প্রবন্ধ: চেতনায় নজরুল
লেখক: প্রিয়াঙ্কা পিহু কর্মকার
চেতনায় নজরুল
কবি সাহিত্যিক দুই বাংলার বন্ধন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।
তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে নারী রূপ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন ভাবে । তার সাথেই বাংলা সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তার প্রকাশ অবিস্মরণীয়।
নারী সম্পূর্ণ এবিষয়ে বলা হয় ,”নারী চরিত্রং দেব ন জনান্তি।” অর্থাৎ দেবতারাও নারী চরিত্র বুঝতে অক্ষম। বড় রহস্যময় বিধাতার এই অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি নারী ও তার মন। যার তল পেতে হাবুডুবু খেয়েছে কত মুনি ঋষি জ্ঞানী গুণীজন। যুগে যুগে নারীকে নিয়েই লেখা হয়েছে অযুত লক্ষ গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। এখনও হচ্ছে। নারীকে নিয়ে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কবিতা লেখেনি, এমন বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় শুধু নারী বা মাতৃভক্তির বর্ণনা দিয়েই সম্পন্ন করেননি বরং কালের অভিরুচি শিল্পী সত্তাকে বরাবরই বিকশিত করেন প্রকৃতির নির্যাসে। মাতৃসমা কিছু নারীর অপরিসীম প্রভাব, তাদের স্নেহ, অপত্য শাসন আর বুকে আগলে রাখার মাতৃত্ব বোধই কবিকে পথের নির্দেশ দিয়েছে।
কবি যেমন নারীকে আকুল হয়ে ভালোবেসেছেন, তেমন নিদারুণ কষ্টও পেয়েছেন। তবু নারীর বৈশিষ্ট্যে নিজেকে এ ভাবে রাঙ্গাতে চেয়েছেন।
তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা তুমি লাঞ্চিতা বিশ্ব-জননী!
তোমার আচল পাতা নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তবে,
বিষ শুধু তোমা দহে যথা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরনীর ভার বহে।
মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে যেমন কবি আকুল হয়ে ওঠেন, তেমনি প্রেয়সীকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। প্রিয়তমা প্রেয়সীর জন্য হৃদয় তাঁর হাহাকার করে উঠলেও এ সম্পর্কে বিরূপ অনুভূতি ও মনকে তাড়িত করে;
বারে বারে মোর জীবন প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে প্রিয়া
আমি মরিয়াছি, মরেনি নয়ন, দেখ প্রিয়তমা চাহি।
কবির ভিতরের যে মানব সত্ত্বা তা কারো জন্য অপেক্ষ্যমান। মনের সে আকুতি গভীর ভাব রসে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। অপেক্ষমান প্রিয়ার জন্য কবির ব্যাকুলতা;
নারীর কষ্টে তাঁর মন কেঁদে উঠত। যার জন্য তিনি ঈশ্বরকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে কুণ্ঠিত হননি।
ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দুটি নারীর পানে?/ জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে, যদি ওরা অভিশাপ হানে!’
প্রিয়া রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি।
কিংবা;
ফুল কেন এত ভালো লাগে তব, কারণ জান কি তার!
ওরা যে আমার কোটি জনমের ছিন্ন অশ্র হার!
কল্পনা বিলাসী কবি নারীর চুলের সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে মনের গোপন ইচ্ছা কাব্যিক ভাব রসে প্রকাশ করেছেন;
গানে, কবিতায়, চিঠিতে, নারীকে এত রূপে, এত ভাবে তিনি দেখেছেন –
সেই এলোকেশে বক্ষে জড়ায়ে গোপনে যেতাম চুমি!
তোমার কেশের সুরভি লইয়া দিয়াছি ফুলের বুকে
আঁচল ছুইয়া মূর্ছিত হয়ে পড়েছি পরম সুখে!
নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারই সাম্যবাদী দর্শনের মূল চেতনা;
আমার চোখে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নারীর প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, নারীকে অবমাননা করছে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। যে কথা পুরুষ শাসিত সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছেন কবি নারীর মর্যাদার কথা বলে;
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে
যুগের ধর্ম এই
সমাজের সর্বস্তরের নারী যে সন্মানীর তা কবিতায় প্রকাশ করেছেন। সমাজের নারীদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন;
কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা
কে দেয় থুথু-ও-গায়?
হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে-সীতা সম সতী মায়
নাই হলে সতী তবুও তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি,
স্বর্গ বেশ্যা ঘৃতচী পুত্র হল মহাবীর দ্রোণ
কুমারীর ছেলে বিশ্ব পূজ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ সন্তান হয়
অসৎ পিতার সন্তান ও তবে জারজ সুনিশ্চয়।
কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে মঙ্গলকামী কল্যাণীয়া হিসেবেই বিবেচনা করেছেন;
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-মাংস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে নারী যোগায়েছে মধু।
কাজী নজরুল ইসলাম স্রষ্টাকে ব্যবহার করেছেন প্রেমিক রূপে। প্রেমিক স্রষ্টা আদরের নারীকে স্বম্বোদন করেছেন ’প্রিয়া’। কবি তাঁর নিজের ভিতরের কাব্যিক সৌন্দর্য শৈল্পিক রসে প্রকাশ করেছেন এভাবেই;
স্রষ্টা হইল প্রিয়-সুন্দর সৃষ্টিরে প্রিয়া বলি
কল্পতরুতে ফুটিল প্রথম নারী আনন্দকলি!
নিজ ফুলশরে যেদিন পুরুষে বিধিল আপন হিয়া
ফুটিল সেদিন শূন্য আকাশে আদিবাণী- ”প্রিয়া, প্রিয়া”
কবির লেখনীর দৃঢ়তা , তাঁর সৃষ্টির কোণায় কোণায় বিরাজিত।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা ভাবনা সাথে ওয়াল্ট হুইট ম্যনার অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য –
কবি নজরুলের মনজীবনকে তাঁর কাব্যদর্শ কে প্রভাবিত করেছিল ।
*SONG OF MYSELF *এ বিশ অধ্যায়ে হুইট ম্যান যখন বলেন –
“My foothold is tenod and mortes’d in granite
I laug at what you call dissolution
And I know the amplitude of time .”
নজরুল ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হন ।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কোনো সময় সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা তার তথ্যভিত্তিক প্রমাণ আজ ও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
কিন্তু , রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩ এর ২২ ফ্রেব্রুয়ারি নজরুলকে * বসন্ত* গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন ।
এবং গুরুদেব উৎসর্গ পত্র লিখেছেন –
উৎসর্গ
শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেসু ‘
১০ই ফাল্গুন ১৩২৯
সমালোচক নজরুল বিষেশজ্ঞ আব্দুল কাদির
রবীন্দ্র – নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন –
* রবীন্দ্রনাথ একদিন আলাপ প্রসঙ্গে নজরুলকে তুলনা করেন ইতালীয় কবি দানুনজিওর সঙ্গে ।*
আবার , ১৯৩৩ সালে ডিসেম্বরে প্রকাশিত * বুলবুল* পত্রিকায় তাঁর * বিশ্বসাহিত্য* প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে * স্বপ্নচারী* বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য সম্পর্ক ছিল নিবিড় লেখনীর প্রাণে ছিল প্রক্ষতার ঝলকানি।
রবীন্দ্র উত্তরাধিকারকে অস্বীকৃতিতে নয় , বরং আত্তীকরণ এই নজরুল ইসলামের সার্থকতা –
তাঁর কন্ঠেই বন্দিত হয় –
*আজি তব বরে ,
শত বীণা – বেণু বাজে আমাদের ঘরে।*
আজ দুই বাংলায় লক্ষ লক্ষ কবি আছে- আসবেও কাজী নজরুল ইসলামের কলমের আগুন যেনো অগ্নিবীণা সমান অমরত্ব লাভ করেছে।