স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরে ও সারা রাজ্যের মধ্যে পিছিয়ে থাকা জেলা মুর্শিদাবাদ। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য, অনাহার, খরা, বন্যা, বেকারত্ব এই জেলার মানুষের নিত্য সঙ্গী। জীবনে চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই জেলার বাসিন্দারা সর্বত্র পিছিয়ে আছেন। জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন । এই উদ্যেশ্য ও লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব যা গৃহীত ও বাস্তবায়িত হলে জেলার কিছু সাধিত হবে বলে মনে করি। মুর্শিদাবাদ জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখছি।
রাজ্যের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদ অন্যতম। ফারাক্কা থেকে জলঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ৯৫ কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশ সীমানার অন্তর্ভুক্ত । তারপরে নদীয়া জেলার কিছু অংশের অবস্থান। এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ ও চাষবাস। মুর্শিদাবাদের উত্তর দিকের একটা বড় অংশের মানুষ বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। জেলায় কোন বড় বা বৃহৎ শিল্প নেই। জেলার বহু মানুষ কাজের প্রয়োজনে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে কৃষিকাজও তেমন লাভজনক নয়। এই অবস্থায় কৃষি ও কৃষকের উন্নতি সাধন করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। জলসেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, লাভজনক চাষের জন্য উন্নতপদ্ধতির কৃষি প্রশিক্ষন, শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কৃষিকাজেে আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদ জেলায় কল্যানী বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পৃথক ক্যাম্পাস গড়ে তোলা যেতে পারে। তা করা সম্ভব হলে জেলার বহু ছাত্রছাত্রী কৃষি বিষয়ক পাঠ্যক্রম ও প্রশিক্ষন গ্রহণ করতে পারবে। কৃষকদের ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা রাখা জরুরী।
জেলার প্রধান নদী গুলির সংষ্কার ও নদীবাঁধ সমূহের মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলার অন্যতম ভৈরব নদীর একটা বড় অংশ হয় মজে গেছে নতুবা বিভিন্ন এলাকায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। এই ভৈরব নদীর অনেকাংশ জুড়ে এক সময় “রিভার পাম্প” / “রিভার লিফট ” চালু ছিলো। নদীর জলের অপ্রতুলতার কারণে ঐ সব রিভার পাম্পের প্রায় কোন অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়াও কৃষি সেচের জন্য বিভিন্ন এলাকায় “”গুচ্ছ টিউবওয়েল ” ব্যবস্থা চালু ছিলো। কৃষি ও সেচ বিভাগের তদারকিতে ঐ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হোক। মজে যাওয়া মৃত প্রায় ভৈরব নদীর আমূল সংষ্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বিশেষ জরুরি। এই ভৈরবনদীর জলেই জেলার কৃষকদের বৃহৎ অংশের জলসেচের চাহিদা পূরণ হতো। কৃষি উপযোগী নতুন ক্যানেল গঠন ও পুরনো ক্যানেলের সংষ্কার ও করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার এত বছর পরে ও মুর্শিদাবাদ জেলায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না , এটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক। প্রস্তাবিত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সময়োপযোগি বিষয়ক পঠন পাঠনের কাজ শুরু করা ভীষণ জরুরি। তা ছাড়া প্রত্যেকটি ব্লক এলাকায় একটি করে জেনারেল ডিগ্রি কলেজ ও কারিগরী কলেজ করা প্রয়োজন। যদি ব্লক বা থানা এলাকায় কলেজ স্থাপনা সম্ভব হয় তবে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জেলায় প্রভূত উন্নতি সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয় শিক্ষার ও উন্নতিসাধন করতে হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ভগবানগোলা ও রানীতলা থানা নিয়ে ভগবানগোলা ১নং ও ২নং ব্লক, দুটো ব্লক, দুটো থানা এলাকায় অথচ একটি ও কলেজ নেই। অবিলম্বে ভগবানগোলায় একটি ডিগ্রি কলেজ স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
জেলায় কোন বৃহৎ শিল্প নেই। এই জেলায় ব্যাপক পরিমানে পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। পাটজাত শিল্প গঠনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। পাটের পাটকাঠি থেকে শিল্প সংক্রান্ত কোন পরিকল্পনার জন্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের মতামত নিয়ে এগোনো যেতে পারে। জেলার বহু মহিলা ও গৃহবধূরা সূচীশিল্পে বিশেষভাবে পারদর্শী। কিন্তু তা গৃহবন্দী হয়েই থেকে যায়। সংখ্যালঘু অংশের মা বোনেদের মধ্যে কাঁথাশিল্পের কাজে যুক্ত আছেন অনেকেই। অনেকের কাজ একেবারে অতি উৎকৃষ্ট মানের, কিন্তু এই শিল্প ও যথাযথ মর্যাদা পায় না । কিছু মহিলা ” লাটকাটা ” নামক নেট জাল তৈরী করেন। আবার বহু মহিলা বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত । বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজেও সমান পারদর্শী অনেকেই আছেন। উপযুক্ত পরিকাঠামো ও বাজারের অভাবে এই সব কুটির শিল্প কোন মূল্য পায় না । কাঁসা পিতল, ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ির চাকা, হাতির দাঁতের কাজ, রেশম, বয়নশিল্প, মাটির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, মাছ ধরবার উপযোগী বিভিন্ন বাঁশজাত সামগ্রী, তালপাতা, খেজুরপাতার সামগ্রী, কাঠের কাজ, উলবোনা, তাল, খেজুর ও আখের রস থেকে গুড় ও বিভিন্ন মিস্টান্ন ইত্যাদি কাজেও বহু মানুষ যুক্ত আছেন। এই সব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে উন্নতি সাধন করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এই পরিকল্পনার সঙ্গে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়াও ইট ও টালি শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এগুলোর ও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব । এই দুটি ক্ষেত্রে ও বহু মানুষ যুক্ত থাকেন ।
মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় অবস্থিত ভারত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চলাচলের জন্য ” ইমিগ্রেশন ” সেন্টার দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি আদায় করে লালগোলায় বাংলাদেশ চলাচল ও পন্যপরিবহনের ব্যবস্থা করলে ভারত বাংলাদেশ বানিজ্যে আমদানি রপ্তানি গতি লাভ করবে। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ কিম্বা মালদহের মহদিপুরের মতো মুর্শিদাবাদের লালগোলা, ভগবানগোলা অথবা জলঙ্গীতে এই রকম ভারত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বানিজ্য কেন্দ্র চালু করা যেতে পারে । এর ফলে জেলার প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে ।
জেলার যে সমস্ত গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ হয়ে ওঠে নি সেই সব এলাকায় উপযুক্ত ভোল্টেজ সহ বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক এলাকায় এখনো কাঁচা মাটির রাস্তা আছে। ঐ সব রাস্তাগুলিকে পাকা অথবা কংক্রিট করতে হবে। এই কাজে মাননীয় বিধায়ক ও সাংসদদের এলাকা উন্নয়ন তহবিলকে কাজে লাগানো যেতে পারে । গণপরিবহন উন্নয়নে জেলা জুড়ে ব্যাপক ও বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জেলার যে সমস্ত রুটে সরকারি বাস চালু নেই, সেই সব রুটে সরকারি বাস চালু করতে হবে। সরকারি বাসরুট চালু হলে সাধারণ মানুষ সরাসরিভাবে সরকারি পরিষেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
জেলার রেলপথ উন্নয়নে শিয়ালদহ লালগোলা লাইনে বহরমপুর থেকে করিমপুর ( ভায়া জলঙ্গী – ডোমকল ) পর্যন্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবী করা হোক। জেলার ঘোড়ার গাড়ি বা টাঙ্গা শিল্প বর্তমানে প্রায় মৃত ও হারিয়ে যেতে চলেছে। টাঙ্গাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথা ভেবে এই শিল্পের উন্নয়নেে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
জেলার প্রতিটি ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলিতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে , চিকিৎসক, নার্স, আশা কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামের যে সমস্ত অপ্রশিক্ষিত ও অপেশাদার ব্যক্তিত্ব যাদের মধ্যে অনেকেই শুধু অভিজ্ঞতার নিরিখে বেশ ভালোই প্রাথমিক চিকিৎসা করেন, তাদেরকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ বা তেমন কোন উপযুক্ত সংস্থা থেকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা পরিষেবায় কাজে লাগানো যেতে পারে । ২ টি ৩ টি ব্লক নিয়ে একটি করে স্টেট জেনারেল হাসপাতাল স্থাপনের ব্যবস্থা করা হোক । জনস্বাস্থ্য উন্নয়নেে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েড, এইডস, চিকনগুনিয়া, সার্শ ও বিভিন্ন ভাইরাসজনিত অসুখ মূলত করোনা জাতীয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে
গণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, ক্লাব প্রতিষ্ঠানসমূহ, এন.জি.ও. এবং বিদ্যালয় গুলি ও এই প্রচার কর্মসূচিতে ভূমিকা নিতে পারে ।
গ্রাম বাংলার প্রায় হারিয়ে যেতে চলা লোক ক্রীড়া গুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও স্থানীয় ক্লাব – পাঠাগারগুলিতে চালু করে এই পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে । লাঠিখেলা, চু কিত কিত, হা ডু ডু, কবাডি, কুমির ডাঙা, পিট্টু, মুরগি লড়াই, ওপেনটি বায়োস্কোপ, এক্কা দোক্কা, ডাংগুলি, খেটে খেলা, বাঘ বন্দী, ষোল ঘুটি, রাম রাবন, রুমাল চুরি, চিক্কা, লাফ দড়ি, দড়ি টানাটানি, বস্তাদৌড়, চোর পুলিশ, এলাটিং বেলাটিং, রান্নাবাটি, পুতুলের বিয়ে প্রভৃতি লোকখেলা গুলি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় জানেই না বলা যায় । গ্রামে অনেক ভালো মানের ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিভা প্রষ্ফুটিত হওয়ার আগেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে অচিরেই হারিয়ে যায়। এই সব প্রতিভাকে তুলে এনে তাদেরকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে ডানা মেলার সুযোগ করে দিতে হবে ।
মুর্শিদাবাদ জেলার বিখ্যাত কবিগান , আলকাপ, পঞ্চরস, বোলান গান, জারিগান, সারিগান, মুসলিম বিয়ের গান, চাঁই সম্প্রদায়ের নিজস্ব গোষ্ঠীর গান, মনসা মন্ঙ্গল, কীর্তন, ছাদ পেটানোর গান, বিভিন্ন শ্রমসঙ্গীত, ছাদনাতলার গান , এসব ও প্রায় হারিয়ে যেতে চলেছে। কবিগান, আলকাপ ও মুসলিম বিয়ের গানে এ জেলার কয়েকজন স্বনামধন্য শিল্পী এখনো বিদ্যমান ।
বর্তমানে এ জেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নজরুল গীতি, আধুনিক গান ও হিন্দি গানের ও বহুল চর্চা পরিলক্ষিত হয়।
জেলা, মহকুমা ও ব্লকস্তরের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মাধ্যমে জেলার প্রত্যন্ত এলাকার সুপ্ত প্রতিভা গুলোকে খুঁজে আনবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ক্লাব ও পাঠাগার গুলির উন্নয়ন সাধন করে ছাত্র ছাত্রীদের সংস্কৃতি মনস্ক ও পাঠাগারমুখী করবার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে । বিদ্যালয় ও ক্লাবের খেলার মাঠগুলির সংস্কার করে ছাত্র ছাত্রী, কিশোর কিশোরী ও যুবক যুবতীদের মাঠমুখী করতে হবে । রাজ্যে কয়েকটি উন্নয়ন পর্ষদ রয়েছে। যেমন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ, শিলিগুড়ি – জলপাই গুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ, সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ, বোলপুর শ্রীনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ, ঝাড়গ্রাম জঙ্গল মহল উন্নয়ন পর্ষদ, হাওড়া ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ইত্যাদি সংস্থা এলাকার উন্নয়নে স্বতন্ত্রভাবে তাদের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে এই জেলার জন্য একটি উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা হলে জেলার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব । এই উন্নয়ন পর্ষদ গঠিত হলে তারা জেলার সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার রুপায়ন করতে পারবে। তার ফলে সারা মুর্শিদাবাদ জেলায় যে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব ও সুনিশ্চিত হবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। তাই এই নিবন্ধের মাধ্যমে এই সব প্রস্তাবসমূহ পেশ করছি। আশা করি জেলাবাসীর পক্ষে আমার এই প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হবে। রাজ্যের ও জেলার সামগ্রিক উন্নয়ননের স্বার্থে এই প্রস্তাব গৃহীত ও বাস্তবায়িত হলে মুর্শিদাবাদ জেলায় উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।