প্রবন্ধ : কাজী নজরুল ইসলামের সম্প্রীতি ভাবনা
লেখক: মহম্মদ বাকীবিল্লাহ মণ্ডল
কাজী নজরুল ইসলামের সম্প্রীতি ভাবনা :
বাংলা সাহিত্যের আকাশে অগণিত উজ্জ্বল তারার দ্যূতি প্রভাসিত । তবে যে দুজন নক্ষত্রের আলোয় বাংলার কাব্যাকাশ চির ভাস্বর হয়ে থাকবে তাঁরা হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম ।দুজন কবিই সমসাময়িক । মনে হয় গুরু – শিষ্য যেন । সেই সময়ে , বিশ্বকবির সম্মোহনী মায়ায় বাংলা সাহিত্যের নবীন কবিগণ বড়োই আকৃষ্ট ছিলেন । কিন্তু , নজরুল ইসলাম কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বাংলা কবিতায় সৃষ্টি করলেন এক সাহসী ধারা । রবীন্দ্রনাথের আবেগকে পাশ কাটিয়ে তিনি নেমে এলেন একেবারে বাস্তবের মাটিতে ।
কাব্য – সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় কবি নজরুলের সৃজন প্রতিভার স্বাক্ষর ভাস্বর হয়ে আছে । দুঃখের কথা , দেশ ভাগ হলেও বিশ্বের বাংলাভাষী সম্প্রদায় প্রিয় নজরুলকে ভাগ হতে দেননি । অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন ,
” আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে ভাগ হয়নি কো নজরুল । “
অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই মন্তব্য সর্বৈব সত্য । কারন , কবি – দার্শনিকেরা কোন ভৌগোলিক সীমানা বা পার্থিব সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকার নয় । তাঁদের ব্যপ্তি বিশ্বময় , তাঁদের শিক্ষণীয় বিষয় ‘ Torch Bearer ‘ হিসাবেই পথ দেখায়, ইহকালীন ও পরকালীন সময়ের জন্য । ঐতিহাসিক কারণে , আমাদের দেশ ভাগ হয়েছে বা দেশের মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে । কিন্তু আবিশ্বের মানুষের কবি নজরুল ইসলামের ভাবদর্শন বা শিক্ষার আবেদন চিরকালীন । জীবনের সর্ববিধ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা তাঁর কাব্য – কবিতা কিংবা গানের মাধ্যমে মানুষের চিত্ত শুদ্ধি করেছে । সেকারনে আজও তিনি আন্তরিকভাবেই স্মরণীয় ।
জীবনের সকলস্তরে , সকলক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণীয়। প্রায় সমকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । তবে , তাঁর সৃজনী শক্তির বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানে । তিনি প্রায় চার হাজার গান লিখেছেন । পণ্ডিতেরা বলেন , সৃষ্টি – প্রতিভার নীরিখে কবিগুরু প্রায় সব ক্ষেত্রেই কবি নজরুলের চেয়ে উচ্চাসনের যোগ্য । কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বোধহয় কাজী নজরুল কবিগুরুকে অতিক্রম করেছেন, তা হল তার গান । সংখ্যায় এবং বিষয় – বৈচিত্র্যে সর্ব ক্ষেত্রেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত কালোত্তীর্ণ হয়েছে । যাইহোক, আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় – কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্প্রীতির ভাবনা।
তাঁর সৃষ্টি সম্ভার মানব কল্যাণের প্রতি ক্ষেত্রেই জ্যোৎস্নার মতো ঝরে পড়েছে। একমাত্র মহাকাব্য ছাড়া, সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর সাবলীল পদচারণা লক্ষ্যনীয় । তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে প্রেম, বিরহ, মায়া, আর্তনাদ , বিদ্রোহ – বিপ্লব এবং প্রতিবাদ , দেশপ্রেম ও সাম্য । তবে, তাঁর ভাবনার একটা বিশেষ দিকের প্রতি খুব একটা আলোকপাত দেখা যায় না। তা হল , মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি । সাম্যবাদী কবি হিসাবে তিনি বহু চর্চিত।…
ধর্ম- বর্ণ কিংবা সম্প্রদায়ভেদে তাঁকে পৃথক করা যায়নি । জাতি – ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনের মণিকোঠায় শুধু নয় , অন্যান্য ভাষার পাঠক সমাজের হৃদয়েও তিনি অতি আদরণীয়। এর একমাত্র কারন তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবোধ। জাতি – ধর্ম – বর্ণের উর্ধ্বে উঠে মানুষের প্রতি তাঁর সম্প্রীতির কণ্ঠ বেশ উচ্চ স্বরে ধ্বনিত হয়েছিল :
” মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই , নহে কিছু মহীয়ান ।”
নির্ভিক চিত্তে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
ভারতীয় জনসমাজে একটি বহুল পুরনো রোগ হল সাম্প্রদায়িকতা। যদিও কবি অতুল প্রসাদ সেন বলেছেন ,
” নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।”
কিন্তু ক্ষমতা ও রাজনীতির ‘বেওসায়ী – ‘ দের কূটক্যাচাল ও সদিচ্ছার অভাবেই প্রকৃতপক্ষে ভারতের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতির বাঁধন সঠিকভাবে , সর্বস্তরে এবং সব যুগে মজবুত হয়নি । যদিও দীর্ঘকাল যাবদ দুই সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাস, এবং…
“শক, হুন – মোগল পাঠান এক দেহে ” – হয়েছে লীন।
গল্পে , কবিতায় , নেতাদের ভাষণে , বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং পাশাপাশি আবেগপূর্ণ কল্পনায় হিন্দু – মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা নানাভাবে প্রতিফলিত হলেও বাস্তবে তার প্রচুর গরমিল লক্ষ্য করা যায় ।কেবলমাত্র বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যদি ভারতের খেলা পাকিস্তান ব্যতিরেকে অন্য কোন ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের সঙ্গে হয়ে থাকে , তখনই কেবল গোটা ভারত একসূত্রে আবেগমথিত হয়ে ওঠে । তার মানে এই নয় যে , আর কোন ক্ষেত্রেই জাতি হিসাবে ভারত এক হয় না । কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক হওয়ার নজির নিশ্চয়ই আছে । তবে , তার হিসাব অতি নগণ্য । যে যে ক্ষেত্রে একতার অভাব পরিলক্ষিত হয়, তার সমস্ত দায় আরোপিত হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপরে । উল্লেখ করা যায় যে , ভারতের খেলা যখন পাকিস্তানের সঙ্গে হয়ে থাকে , তখন কিছু কিছু সংখ্যালঘু এলাকায় স্বল্প সংখ্যক কিছু চপলমতি ছোকরার পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন করে উল্লাস প্রকাশ বড্ড বেশি পীড়া দেয় । অবশ্য তারা বলে , পাকিস্তান ভালো খেলে তাই তারা তাদের সমর্থক । কিংবা , ভারত মুসলমান খেলোয়াড়দের প্রতি বিমাতৃসূলভ এবং পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে । অনেক মুসলিম প্লেয়ারের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় টিমে চান্স পায় না । অথচ , তার চেয়েও কম যোগ্যতা সম্পন্ন খেলোয়াড় শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার সুবাদেই সুযোগ পায় – ইত্যাদি ইত্যাদি । কারন যাই হোক না কেন , দেশবাসী হিসাবে মুসলমান ভাইদের এই হেন আচরণ করা একেবারেই সমীচীন নয় । কারন, ” দেশভক্তি ইমানের অঙ্গ । “
যাইহোক, কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং সাহিত্য সাধনায় উদারতা এবং সম্প্রীতির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর জীবন দর্শন যেভাবে তিনি বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন এবং সফল হয়েছেন তা যুগ – যুগান্তরের পথে মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা হয়েই থাকবে – একথা বলা যেতেই পারে।
কবি , নজরুল মূলতঃ মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা নিয়েই আজীবন কাব্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন । আধুনিক জীবনের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবতা প্রতিষ্ঠা করা , মানুষের জয়গান করা । তিনি ধর্ম দিয়ে কখনো মানুষের বিচার – বিশ্লেষণ করেননি । তাঁর ভাবনায় ছিল মানুষে মানুষে ও জাতিতে জাতিতে কোন ভেদাভেদ করা উচিত নয় । মানুষ হিসাবে সবাই সমান । চারিদিকের নানান বিভাজন ও ভেদাভেদ দেখে কাব্যের ভাষায় তিনি জিঞ্জাসা করলেন –
‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ঐ জিঞ্জাসে কোনজন ?
কাণ্ডারি ! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। ‘
অর্থাৎ সব মানুষের রক্তের রঙ লাল এবং তাদের শারীরবৃত্তীয় কাজও একই । প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের দুঃখ কষ্টের যন্ত্রণা সমান । আবার আবেগ , অনুভূতি , ক্ষিধে – যৌন চাহিদা সবই একই রকম । তাই মানুষ হিসাবে সবাই সমান । একই গোত্রীয় । ফলে তাদের মধ্যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করা ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নয় , বরং তা পার্থিব স্বার্থের কারনেই সৃষ্টি হয়েছে ।
ইসলামের প্রধান শিক্ষাই হল মানব কল্যান । সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দর্শনেও সেই একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় । তাই তাঁর কাছে মানুষের প্রধান বিচার্য বিষয় হল মনুষ্যত্ব , জাতিগত পরিচয় নয় ।ধর্মগ্রন্থের মূলকথা হল মানুষের অবোধ মনোভাবকে বোধের উচ্চ মার্গে পৌঁছে দেওয়া । সেকারনে , মানুষের কল্যাণের জন্যই সকল সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের আবির্ভাব হয়েছে। তা , সে , মানুষের দ্বারাই লিখিত হোক , কিংবা ঐশী বাণীই হোক । কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল অসাম্প্রদায়িক দর্শন প্রতিষ্ঠা করা – জীবন , কর্ম ও ভাবনার মধ্য দিয়ে ।…
ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব অত্যন্ত বেশি । কবি নজরুল ইসলাম এতে ব্যথিত হতেন । তিনি অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল ধ্রুবতারা । সর্বদা তিনি জাতিধর্মের সীমানা এবং তার গণ্ডির বাইরে বিচরণ করতেন । তিনি বলেছেন , ‘ আমি সকল দেশের , সকল মানুষের , সর্বকালের । ‘
মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজী কবি সম্প্রীতির গান গেয়েছেন । তাছাড়া মানুষে – মানুষে কৃত্রিম ভেদাভেদ দূর করার জন্য আজীবন তিনি সম্প্রীতির সাধনার মাধ্যমে কাব্য সাধনা করেছেন এবং গান গেয়েছেন । ফলে , প্রীতি সুধার ধারক এবং বাহক হিসাবে চিরকাল তিনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন ।
তিনি শুধু হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ বা দূরত্ব দূর করে প্রীতি ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি । সামাজিকভাবে যারা অনভিজাত বা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিও তিনি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং দয়ার্দ হয়েছেন । তিনি বলেছেন ,
‘ তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি ,
তারাই মানুষ , তারাই দেবতা , গাহি তাহাদের গান ।
কিংবা ,
‘ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে !
চোখ ফেটে এল জল, …. ‘
এই হল মানবিক কবির আসল পরিচয় । অন্তর সম্পদে তিনি সত্যিই আবিশ্বের বাদশাহ ।
আরও বলা যায় যে , হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্যের কারনে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা নিম্ন বর্ণের হিন্দুদেরকে মানসিক , সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়ন চালায় । হিন্দু সমাজের এ এক চিরকালীন ব্যধি , যা মানুষকে যথেষ্ট মর্যদা প্রদর্শন করে না । কবির চোখেও তা ধরা পড়েছে । কবিরাই তো যুগের অতন্ত্র প্রহরী । তাই , এই বিষয়টির বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন –
‘ ও কি চণ্ডাল ! চমকাও কেন ? ও নহে ঘৃণ্য জীব ‘…
তিনি আবার আশ্বাস বাণীও শুনিয়েছেন এই বলে যে ,…
‘ ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র , ওই শ্মশানের শিব। ‘
বলা বাহুল্য , আমাদের ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চণ্ডালেরা আজও পূজিত হতে পারে না ।, ‘ শিব ‘ হতে পারে নি। তাই , এখনো নজরুলের কবিতা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক । আরও উল্লেখ করা যায় যে , তিনি বলেছেন , ‘ আমার চোখে পুরুষ – রমণীর কোন ভেদাভেদ নাই । ‘
তাছাড়া , দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছেন যে , ধর্মের ভেদাভেদ তাঁর কাছে গ্রহনীয় নয় । তাঁর কাছে জাতের চেয়ে মানুষ সত্য । ক্ষুধায় কাতর মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য মন্দির – মন্দিরে আশ্রয় নিলেও তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না । তাই , তাঁর মতে , মানুষের মঙ্গলের জন্য এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মগ্রন্থের আবির্ভাব হয়েছে , মানুষকে ঘৃণা করার জন্য নয় । নজরুল ইসলাম তাই , ‘ মানুষ ‘ – কবিতায় মৌলবী ও পুরোহিতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন । তিনি বলেছেন , মানুষের স্থান সবার উপরে – সে যে কোন সম্প্রদায়ই (কিংবা যে কোন নারী বা পুরুষ ) হোক না কেন । আবার , নজরুল ইসলাম ধর্মের চেয়ে মনুষ্য সম্প্রদায়কে সর্বদা বড়ো করে দেখেছেন । ফলে , সম্প্রদায় নির্বিশেষে নজরুলকে ভালোবাসতে কারও বাধেনি – কখনো । বলা যায় , কবি ও গীতিকার নজরুলের চেয়ে মানুষ নজরুল অনেক মহীয়ান ।…
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘ মন্দির ও মসজিদ ‘ এবং
‘ হিন্দু – মুসলমান ‘ প্রবন্ধ দুটির মধ্য দিয়ে ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন । তাঁর প্রবন্ধ দুটির আবেদনে স্থান পেয়েছে সম্প্রীতি ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ । সম্প্রদায়ে – সম্প্রদায়ে অকৃত্রিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন নতুন যুগের পথিকৃৎ । তাঁর এই চেতনা যুব মানসে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । সম্প্রীতির আন্তরিক চেতনায় তাঁর সৃষ্টিশীল দর্শন সাহিত্যের পাতায় পাতায় মুখর হয়েছিল । এবিষয়ে ভারতবাসীর প্রতি তাঁর কালজয়ী নিবেদন…
‘ মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু – মুসলমান ।
মুসলিম তাঁর নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ ।। ‘
মানুষে – মানুষে ভেদ ও ঘৃণার নীতিকে দূর করার জন্য তাঁর এই প্রত্যয় সত্যিই তারিফযোগ্য এবং আজীবন মানুষের পথের দিশারী হয়ে থাকবে ।তাঁর কাছে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে পৃথক কোন সত্তা নেই । উভয় সমাজের মধ্যে পরস্পর ভালোবাসা , শ্রদ্ধা , বিশ্বাস ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্বোল্লেখিত বাণীকে অনুসরণ করতেই হবে । ধর্মীয় প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাস্তবিকই তিনি ছিলেন একজন নির্ভিক সৈনিক ।
তাঁর ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে এই মর্মে যে , হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ বিপরীত মেরুর না হয়ে পরস্পর সম্পূরক ও পরিপূরক হয়ে উঠুক । হিন্দু – মুসলমান প্রবন্ধে তিনি ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির বিড়ম্বনা থেকে বের হয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন ।
বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে এই ভাবনার প্রাণ প্রতিষ্ঠা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু চলমান সামাজিক বা রাষ্ট্রিক জীবনে তার প্রতিফলনের বড়োই অভাব পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় , সাংস্কৃতিক , সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বলয়ে হিন্দু – মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়।
তবু একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যের একটা বড় অংশ গোঁড়া এবং সেকারনেই চরম বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে চলে। নানা ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব থাকে খুব নগণ্য। স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে যতই মানবিক পাঠ দেওয়া হোক না কেন বাস্তবে তার প্রতিফলন একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেনাপাওনা গল্প পড়ে এসে যদি কোন মাষ্টার মশাই বিয়ের সময় পাত্রী পক্ষের কাছ থেকে অধিক পণ দাবি করেন তাহলে বুঝতে হবে যে , কবি গুরুর গল্পের শিক্ষনীয় নির্যাস তিনি কিছুই গ্রহণ করতে পারেন নি । ঠিক তেমনি , কাজী নজরুল ইসলামের –
‘ মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম …’ পড়াশুনার পর যদি কোন শিক্ষক মহাশয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব বশতঃ বিদ্বেষ – বিষ ছড়ান, তাহলে বুঝতে হবে যে , তিনি শিক্ষকতা নামক নোবেল পেশার উপযুক্ত নন। দুঃখের বিষয় , আমাদের সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি।
কবি কাজী নজরুল ঠিক এই বিষ – বৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাস্তব জীবনেও সম্প্রীতির উজ্জ্বল প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর অসংখ্য সঙ্গীতের কালজয়ী শ্যামা সঙ্গীত রচনা তার বড় প্রমাণ।
বস্তুত মানবতার মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ভাবনার এক বড় অংশ জুড়ে আছে হিন্দু মূসলিম সম্প্রীতির ঐকান্তিক কামনা। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানের অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন ,
” হিন্দু মুসলমানে দিন রাত হানাহানি , জাতিতে – জাতিতে
বিদ্বেষ , ” … … এই ভেদঞ্জান দূর করতেই আমি এসছিলাম ।
বলা বাহুল্য , তাঁর কাব্যে , সঙ্গীতে, কর্ম জীবনে অভেদ – সুন্দর সম্প্রীতিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে স্পষ্ট ভাষ্যে সম্প্রীতির লালন এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় কবি নজরুল ইসলাম আজও অদ্বিতীয় শুধু নয়, তিনি এক অনন্য মহীরুহ। দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য তাঁর সম্প্রীতির ভাবনা সামগ্রিক দেশবাসীর অনুসরণযোগ্য পাথেয় হোক।