নার্গিসঃ নজরুলের জীবন ও কাব্যে
সৈয়দ খালেদ নৌমান
কাজী নজরুল ইসলাম মূলত রোমান্টিক কবি। তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার মূলীভূত প্রেরণা শক্তি ছিল রোমান্টিকতা। নজরুল মানসের অদ্ভুত সৃষ্টির সাক্ষাৎ মেলে তাঁর প্রেমের কবিতায়। প্রেম মানুষের সহজাত ধর্ম। বিদ্রোহী কবির জীবনেও বার বার প্রেম এসেছে। কেবল দারিদ্র কিংবা বিশেষ কারো অথবা গোষ্ঠীর অপ্রীতিকর আচরণই নজরুলকে কষ্ট দেয়নি,নারীর প্রেমের স্পর্শে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ফুটেছে ভালোবাসার রঙিন ফুল। সেই সব ফুলের সৌরভে তিনি যেমন বিমোহিত হয়েছেন, আবার সেই ফুলের কাঁটার আঘাতে তেমনি আহত ও রক্তাক্তও হয়েছেন। নারীর প্রেম যেমন তাঁর
হৃদয়কে ক্ষত- বিক্ষত করেছে, তেমনি তাঁকে আশ্চর্য ভাবে মহীয়ানও করেছে। শারীর প্রেমে আস্থাশীল কবি নজরুলের প্রেম চেতনা দেহরূপিনী প্রেমিকাকে আশ্রয় করেই উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতি লাভ করেছে। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে৪৯নং বেঙ্গলিরেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতা চলে আসেন
এবং শেষ পর্যন্ত ৩২নং কলেজস্ট্রিটস্থ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেসময়ে এখানেই থাকতেন কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমেদ। এসময়েই নজরুলের সঙ্গে “ভিস্তি বাদশাহ”, “বাবর” প্রভৃতি নাটক রচয়িতা এবং প্রাইমারি স্কুলের নানান পাঠ্যবই প্রণেতা অখণ্ড বাংলার কুমিল্লা জেলার দৌলতপুরের আলী আকবর খানের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। আকবর খান নজরুলকে তাঁর দেশের বাড়ি দৌলতপুরে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। অথচ নজরুল সুহৃদ মুজফফর আহমেদ ও নজরুলের আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব আকবর খান কে পছন্দ করতেন না। মহানগরীর উত্তপ্ত আবহাওয়ায় ক্লান্ত নজরুল পূর্ব বাংলার গ্রামের “বনতোষিনী ও মনোরম শীতলশোভা” র আকর্ষণে সুহৃদ মুজফফর আহমেদ এর অসম্মতি সত্বেও ১৯২১ সালের ৩- এপ্রিল আকবর
খানের সঙ্গে দৌলতপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ট্রেনে বসে নজরুল পূ্র্ববাংলার উদ্দেশ্যে নীলপরীশীর্ষক একটি কবিতা রচনা করেন।
যুবক নজরুল
নজরুলকে নিয়ে আকবর খান প্রথমে যান কুমিল্লা শহরের কান্দির পাড় অঞ্চলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়ি। সেনগুপ্ত পরিবারের লোকজন প্রগতিশীল ছিলেন এবং সকলেই বৃটিশ বিরোধী
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আকবর খানের সহপাঠী বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ পরিচিত। আর সেই সূত্রে
সেনগুপ্ত বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। “নবযুগ ” পত্রিকা সূত্রে নজরুলের নামের সঙ্গে বীরেন্দ্রকুমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন, ফলে নজরুল কে তিনি সাদরে গ্রহণ করেন। নজরুল ক’দিনই সেনগুপ্ত পরিবারে ছিলেন। তাঁর স্বভাব গুণে তিনি এই পরিবারের একজন আপনজন হয়ে ওঠেন। বীরন্দ্রর মা বিরজাসুন্দরীকে নজরুল ‘মা’
ডাকতে শুরু করেন।বিরজাসুন্দরী ও তাঁর বিধবা জা গিরিবালাদেবীর আদর-যত্ন ও স্নেহে নজরুল মুগ্ধ ও অভিভূত হন।
কুমিল্লা শহর থেকে এরপর আকবর খান নজরুল কে নিয়ে যান দৌলতপুরে,নিজের গ্রামে। শহর থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে।
নজরুল দু-মাসের উপর দৌলতপুরে অবস্থান করেন।এখানেও তিনি হাসি-গান- গল্প দিয়ে সকলের স্নেহ ও ভালো বাসা লাভ করেন। এসময়ে কিছু দিন পর আকবর খানের ভাইঝির
সঙ্গে দৌলতপুরেরই আকবর খানের ভাগিনেয় আব্দুল জব্বার এর শুভ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ওই বিবাহ অনুষ্ঠানে জব্বার এর বোন – সুন্দরী পঞ্চদশী সৈয়দা খাতুনও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেদিন গানও গেয়ে-
ছিলেন।
নজরুল ওই বিবাহ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি রূপে উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দাকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগেছিল নজরুলের। এবংনজরুল তাঁর সমগ্র
হৃদয় উজাড় করে সেই পঞ্চদশীকে ভালোবাসলেন।
সৈয়দা ছিলেন যেমন সুন্দরী, তেমনি বহুগুণে গুণান্বিতা।শুধু সুযোগের অভাবে লেখা পড়াতেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন। সুদর্শন, সুপুরুষ ও স্বাস্থ্যবান,তরুণ কবি নজরুলকেও সৈয়দার বেশ ভালো লেগেছিল।তিনি ও নজরুল কে ভালো- বেসে ফেলে ছিলেন। নজরুলের হাসি- গান- বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন সৈয়দা। পরবর্তী তে নজরুল ও সৈয়দার দেখা -সাক্ষাৎ এর মধ্যে দিয়ে ক্রমশ তাঁদের মধ্যে গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে এবং নজরুল সৈয়দার নতুন নামকরণ
করেন – “নার্গিস। ” নজরুলের প্রিয় উর্দু কবি হাফিজ এর প্রিয় ফুল – নার্গিস এর নামেই এই নামকরণ।
নার্গিস এক সাক্ষাৎ কারে বলেন: ” প্রথম দেখার পর থেকে কখন কিভাবে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে ছিলাম।নজরুল তো আমাকে নিয়ে
দৌলতপুরেইঅনেকগুলো কবিতা ও গান লিখেছিল। আমাকে এক নজর না দেখলে ও মনমরা হয়ে যেতো।”
নার্গিসের প্রেমে নজরুলও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ছিলেন। নার্গিসের সঙ্গে তাঁর নিজের বিয়ের
ব্যাপারে তিনি ভীষণ ভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নার্গিসের অভিভাবক রা নিমরাজি থাকলেও নজরুলের দুর্দমনীয় মনোভাব, জেদ আগ্রহের আতিশয্যের কারণে তাড়াহুড়ো করে তাঁদের বিয়ে ১৯২১সালের ১৭ জুনতারিখে নির্দিষ্ট ও স্থির করা হয়।
নার্গিস এর মামা আকবর খান তাঁর নিজের নামে বিয়ের সুদীর্ঘ ও বিচিত্র এক নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়ে পরিচিত মানুষ জন,আত্মীয় স্বজনকে পাঠিয়ে
ছিলেন। কলকাতায় মুজফফর আহমেদ সহ নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সকলের কাছেই এই নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছিল। নজরুলের বিয়ের ব্যাপারটা কলকাতায় বন্ধু বান্ধবের মধ্যেএকটা দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
নজরুলের বন্ধু মহলে একজনও এমন বিয়ে সমর্থন করলেন না, এবং মুজফফর আহমেদ ও বিয়ে তে আপত্তি জানিয়ে খুব তীব্র ভাষায় একখানা চিঠি নজরুলকে লিখেছিলেন।
উল্লেখ্য যে,বিয়ের নির্দিষ্ট তারিখের আগের দিন অর্থাৎ ১৬ জুন, ১৯২১ কুমিল্লা শহরের সেনগুপ্ত
পরিবারের নিমন্ত্রিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত, বিরজাসুন্দরী দেবী,গিরিবালা
দেবী,আশালতা সেনগুপ্ত প্রভৃতি সকলেই বিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন।
নির্দিষ্ট দিনেই অর্থাৎ ১৭ জুন, ১৯২১ আকবর খানের বাড়িতে নজরুল ও নার্গিসের যথারীতি ইসলাম শাস্ত্রমতে বিয়ে সম্পন্ন হয়।বিয়েতে ২৫ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল। এই
বিয়ে পড়িয়েছিলেন নার্গিস এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আব্দুল জব্বার। বিয়ের উকিল ছিলেন নার্গিসের বড়মামা আলতাফ খান। বরপক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন স্থানীয় সাদত আলি মাস্টার , আর কনে
পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেনসৈয়দ আলি মাস্টার।
কলকাতা থেকে সেদিন নজরুলের কোনো বন্ধুবান্ধবই উপস্থিত ছিলেন না।
দৌলতপুরে নজরুল ও নার্গিসের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে এবং আরও কিছু ব্যাপারে নানান
কটূক্তি আকবর খানকে উত্তেজিত করে তুলছিল, তেমনি কাবিননামার শর্ত ও নানা পরিস্থিতি নজরুলের পৌরুষে আঘাত হানায়,নজরুলও সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে
এক পর্যায়ে আকবর খান ও নজরুলের মধ্যে বাক্ বিতণ্ডা শুরু হলে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় ভন্ডুল হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়ে।তবে অভ্যাগত অতিথি বর্গের হস্তক্ষেপে পরিবেশ শান্ত হয় এবং নজরুল বিবাহোত্তর “বাকি উৎসবের জন্যে যত শীঘ্র ই ব্যবস্থা করবো” ঘোষণা দিয়ে সে রাতেই বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের সঙ্গে কুমিল্লার কান্দির পাড় চলে যান।
বিয়ে র অনুষ্ঠানে নজরুলের সঙ্গে আকবর খানের বাগ্ বিতণ্ডার কারণ হিসেবে অনেকের ধারণা- বিয়ের দেনমোহর ২৫ হাজার টাকা ধার্যকরা।আবার কারো কারো মতে,কাবিননামায় (চুক্তি পত্রে) স্থায়ীভাবে বিয়েরপর নার্গিসসহ নজরুলকে কুমিল্লায় বসবাস করতে হবে এমন শর্ত যোগ করা। বিষয়টি আজও রহস্যাবৃত হয়ে আছে।
দৌলতপুরের নিস্তব্ধ সুশীতল ছায়াঘন পরিবেশে নজরুল দু-মাসের অধিক কাল কাটিয়ে, একের পর এক কবিতা – গান সৃষ্টি করে গেছেন।তিনি রচনা করেছিলেন ‘পাপড়ি খোলা ‘, ‘হারমানা হার ‘,
‘মানসবধূ’, ‘ অনাদৃতা,’ ‘অবেলায় ‘,’ বিদায় বেলা’, হারামণি,বেদনা অভিমান, বিধুরা পথিক প্রিয়া, ইত্যাদি কবিতা।
উল্লেখ্য, নজরুলের দৌলতপুর ও কুমিল্লায় লেখা অধিকাংশ কবিতা ও গান প্রকাশিত হয়েছে কবির দোলনচাঁপা, ছায়ানট, পূবের হাওয়া, ঝিঙেফুল প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থে,যার মধ্যে নজরুল নার্গিসের
অমর প্রেম কাহিনির সুস্পষ্ট ছাপ রয়ে গেছে।
দৌলতপুর ত্যাগের পর দীর্ঘ ১৭ বছর প্রতীক্ষা করেও নার্গিস নজরুলের কোনো সাড়া পাননি। ১৭ বছরের প্রতীক্ষায় নার্গিস নজরুলকে চারটি চিঠি লেখেন এবং কলকতায়গিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু নজরুল নার্গিসের চিঠি কিংবা দেখার গুরুত্ব না দিলেও ১৯৩৭ সালের জুলাই এর ১ তারিখে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুম থেকে নার্গিস কে লেখা চিঠি টিই ছিল প্রথম ও শেষ চিঠি।— — “তুমি বিশ্বাস করো,
আমি যা লিখছি,তা সত্য। লোকের মুখের শোনা
কথাদিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে, আর তা মিথ্যা। তোমার উপর আমি কোনো জিঘাংসা পোষণ করিনা।এ আমি অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে
কী গভীর ক্ষত,কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে
বেদনার আগুনে আমি নিজেই পুড়ছি- তাদিয়ে তোমাকে কোনো দিন দগ্ধ করতে চাইনি।”—
নজরুলের অনেক সংখ্যক প্রেমের কবিতা য়
নার্গিসের ঔজ্জ্বল্য নাক্ষত্রিক মাধুর্য লাভ করেছে। কবির ‘অগ্নি বীণা’, “ধূমকেতু” এবং
” পুজারিনী”র জ্বালা – যন্ত্রণার উৎস ও যে নার্গিসের
সঙ্গে বিচ্ছেদের দাহ জনিত – তাতো নার্গিস কে
লেখা নজরুলের চিঠি থেকেই অনুভব করা যায়ঃ
“তুমি এই আগুনের পরশ মাণিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতামনা,আমি ধূমকেতুর
বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।