নিবন্ধ: মফস্বল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ।। আমির উল হক - শৃণ্বন্তু নিবন্ধ: মফস্বল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ।। আমির উল হক - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০২ পূর্বাহ্ন

নিবন্ধ: মফস্বল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ।। আমির উল হক

আপডেট করা হয়েছে : বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০২৪, ১০:৫৮ অপরাহ্ন
নিবন্ধ: মফস্বল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ।। আমির উল হক

 

মফস্বল বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা 

                   

       আমাদের ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি শারদ সাহিত্যের অমোঘ আকর্ষন পুরো পুজোর ছুটিকে এক সুতোয় বেঁধে দিতো। ছুটির পরেই যে বার্ষিক পরীক্ষা তা তখন খেয়াল থাকতো না। সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকার পরে মহালয়ার কিছু আগে থেকেই স্থানীয় পোস্ট অফিসে পোস্টম্যান এর আগমনের আশায় দিনক্ষণ গুনতাম। আমাদের বাড়িতে পোস্টম্যান এলেই শারদ সাহিত্যের ডালা ভরে যেতো। আনন্দবাজার পত্রিকা, সান্ধ্য গণশক্তি, দেশহিতৈষী,  আনন্দমেলা, যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী, দেশ, খেলার আসর, পরিবর্তন, শিলাদিত্য, নবকল্লোল, শুকতারা, সন্দেশ, পক্ষীরাজ, ঝলমল, কলরব, চাঁদমামা, চিলড্রেনস ডিটেকটিভ, কালান্তর, সিনেমা জগৎ, প্রসাদ, পরিচয়  সহ আরো বেশ পত্র পত্রিকা। বাড়ির সদস্যদের পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী যার যেটা পছন্দ সেটাই তার দখলে চলে যেতো। কোন বাধা নিষেধ ছিলো না। যখন পত্রিকাগুলো আসতো তখন তার উপরে এক সুদৃশ্য ছাপানো মোড়কে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নাম ছাপার অক্ষরে লেখা থাকতো। সেগুলো যার যার নামে থাকতো তারা সেই সব মোড়ক সংরক্ষণ করতো। ছাপানো মোড়কে শারদীয় সাহিত্যের একটা আশ্চর্য গন্ধ পাওয়া যেতো। সেই গন্ধেই ছিলো যেন ভূবন মাতানোর অনুভূতি। আমাদের পরিবারে অনেকগুলো পত্র পত্রিকা আসতো বলেই হয়তো বাড়িতে তখন  অনেক সহপাঠী ও বন্ধু বান্ধবদের আনাগোনা বেড়ে যেতো। এমনও হতো যে একজন কেউ জোরে পড়তো, আর অন্যরা চারদিকে গোল হয়ে বসে, শুয়ে, হেলান দিয়ে শারদ সাহিত্যের আস্বাদ গ্রহণ করতো। সেই সময় বিশেষ করে আনন্দমেলা, সন্দেশ ও পক্ষীরাজ পত্রিকা ছিলেন শিশু কিশোর কিশোরীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। পত্রিকা সুত্রে বেশ কিছু ‘পেন ফ্রেন্ড’ হয়েছিল। সাধন দাস, দেবাশিস কর, সুজাতা বসু, চকিতা চট্টোপাধ্যায়, তপন সৈয়দ, রানা সৈয়দ,  অভিষেক সেনগুপ্ত, অমিত রায়, গোপা মজুমদার, এম ডি আজাদ, সুপ্রিয় দে, সরসিজ সেনগুপ্ত, অপুর্ব চট্টোপাধ্যায়, জুঁই চৌধুরী, সমীরকুমার সাহা, জাহাঙ্গীর কবীর, সুপ্রীতি কর, সাধনা কর প্রমুখ ছিলেন আমাদের সকলের পত্র বন্ধু। কোন শারদীয়া সংখ্যার  কোন লেখা কেমন হয়েছে, কার কেমন লেগেছে তা নিয়ে চিঠি পত্র লেখা লেখি হতো। পরে সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদকত্রয় সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার ও নলিনী দাশ স্বাক্ষরিত গ্রাহক কার্ড হাতে পেতাম তখন এক নতুন অনুভূতির আনন্দে গর্ববোধ হতো। পক্ষীরাজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ও মনোজ দত্ত। স্বপনবুড়ো, মহাশ্বেতা দেবী, শিবরাম চক্রবর্তী, কবিতা সিংহ , লীলা মজুমদার, নলিনী দাশ, ইন্দিরা দেবী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখের সঙ্গে ও চিঠি পত্র দেওয়া নেওয়া চলতো। সাহস করে কয়েকবার সত্যজিৎ রায়কে ও চিঠি লিখেছিলাম। উনি উত্তর ও দিতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, মৈত্রেয়ী দেবী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কাছে ও আমরা চিঠি পত্র লিখতাম। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার শারদীয়া সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘ধান শালিকের দেশে’ ও ‘নবারুণ’ নামের পত্রিকা পাঠাতো আমাদের পত্র বন্ধু বরিশালের এম. ডি. আজাদ। 

   

আমাদের পারিবারিক সাহিত্য পত্রিকা ছিলো ‘ভূমা’। ভূমা ‘র অন্যতম সহযোগী আমাদের আত্মজন মসীহউদ্দৌলা (দীপু)  ও মাজরুল ইসলাম।   ভগবানগোলার বিশিষ্ট শিক্ষক সদ্য প্রয়াত এবাদুল হক ‘আবার এসেছি ফিরে ‘ নামে একটি পত্রিকা বার করতেন। পরে অশোক কুমার পান্ডে ও রফিকুল ইসলামের ( প্রয়াত) উদ্যোগে ‘জাহানকোষা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। জিয়াগঞ্জ থেকে ‘বালুচর’ ছিলো অনেক দিনের পত্রিকা। জিয়াগঞ্জ শ্রীপৎসিং কলেজের সহপাঠী মানবেন্দ্র নাথ সাহা ছাত্রাবস্থায় একটি কবিতা পত্রিকা করতেন। শ্রীপৎসিং কলেজের অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার রায়, শ্যামল রায়, প্রভাস সামন্ত প্রমুখ দিকপাল সব অধ্যাপকবৃন্দ আমাদের সকলকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করতেন। ঐ কলেজের বার্ষিক পত্রিকা ছিল বেশ উন্নতমানের । বেনিপুর গ্রামের এনতাজ আলী ছাত্রাবস্থায় একটি উপন্যাস লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। লোচনপুর নৃত্যকালী হাই স্কুলের শিক্ষক দম্পতি সুধেন্দু ভৌমিক  ও শীলা ভৌমিক ছিলেন  শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পথিকৃৎ। আখেরিগঞ্জ হাই স্কুলের শিক্ষক সুভাষ সরকার, প্রশান্তমোহন মন্ডল, প্রধানশিক্ষক ওসিমুদ্দিন আহমেদ সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক। ঐ স্কুলের ছাত্র জহর উল হক, রেজাউল করীম, হামিদুল হক, সাদেক আলী, আব্দুল আলিম, সামিমা বিশ্বাস(বেবী),  আমিনুল হক, কবিরুল হক, মুক্তি হক, ইতি হক,  নমিতা পাল, পালুনাবালা পাল, উদয় সরকার, শুক্লা সরকার, তুহিনা খাতুন (বিউটি),  দেবাইপুরের শিখা সরকার, শিপ্রা সরকার, সাকিলা রহমান, অপর্ণা উপাধ্যায়, মৃদুলা মন্ডল প্রমুখেরা ছিলেন এলাকার সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতির অগ্রনী অংশ। আমিনুল হক ছাত্রাবস্থায় আকাশবাণী কলকাতা যুববানী  তে ‘সমাধান’ নামের একটি নাটক লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তুহিনা খাতুন ও সাকিলা রহমান মুসলিম বিয়ের গানে বেশ উল্লেখযোগ্য নাম। এছাড়া কাঁথা শিল্পেও সাকিলা একজন যথেষ্ট দক্ষ শিল্পী।  মুক্তি হক বর্তমানে শিক্ষকতা ও আকাশবাণী মুর্শিদাবাদ এর সঙ্গে যুক্ত। রেজাউল করীম ঐ স্কুলেরই  প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন।  এলাকায় আমাদের পরিবারকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটা পরিমন্ডল তৈরি হয়। স্থানীয়  দেবাইপুর এলাকায় ‘উত্তরণ’ গ্রুপে অনেক নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা সামিল হয়। সবপেয়েছির আসর, কিশোর বাহিনী, স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন, পুজো কমিটি, মেলা কমিটি ও বাজার সমিতির উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। কবিগান, পঞ্চরস, যাত্রা, আলকাপ, পুতল নাচ, রামযাত্রা, সার্কাস, মুসলিম বিয়ের গান, গীত, গজল, কাওয়ালী, শব্দ গান ইত্যাদির আসর বসতো। সেই সময় স্থানীয় টেকপাড়া শিবনগরে দুর্গা পুজোতে আলকাপ, কবিগান, যাত্রা, পুতুল নাচ, পঞ্চরস, শব্দগান, কীর্তন, ম্যাজিক, রামযাত্রার আসর বসতো বসতো। দল মত,ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো মানুষের সমাগমে  এলাকায় উৎসবের আবহাওয়া পরিলক্ষিত হতো। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যান দপ্তরের উদ্যোগে বার্ষিক যুব  উৎসবে সমাজের সকল অংশের মানুষ অংশ গ্রহণ করতেন। যুব কল্যান দপ্তরের মুখপত্র ‘যুবমানস ‘ পত্রিকা ও খুবই আকর্ষণীয় ছিল। যুবমানস পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা ছিল বেশ সমৃদ্ধ সংকলন।  সে সব এখন অতীত দিনের স্মৃতি। বর্তমানে শারদীয়া পত্র পত্রিকার পরিসর আরো বৃদ্ধি হয়েছে। সঙ্গে ই -পত্রিকার রমরমা। ভবিষ্যতে ই – সংস্করণ আরো বৃদ্ধি পাবে সেটা নিশ্চিত। তখন ছাপানো অক্ষর যে বিপন্নতার মধ্যে পড়বে, তা নিয়ে এখনই ভাববার প্রয়োজন। 

  ছোটবেলার সেই সব ছুটির আগে ও ছুটির পরের দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। 

 

 

 

 

 

  


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!