(গুরুজী ভীমসেন যোশীকে মনে রেখে)
অলীক কাল পুরুষ
অপূর্ব গান রাখো এই ত্রস্ত বনতলে। রাখো এই উদ্ভিন্ন করবী শাখায়। রাখো এই আলোকিত আকাশের গায়ে।
দ্যাখো ওই গানরত মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে হিমালয় পর্বতের উপর। বাহুমূলে চূর্ণ আহত সাক্ষাৎ ঈশ্বর চেতনায় পূর্ণ।
প্রতিদিন সূর্যের সপ্তরথ ভেঙে পরে সমুদ্র জোয়ারে।
সন্ধ্যার উপকুলের কিছুটা বাইরে।ঠিক ঝলকানো কাঁপা বিদ্যুতের মতো পূর্ণিমার মেঘ ভেঙে ওদের মহা প্রস্থানে মাস্তুলের হাহাকার মিশেছে দরবারি কানাড়ায়।কম্পিত ঘুমের পাশে বালুময় ঝোড়ো রাত আর খরতর সাগরের গান জেগে আছে।
এই সীমাহীন জলরাশির দিকে চেয়ে থাকলাম।আর অযুত বছরের স্বপ্নের গভীরে আঙুল ডুবিয়ে অধিকার চাইলাম সেই জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষটির কাছে।
নাম কী তার!
কী যেন নাম তার?
হ্যাঁ! ওই তো ভীমসেন গুরুরাজ যোশী।
নাম শ্রবণের পর স্রোতস্বিনী অর্চণা ভেসে গেল দিক বিদিক।
সহজ, শব্দহীন কুণ্ঠা রোধ করে শোনা যাবে উচ্চ এই মার্গীয় দোয়েলের শিস, একটি অরণ্য পাখির ডানা মেলে উড়ে যাওয়া সাদা আকাশের গায়ে।তন্দ্রালুচোখে অর্ধ নিমীলিত সুরে আকাশের নীলে,
সোনার পাখিটির উদ্বেলিত সুর জেগে আছে
অন্তিম আলোর কাছে।
মহাশূন্যে উড়ে যাচ্ছে উজ্জ্বল ফেনার ঢেউ।
আমীর খসরুর ছায়া পড়ে তার মুখে। সে গায় মহামূল্যবান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। জানালার ভিতর দিয়ে ঘন মেঘের সারি সারি নিস্পন্দ আকাশ নৌকা।দাঁড়িয়ে থাকা বাষ্পলিপ্ত আশা। নিচে উদ্দাম শ্রোতা। অনন্ত জানালার পাশে বসে সে গাইতে থাকে গজল, ঠুমরি, ধ্রুপদ, ধামার, কাজরী, টপ্পা।
আহা! এ গানের রেশে ভাললাগার বাতাস লাগে পালে। স্রোত জাগে, ধনি জাগে, জাগে রাগ কিরানা।
ঘন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় চন্দ্রবিগলিত হলুদ বর্ণের জল। সোনা! শুধুই সোনা! বুকের মাঝে ঝরে স্বর্ণরেণু এই বুকের মাঝে, সমুদ্র সৈকতে।
আকাশ ও মেতে উঠল গানে গানে।
এবার বলো হে গায়ক বলো! এখন তাহলে এই আকাশের গর্জন নির্জনতার মোহভঙ্গের কী পদ্ধতি তুমি জানো? আসলে তাকে তুমি সম্মোহন পদ্ধতিতে বশ করেছ। এ কোন অপরূপ সঙ্গীত মুর্ছনায়? বলো গায়ক! পাখিদের বাড়ি ফেরার আকাশ ও আজ ভীষণ আন্দোলিত। মেঘমন্দ্র নাদের পাশে রেখে এসো তার চঞ্চল পদস্খলন।
নীরব বাতাসের স্মৃতিমেদুরতায় বাজছে রম্যবীণা।
হারমোনিয়াম, সারেঙ্গী। মিলে যাচ্ছে সুর। কিন্নর কিন্নরী তার অদ্ভুত পদচারণায় মিলিয়ে নিচ্ছে আবহ।
জেগে উঠছে ভোরের স্বনন, ভাষার দীপ্তকণ্ঠ, অচিন্তিত আত্মনির্ভর মর্মর ধ্বনি দিগন্ত বিস্তৃত।
বিস্তীর্ণ আলোক ছটা দাঁড়িয়ে পড়ে যেন এক বিশালাকার আলোকস্তম্ভ। গানের বই, খাতা, সঙ্গীত প্রণালী ভেসে আসছে কানে।
গান ধরে ওই তিনি চলেছেন ছুটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ক্লান্তিহীন। যেন জ্যা মুক্ত পৃথিবীতে ধেয়ে আসা নক্ষত্র
উড়ে আসছে গ্যালাক্সি থেকে।
এই রকম চৈতন্যে স্রোতস্বিনী আছে কিনা জানা নেই।
শুধু তরঙ্গ আছে, আছে আলোড়ন। যে আলোড়ন শুরু হয়েছিল ১৯২২ এর এক কর্ণাটকী হাওয়ায়, শেষ হয়েছিল ২০১১য়।হারমোনিয়ামে, তানপুরায়, ব্যান্ডে, পথে পথে তার বিশাল বিমুক্তি। মাঝে মাঝে ছড়িয়েছিল মণিমুক্তা।
পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ,পদ্মশ্রী,কর্ণাটক রত্ন, ভারত রত্ন।
আমাদের পাহাড়ের গান ভেসে আসছিল মাত্র ১৯ টি বৎসর যাপনের পর থেকেই। লৌকিকতা এসে মারাঠি, হিন্দীতে মুখ ধুয়েছিল এই গানপ্রিয় পাগলটির কাছে, শ্বেত পদ্মপাতায় ফোটা শ্বেত পদ্মের মতো।
নদীর পথ বার বার করেছে অদল বদল, ভেসে গেছে মেঘ পরিদের সঙ্গে উধাও হয়ে। কঠিন ঊর্বশীর উরুর মতো মানবতা ডেকেছে হননের জলে তার শ্রেষ্ঠ আকুতি ভেদ করে গনিকার উল্লোল সঙ্গীতে ভর করে সাবলীল দীর্ঘতম গাছেদের ক্রম বর্ধমান পথরেখা ধরে।
কাশের বনে শোনা যায় নির্জন বিবর্ণ দ্বীপে পাতা উড়ে যাবার শনশন শব্দ।
এখনো সারেঙ্গীতে বাজে কিরাণা। বাজে ইন্দ্রায়নী কাঠি। রাগ রাগিনীর অপূর্ব সমাধি। খোলা পাতায় উড়ে যাচ্ছে অক্ষরমালা আর স্থপতি ভাস্কর্যে ফুটে উঠছে তোমার আমার সুর।
নেপথ্যে তিনিই গেয়ে উঠলেন—
” মিলে সুর মেরা তুমহারা
তো সুর মিলে হমারা”।