প্রবন্ধ: বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত।। রানা চক্রবর্তী।। অশোকনগর কল্যানগড়।। উ:২৪ পরগণা - শৃণ্বন্তু প্রবন্ধ: বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত।। রানা চক্রবর্তী।। অশোকনগর কল্যানগড়।। উ:২৪ পরগণা - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৩ পূর্বাহ্ন

প্রবন্ধ: বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত।। রানা চক্রবর্তী।। অশোকনগর কল্যানগড়।। উ:২৪ পরগণা

আপডেট করা হয়েছে : বুধবার, ১৯ জুন, ২০২৪, ৬:৪৪ পূর্বাহ্ন
প্রবন্ধ: বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত।। রানা চক্রবর্তী।। অশোকনগর কল্যানগড়।। উ:২৪ পরগণা

প্রবন্ধ: বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত

লেখক: রানা চক্রবর্তী

বাংলা পদ্যে গদ্যছন্দর ইতিবৃত্ত
 
অতীতের কোন একসময়ে প্রশ্ন উঠেছিল যে— গদ্য দিয়ে কি কোনভাবে কবিতা রচনা করা সম্ভব? সাধারণভাবে সাহিত্যের সাথে পরিচিত প্রায় সকলেই অবগত রয়েছেন যে, শব্দকে ছন্দের নিগড়ে বাঁধলে তবেই পদ্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু গদ্যকে যেহেতু কোন ছন্দে বাঁধা সম্ভব নয়, সেহেতু গদ্যের মাধ্যমে কিভাবে কবিতা রচনা করা সম্ভব, সেটা নিয়ে অতীতের কোন একসময়ে দীর্ঘকালব্যাপী বিতর্ক চলেছিল। এমনকি আজও যাঁরা গদ্য-কবিতা বা গদ্য-ছন্দে রচিত কবিতা পছন্দ করেন না, তাঁরা তাঁদের আপত্তির প্রধান কারণ হিসেবে একথাই বলে থাকেন। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস বলে যে— অতীতে গদ্যেও কবিতা রচনা হয়েছিল। বিভিন্ন সাহিত্য গবেষকদের মতে, গোড়ার দিকে বাইবেল পদ্যে রচনা করা হলেও ইংল্যাণ্ডে রেনেসাঁস চলবার সময়ে বাইবেলের যেসব প্রামাণ্য ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু গদ্যেই করা হয়েছিল; এবং ‘verse’ হিসাবে সেই গদ্যকে মেনে নিতে কেউ কোন আপত্তি করেননি। এরপরে আমেরিকার কবি হুইটম্যান যখন—
“Of life immense in passion, pulse and power
Cheerful for the freest action
               formed under the laws divine,
—The Modern Man I sing.”
লিখেছিলেন, তখনও সেটাকে কবিতা বলেই সকলে মনে নিয়েছিলেন। বাঙালি কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ গদ্যে করা হলেও ইউরোপের সাহিত্যপ্রেমী ও কাব্যরসিক সমাজ কিন্তু সেটাকে পদ্য বলে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। তাই বাংলা ভাষাতেও গদ্যের ছাঁদে কবিতা রচনা করা সম্ভব।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অমিত্রাক্ষর ছন্দের রচনা করে মধুসূদন দত্ত যেমন পয়ারের শক্তপোক্ত বন্ধন থেকে বাংলা কাব্যকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনি প্রচলিত সমস্ত রকমের ছন্দের বন্ধন থেকে বাংলা কাব্যকে মুক্ত করেছিলেন। গবেষকদের মতে বাংলা ভাষায় গদ্যের চালে কবিতা রচনা করবার সমস্ত গৌরব রবীন্দ্রনাথেরই প্রাপ্য এবং একইসাথে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে— বাংলা সাহিত্যের এই পর্যায়ে তাঁকে অতিক্রম করে যাওয়ার ক্ষমতা এখনও পর্যন্ত অন্য কোন বাঙালি কবি দেখাতে পারেননি। সব গবেষকই যেহেতু রবীন্দ্রনাথকে যখন বাংলা কাব্যে গদ্যছন্দের প্রবর্তক বলে স্বীকার করে নিয়েছেন, সেহেতু এবিষয়ে তাঁর নিজের কি বক্তব্য ছিল, সেটা জানাও জরুরি। গদ্যছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বক্তব্য তাঁর বিভিন্ন রচনা চিঠিপত্রগুলিতে পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ।
এপ্রসঙ্গে ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন—
“গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। সেই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মত বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা। পরীক্ষা করেছি, লিপিকার অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে। গদ্য কাব্যে অতি-নিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্য-কাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠন প্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। ২ আশ্বিন ১৩৩৯।”

 

গবেষকদের মতে কবিগুরু তাঁর ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থকে প্রথম বাংলা গদ্য কবিতার ঐতিহাসিক নমুনা হিসাবে দাখিল করলেও এটির সূচনা মূলতঃ তিনি তাঁর ‘লিপিকা’ কাব্যগ্রন্থের রচনাগুলি থেকে করেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। তবে ছত্রগুলি সেখানে কবিতার ছত্রের মত সাজানো ছিল না। কিন্তু ‘লিপিকা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিকে পদ্যে সাজালেও কোন ইতর বিশেষ হয় না। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে এবং একই সঙ্গে গদ্য কবিতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি পত্রে জানিয়েছিলেন—
“যখন কবিতাগুলি পড়বে তখন পূর্বাভ্যাস-মতো মনে কোরনা ওগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ট হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি পদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিৎ। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মত ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়ের সৌন্দর্য নয়— এই সহজ কথাটা বলবার প্রয়াস পেয়েছি পরবর্তী পাতাগুলিতে। ২৬ আশ্বিন ১৩৩৯।”
১৯৩২ সালে এই একই প্রসঙ্গে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে লিখিত আরেকটি পত্রে তিনি জানিয়েছিলেন—
“গদ্যের চালটা পথে চলার চাল, পদ্যের চাল নাচের। এই নাচের গতির প্রত্যেক অংশের মধ্যে সুসংগতি থাকা চাই; যদি কোন গতির মধ্যে নাচের ধরণটা থাকে অথচ সুসংগতি না থাকে তবে সেটা চলাও হবে না, নাচও হবে না, হবে খোঁড়ার চাল অথবা লম্ফঝম্প। কোনো ছন্দে বাঁধন বেশি, কোনো ছন্দে বাঁধন কম; তবু ছন্দমাত্রের অন্তরে একটা ওজন আছে সেটার অভাব ঘটলে যে টলমলে ব্যাপার দাঁড়ায় তাকে বলা যেতে পারে মাতালের চাল, তাতে সুবিধাও নেই, সৌন্দর্যও নেই। ২২ জুলাই ১৯৩২।”
১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৮শে আশ্বিন তারিখে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে লেখা আরেকটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন—
“গদ্যকে গদ্য বলে স্বীকার করেও তাকে কাব্যের পঙক্তিতে বসিয়ে দিলে আচার বিরুদ্ধ হলেও সুবিচার বিরুদ্ধ না হতেও পারে যদি তাতে কবিত্ব থাকে। ইদানীং দেখছি গদ্য আর রাশ মানছে না, অনেক সময় দেখি তার পিঠের উপর সেই সওয়ারটিই নেই যার জন্যে তার খাতির। ছন্দের বাঁধা সীমা যেখানে লুপ্ত সেখানে সংগত সীমা যে কোথায় সে তো আইনের দোহাই দিয়ে বোঝাবার জো নেই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি স্বাধীনতার ভিতর দিয়েই বাঁধন ছাড়ার বিধান আপনি গড়ে উঠবে— এর মধ্যে আমার অভিরুচিকে আমি প্রাধান্য দিতে চাইনে। নানারকম পরীক্ষার ভিতর দিয়ে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠছে। সমস্ত বৈচিত্রের মধ্যে একটা আদর্শ ক্রমে দাঁড়িয়ে যাবে। আধুনিক ইংরেজি কাব্যসাহিত্যে এই পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে।”

 

গদ্য কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত উদ্ধৃতিগুলি থেকে বোঝা যায় যে— পদ্যছন্দে ভাবপ্রকাশ করবার ভঙ্গীগুলিকে ছন্দের বন্ধনে বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলে—
“তারা সেই ছন্দের শাসনে পরস্পরকে যথাযথভাবে মেনে চলে বলেই তাদের সুনিয়ন্ত্রিত সম্মিলিত গতিতে একটি শক্তির উদ্ভব হয়, সে আমাদের মনকে প্রবল বেগে আঘাত দিয়ে থাকে। এর জন্যে বিশেষ প্রসাধন, আয়োজন বিশেষ রঙ্গমঞ্চের আবশ্যক ঘটে।”
কিন্তু— এই ছন্দের বাঁধন যদি খুলে দেওয়া হয় বা সেটার প্রসাধন যদি সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেও ভাবপ্রকাশ করতে খুব একটা অসুবিধা যে হবে না, এটাই কবিগুরুসমেত সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্য গবেষকদের বক্তব্য। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা থেকেই এবিষয়ের একটা উদাহরণ নেওয়া যাক।
একজন লাবণ্যময়ী রমণীর বাইরের প্রসাধন এবং অলঙ্কার সহযোগে নৃত্য নিশ্চই সুন্দর এবং বিশিষ্ট। কিন্তু যদি তাঁর প্রসাধন সরিয়ে নেওয়া হয়— তাহলেও তাঁর লাবণ্যের কিন্তু কোন ক্ষতি হবে না। কোন লাবণ্যময়ী রমণীর দেহভঙ্গী যদি সুন্দর হয়, তাহলে নৃত্য করলেও তাঁকে যেমন সুন্দর দেখাবে, তেমনি তিনি হাঁটলেও তাঁকে সুন্দর দেখাবে। আসল বস্তুটি হচ্ছে সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য যদি স্বাভাবিকভাবে তাঁর সর্বাঙ্গে থাকে তাহলে প্রকাশভঙ্গী বিভিন্ন হলেও রসের আবেদন সৃষ্টিতে কোন ইতরবিশেষ ঘটে না। হরিণের দৌড়ে যাওয়া দেখতে সুন্দর এবং মধুর; তাতে একটি বিশেষ ছন্দ রয়েছে। কিন্তু শিকারের পিছনে তাড়া করে দৌড়ানো চিতাবাঘের দৌড়ও কি সুন্দর নয়! চিতাবাঘের সেই বলিষ্ঠ দেহভঙ্গীর দৃঢ় প্রকাশের মধ্যে একটা আলাদা চাল রয়েছে, যা দর্শকের চোখ এবং মনকে তৃপ্ত করে।
সুতরাং— এথেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, কোন রচনার বক্তব্য বিষয় যদি সুন্দর হয়, যদি তাতে কাব্যের উপাদান থাকে— তাহলে সেটাকে ছন্দের নূপুর পরিয়ে নাচিয়ে দিলে যেমন সুন্দর লাগবে, তেমনি গদ্যের রাজপথে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেও কম কিছু সুন্দর লাগবে না। কিন্তু আসল কথা এবং বারবার মনে রাখবার মত কথা হল যে—
“এই জাতের কবিতায় গদ্যকে কাব্য হতে হবে। গদ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কাব্য পর্যন্ত পৌঁছাল না এটা শোচনীয়। দেব সেনাপতি কার্তিকেয় যদি কেবল স্বর্গীয় পালোয়ানের আদর্শ হতেন তাহলে শুম্ভ নিশুম্ভের চেয়ে উপরে উঠতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর পৌরুষ যখন কমনীয়তার সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখনই তিনি দেবসাহিত্যে গদ্য কাব্যের সিংহাসনের উপযুক্ত হন।”
সাহিত্য সমালোচকদের মতে— রসাত্মক বাক্যই হচ্ছে কাব্য। সেটাকে যদি পদ্যে বলা হয় তাহলে সেটা— পদ্যকাব্য, আর গদ্যে বললে— গদ্য কাব্য হবে। পদ্যে লিখলেই কবিতা ভালো হবে আর গদ্যে লিখলে সেটা কাব্যরসিক সমাজের জন্য অনুপযুক্ত— এমনটা কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ রবীন্দ্রনাথেরই পদ্যে লেখা একটি কবিতা এবং সেটারই গদ্যে রূপান্তর দেখানো যেতে পারে, যেটা থেকে একথা প্রমাণিত হবে যে— কাব্য রচনা করবার ক্ষেত্রে বাহন মুখ্য নয়, ভাবই মুখ্য।
রবীন্দ্রনাথের ‘নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতাটির পদ্যছন্দ এরকম—
“হুংকৃত যুদ্ধের বাদ্য
সংগ্রহ করিবারে শমনের খাদ্য।
সাজিয়াছে ওরা সবে উৎকট দর্শন,
দন্তে দন্তে ওরা করিতেছে ঘর্ষণ,
হিংসায় উষ্মায় দারুণ অধীর
সিদ্ধির বর চায় করুণা নিধির—
             ওরা তাই স্পর্ধায় চলে
               বুদ্ধের মন্দির তলে।
ত্বরী ভেরী বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরো থরো।”
অতীন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থে এটির যে গদ্যরূপ করেছিলেন, সেটা এরকম—
“যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।
ওদের ঘাড় হলো বাঁকা, চোখ হলো রাঙা
      কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।
মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভরতি করতে
বেরোল দলে দলে।
সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়,
বেজে উঠল তূড়ি ভেরী গরগর শব্দে
কেঁপে উঠল পৃথিবী।”
জাপানিদের চীন আক্রমণ করবার সময়ে বুদ্ধভক্তির স্বরূপ দেখানোর উদ্দেশ্যেই কবিগুরু উপরোক্ত ছত্রগুলি লিখেছিলেন। জাপানিদের সেই বুদ্ধভক্তির প্রতি তাঁর নির্মম বিদ্রূপ পদ্যে যেমন শাণিত হয়েছিল, গদ্যেও কিন্তু তেমনি একই রকমের ধারালো হয়েছিল বলে দেখা যায়। তাছাড়া পদ্যটির গদ্য কাব্যেও একটা আবাঁধা ছন্দ দেখতে পাওয়া যায়। এই কারণেই কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
“আন্তরিক প্রবর্তনা থেকে কাব্য সেই ছন্দ (অর্থাৎ গদ্যের আবাঁধা ছন্দ) চলতে চলতে আপনি উদ্ভাবিত করে, তার ভাগগুলি অসম হয় কিন্তু সবসুদ্ধ জড়িয়ে ভার-সামঞ্জস্য থেকে সে স্খলিত হয় না। বড়ো-ওজনের সংস্কৃত ছন্দে এই আপাতপ্রতীয়মান মুক্তগতি দেখতে পাওয়া যায়।”
সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছিলেন—
“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝা বাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল,
     অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
             এসো যুগান্তরের কবি;
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা করো’—
         হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”
তখন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে— পাঠক-পাঠিকার অজ্ঞাতসারেই উপরোক্ত কাব্যাংশের যেখানে যেখানে যতিসৃষ্টি হয়, সেটা এরকম—
“আজ যখন/ পশ্চিম দিগন্তে/
প্রদোষকাল/ ঝঞ্ঝাবাতাসে/ রুদ্ধশ্বাস।
যখন/ গুপ্ত গহ্বর থেকে/ পশুরা বেরিয়ে এল।
অশুভ ধ্বনিতে / ঘোষণা করল/ দিনের অন্তিমকাল।
এসো/ যুগান্তের কবি।
আসন্ন সন্ধ্যার/ শেষ রশ্মিপাতে/
দাঁড়াও/ ওই মানহারা/ মানবীর দ্বারে।
বলো ক্ষমা করো।
হিংস্র প্রলাপের/ মধ্যে/
সেই হোক/ তোমার সভ্যতার/ শেষ পুণ্যবাণী।”
সব সাহিত্য সমালোচকদের মতে— সুগভীর ভাব এবং কুশল শব্দচয়নই হল গদ্যকাব্যের প্রাণ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরে যেসব বাঙালি কবিরা গদ্য-কবিতা রচনা করেছিলেন, তাঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের মত পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে পারেননি। আর সেই কারণেই— গবেষকরা— পদ্যকাব্যের থেকে সুষ্ঠু গদ্যকাব্য রচনা করাকে বেশি কঠিন বলে মনে করে থাকেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!