, কারো কাছে আছে ভাজা বাদামের ডালি, কারো কাছে ঝালমুড়ির টিন। ছোটদের খেলনাপাতি নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল দুজনকে। রাস্তা এখন আর ততটা ফাঁকা নেই। দেখেশুনে পাশ কাটিয়ে এগোতে হচ্ছে।
অ্যাকুরিয়ামের কাছাকাছি এক ফেরিওয়ালা এগিয়ে এল, টাটকা ভাজা বাদাম আছে। দেব বাবু?
আকাশের মাথায় যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল। প্রথমত তার মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না। তারওপর এই মুহূর্তে ঠিক কী করণীয় স্থির করতে না পেরে ভীষণ অসহায় বোধ করে সে। এই অবসরে ফেরিওয়ালা দ্রুত হেঁটে গিয়ে অ্যাকুরিয়ামের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরের পর্বে…