(চতুর্থ পর্ব)
বাংলার পশ্চিমপ্রান্তে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া দেবীপুর একসময় ছিল রুক্ষশুষ্ক অনুর্বর ভূমি। ছোট ছোট টিলা আর কাঁটা জাতীয় গাছ বুকে নিয়ে ছিল তার অবস্থান। হঠাৎ করে এলাকাটি সরকারের নজরে আসে।বনসৃজন প্রকল্পের আওতায় এনে শাল সেগুন শিশু মহুয়া, ইত্যাদি নানা প্রজাতির চারা রোপন করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় জল সেচের। কয়েক বছরের ব্যবধানে সবুজে ঢেকে যায় চারিদিক।
বছর পাঁচেক হল জায়গাটিকে সাজিয়েগুছিয়ে পর্যটন কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে চিড়িয়াখানা, রঙিন মাছের অ্যাকুরিয়াম, পিকনিক স্পট, কৃত্রিম ঝর্ণা। বোটিং সুইমিং উপভোগ করার জন্য কাটা হয়েছে জলাশয়। তবে দেবীপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আইটেম হল হর ও পার্বতী নামক টিলাদ্বয়। তুলনামূলক আকারে বৃহৎ টিলা দুটিকে আধুনিক প্রযুক্তি সাহায্যে গুহায় রূপান্তরিত করে, হর-এর আকাশ সাজানো হয়েছে কৃত্রিম তারামণ্ডলী দিয়ে। আলোর সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দেখান হয় সেখানে। পার্বতীর দেওয়ালে বসানো হয়েছে অজন্তা ইলোরা গুহাচিত্রের রেপ্লিকাসমূহ। বেসরকারি উদ্যোগপতিরাও পিছিয়ে নেই। বিনোদনের নানা পসরা নিয়ে তারাও হাজির। সব মিলিয়ে দেবীপুর জমজমাট।
বনভূমিতে পদার্পন করার আগে একটি ছোট টিলার অবস্থান। টিলার অতিক্রম করে এসে থমকে দাঁড়াল আকাশ। কমবেশি একশ মিটার দূরে কৃত্রিম জলাশয়, সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড়। খাকি পোষাকের পুলিশের উপস্থিতি ও চোখে পড়ল।
সকাল দশটার আগে কোন প্রদর্শনী শুরু হয় না। অবশ্য বোটিং সুইমিং উপভোগ করতে চাইলে সকাল সকাল জলে নামার সূযোগ আছে। কিন্তু পুলিশ কেন? কিছুটা কৌতুহল, বাকিটা রোজের আকর্ষণ আকাশকে টেনে নিয়ে চলল ভিড়ের দিকে। ভিড়ের মাঝে থাকলেও থাকতে পারে রোজ।
কিছুটা যেতে না যেতে আমজাদ এসে সঙ্গী হল। – রোজ কোথায়?
দ্রুত হাঁটছিল আকাশ। ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আমজাদের দিকে ফিরে বলল, সে রোজ নয়?
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না আমজাদ। দেবুর চিৎকার ভেসে এল, এই আকাশ, এই আমু। দাঁড়া দাঁড়া।
পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াল দুজনে। চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে দেবু।
আমজাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার অবকাশ পেল না আকাশ। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হল দেবু।
এই অবসরে দেবু কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে আকাশ বলল, এতকিছুর ঘটে যাবার পরেও তোকে আমাদের পিছনে আসতে হল কেন?
সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বলল না। একটু বাদে আমজাদ বলল, দিন দিন দেশটা বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই দেশে। সহপাঠী সহকর্মী আত্মীয় বন্ধু কারও কাছে নিরাপদ নয় মেয়েরা।
থামল আকাশ। তারপর পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে বলল, এই যে দেবু আমাদের ওখানে যেতে বারণ করছে, এ ও একপ্রকার নিষ্ঠুরতা। বিপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, সমাজবদ্ধ জীবনে এতটুকু আশা করা কি অন্যায়? তা না করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে পালিয়ে যাওয়া….
জলাশয়ের পাড়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ করে দেবু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, একাটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি রাস্তায়।
-কী জিনিস? আকাশ জিজ্ঞাসা করল।
দেবু পকেট থেকে একটি সোনার বালা বের করলে আকাশ চট করে সেটা তার হাত থেকে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল। দেখছিল আমজাদ ও। সে বলল, আকাশ এটা সেই ছেলেটার না?
আমজাদ টিকটিকির মতো মাথা দোলাল। দেবু কিছু বলতে গিয়েও বললো না। আকাশ বলতে থাকল, এমন নয়তো জলাশয়ে পাওয়া লাশের সঙ্গে এটা….
আকাশ তাড়া দিলে দেবু বলল, আমি রিসোর্টে ফিরে যাচ্ছি।
আমজাদ বন্ধুবৎসল প্রচলিত একটা খিস্তি দিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আকাশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, মাথা গরম করিস না ডিয়ার। জানিসতো ও ওরকমই। তারপর দেবুকে কাছে টেনে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমরা তো আর গিয়ে গিয়েই পুলিশের হাতে ধরা দিচ্ছি না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। যদি দেখা যায়….
থামল আকাশ। ক্ষণেকের বিরতি নিয়ে পুনরায় বলতে থাকল, একান্তই যদি আমাদের পুলিশের স্মরণাপন্ন হতে হয়, আর তারা জানতে চায় বালাটা কোথায় কী অবস্থায় পাওয়া গেছে। যেহেতু জিনিসটা তুই কুড়িয়ে পেয়েছিস, উত্তর তোকেই দিতে হবে।
দেবু রা কাড়ল না। আকাশ বলতে থাকল, এখান থেকে পালালে হয়তো সাময়িকভাবে ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যখন একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ কী সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? কখনই না। হোটেল রিসোর্টের রেজিস্টার খতিয়ে দেখে সাকল সকাল যারা চলে গেছে তাদের পিছু ধাওয়া করবে। তাছাড়া তিনদিনের জন্য রুম বুক করা হয়েছে। সেখানে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কেন রিসোর্ট ছেড়ে চলে এলাম, পুলিশ জানতে চাইলে কী উত্তর দিবি?
এবারেও দেবু নিরুত্তর। আমজাদ বলল, এ্যাজ আ রেসপনসিবিল সিটিজেন উই সুড কোঅপারেট উইথ পুলিশ। তাতে করে হয়তো কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু ফেঁসে যাবার ভয় থাকবে না।
(পরের পর্বে…)