“নদী জাগছে গো-ও-ও-ও -“
নদীপাড়ের ওদিক দিয়ে হাঁক দিতে দিতে ছুটে গেল কেউ। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় উঠে বসলাম বিছানায়। আমার ঘর জুড়ে আলোআঁধারির এক রহস্যময় পরিবেশ। মুহূর্তে কীসের একটা অজানা আতংক এসে যেন গ্রাস করে নিল আমায়। ‘নদী জাগছে’ মানে কী? নদী কী তাহলে-
আজ দিন তিনেক হয়ে গেল এ গাঁয়ে এসেছি। প্রাইমারী স্কুলে চাকরি আমার। ‘চর ঘোষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামটা শুনেই বন্ধুরা বলেছিল,”শেষ মেষ কোন এক ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে পড়লি জয়? অমন জায়গায় চাকরি করার চেয়ে বেকার থাকাই যে ভালো রে।”
হেসেছিলাম। বলেছিলাম,”তোদের বাবার আছে, তোরা চাকরি না করলেও অসুবিধে নেই। কিন্তু বেকার ছেলেকে বয়ে বেড়াবার মত সামর্থ্য যে আমার বাবার নেই রে। তাই যা পেয়েছি সেটাই আমার কাছে অনেক।”
ওরা বলেছিল,”তুই যদি থাকতে পারিস তো আমাদের কী? তবে বলছিলাম, যা করবি ভেবে চিন্তে করিস।”
না,অতসব ভাবনা চিন্তা করার কোনও সুযোগ আমার ছিল না। আমার কেবল দরকার ছিল একটা চাকরির। আর সেটা পেয়ে যেতেই হাতে চাঁদ পেয়েছিলাম আমি। মনে হয়েছিল ‘চর ঘোষপুর’ যেমনই হোক এই পৃথিবীর মধ্যেরই তো কোনও জায়গা। বাড়ি থেকে হাসি মুখেই বেরিয়েছিলাম তাই। কিন্তু পৌঁছেই মন টা ভেঙে গিয়েছিল। এমনও জায়গা হয়?
‘চর’ যে আসলে চর নয়। নদী এখানে আচমকা বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে। আর এই বাঁকের মুখেই ত্রিশ-চল্লিশ ঘর মানুষের বাস। টিন,টালি,খড়,আর ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া বেশিরভাগ ঘরেরই সারা শরীর জুড়ে কঠিন এক দারিদ্র্যের ছোঁয়া। স্বপ্ন যে এখানে চোরাবালিতে ডুবে আছে তা এক পলক দেখলেই সহজে অনুমান করা যায়। আশ পাশের গ্রাম গুলোর থেকে একেবারেই অন্য রকম চেহারা গ্রামটার।আর তাদের থেকে বিচ্ছিন্নও বটে।গাছপালার সংখ্যা যতটাই কম বাড়িগুলো যেন ঠিক ততটাই গা ঘেঁষাঘেঁষি। কোথায় থাকবো,কী খাবো,কেমন করে থাকবো ভাবতে গিয়ে যখন আমার খেই হারানোর দশা তখন হেড মাষ্টার শশীভূষণ আঢ্য বলেছিলেন,”এমন এক গাঁয়ে এসে পড়েছেন যেখানে থাকার জায়গার বড়োই অভাব। আপনি এক কাজ করুন,আমার বাড়িতেই থাকুন। দুটো ঘর তো ফাঁকাই পড়ে আছে।”
অগত্যা ব্যাগ পত্র নিয়ে এ বাড়িতেই ওঠা। সারা গাঁয়ে এই একখানিই পাকা ঘর। না,এ ঘরে দারিদ্র্য নেই। একমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার নেই। ভাঙা মনটা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেয়েছিল। মনে হয়েছিল যাক, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো হল।
নতুন জায়গা। নতুন পরিবেশ। প্রথম রাতটা আধো ঘুম-আধো জাগরণে কেটে গিয়েছিল। চোখ বুজলেই কেবল ভেসে উঠেছিল আমাদের বাড়ি। ছোট্ট মফস্বল শহর। পিচ ঢাকা রাস্তা। গাড়ি ঘোড়া। চেনা মানুষের মুখ। দ্বিতীয় রাতে ঠিক হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই। আজ তিন দিনের দিন সব জড়তা কেটে গিয়ে ঘুমটা বেশ জাঁকিয়েই এসেছিল। কিন্তু আচমকা এমন এক চিৎকারে ঘুম টুম সব মুহূর্তে পালিয়ে গেল। বিছানায় উঠে বসে ভালো করে একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম চারপাশ। আবছা আলো-আঁধারি তে ঘরের চারটে দেওয়াল ছাড়া তেমন ভাবে আর চোখে পড়লো না কিছুই। বুক জুড়ে নিঃশ্বাসের দ্রুত ওঠানামা টের পেলাম।আমি কী ভয় পেয়েছি?
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।একরাশ কালো আঁধার সারা বাড়িটাকে ঢেকে রেখেছে নিশ্ছিদ্র আড়ালে। মাথার ওপর খোলা আকাশটায় অসংখ্য তারা জ্বলে থাকলেও তাদের এতটুকু সাধ্য নেই এ আঁধার সরায়। নৈঃশব্দ্য এ আঁধারকে যেন আরও জমাটি করে তুলেছে।চোখের দৃষ্টি হাত কয়েকের বেশি এগোতে সাহস পায় না।
ঘন আঁধারের মধ্যেও চারিদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না কিছুই। গলাটা আচমকাই যেমন শোনা গিয়েছিল তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেছে। চারপাশে এখন কেবলই নৈঃশব্দ্য।
শশীভূষণ বাবুর ঘুমটাও ভেঙে গেছে।আমার সাড়া পেয়েই হয়তো দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন। আমি তাঁর বাইরে আসার সাড়া পেয়ে ঘুরে তাকাতেই তিনি বললেন,”চিন্তার কিছু নেই অতনু বাবু। ও হল মধু পাগলা। নদী ভাঙনে ছেলেকে হারিয়ে এখন এই দশা তার। রাত-বিরেতে এমনি করেই হাঁক ছাড়তে ছাড়তে ছুটে বেড়ায়। গাঁয়ের সকলেই জানে ব্যাপারটা।আপনি নতুন এসেছেন,তাই -। যান, ঘুমিয়ে পড়ুন।”
শশীবাবুকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছিলাম।এমনিতেই গ্রামটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল।তার ওপর গত রাতে মধু পাগলের কথা শুনে তাকে একবার দেখার ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব। ব্যাপারটা জানতে পেরে শশীভূষণ বাবু বলেছিলেন,”এত করে চাইছেন যখন চলুন তবে ঘুরিয়েই আনি।”
শরতের নদী একেবারে কানায় কানায় ভর্তি। বিকেলের মরে আসা আলোয় দারুন এক মায়াময় রূপ তার। রাত জেগে মাছধরা নৌকো গুলো ভেসে পড়েছে এরই মধ্যে।নীল আকাশের ছবি নদীর সারা গায়ে। পুজো আসছে। দূরে কোথায় ঢাকের আওয়াজ। বাতাসের গায়ে হালকা হিমের ছোঁয়া। বছর চারেক আগেকার স্মৃতি সরিয়ে নদী এখন অনেকটাই শান্ত।তার পাড় দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন বসতবাড়ি গুলোর সবটাই খড় আর টালির ছাউনি দিয়ে ঢাকা। পাটকাঠি আর ত্রিপলের বেড়ার আড়াল। সামনে ফালি উঠোন।উঠোন ঘেঁষে নদী। এমনই এক উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিলো মধু পাগলের ভাই নিমাই মন্ডলের সঙ্গে।
পায়ের কাছ থেকে ছোট্ট এক মাটির ঢিল তুলে নিয়ে নদীর দিকে ছুঁড়ে দিল নিমাই। বললো,”হুঁই যেখেনে দ্যাখতাছেন নদীত গিয়া ঢিলখান পড়লো,ওইহানে ছেল আমাগের ঘর। ঘরের সামনে উঠোন। আর উঠোনের দখিন পাশে হুঁই য্যিখানে পানা ভাইস্যে যায় ওইহানে ছেল গোয়ালঘর।ঘরের ওপরই বলতি গেলি জামরুল গাছ।”
বলতে বলতে খানিক থামলো নিমাই।ফের নিচু হয়ে পায়ের কাছ থেকে আরেকটু ছোট্ট একখানা ঢিল তুলে গায়ের জোরে ছুঁড়ে মেরে বললো,’ঢিলটা ইবার য্যিখানে গে পড়লো ওইহানে ছেল বড়ো বাবলা গাছটা। সারাদিন কত বক,মাছরাঙা,পানকৌড়িরা জমায়ে আসর বসাতো। শরতের রোদ ঝলকায় উঠতো তাগের ডানায়। জানেন তো খুব এট্টা মন্দ ছিলাম না আমরা। খেতে সবজি ফলাতাম। নদীত্ মাছ ধরতাম। মনের সুখি গান গাইতাম। অথচ হঠাৎ করিই সব ক্যামন ওলোট পালোট হইয়ে গেল। ঘুম পড়া নদী হঠাৎ করিই য্যান জেগ্যে উঠলো।কী তার আক্রোশ। কত বসতবাড়ি,খিড়কি দোর,খামার খেত,গাছপালা যে গেরাস করলো। গাঁয়ের আধখানাই খাইয়ে নিল সে। তারপর দ্যাহেন আবার সে কত শান্ত। সেই আগের মতন।”
অতীতের ছবি ভেসে উঠতেই দুইচোখ ভিজে এল নিমাই মন্ডলের। গায়ের আধ ছেঁড়া গেঞ্জিটাকে ওপরের দিকে টেনে নিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে তাকালো নদীর দিকে। ভাদ্রের নদী এখন উন্মত্ত যৌবনা।বুক ভরা জল নিয়ে সে বয়ে চলেছে সাগরের সঙ্গে মিলনের আশায়। কত জলাঘাস,কচুরিপানা,আরও কত কী ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। পড়ে আসা বিকেলের আলোয় বড়ো মায়াময় রূপ তার। রাতের অপেক্ষায় ভেসে পড়া অসংখ্য মেছো নৌকোর সারি।দূরে দূরে ঢাকের আওয়াজ।
আমি তাকালাম নিমাই মন্ডলের দিকে।খেটে খাওয়া অপুষ্ট শরীর। মাথায় তেল-চিরুনিহীন উস্কোখুস্কো চুল। চোখের দৃষ্টি পড়ে আসা বিকেলের মতই ঘোলাটে। স্বপ্ন ভাঙা মানুষটাকে দেখে বড়ো কষ্ট হল। মনে পড়লো মধু পাগলের কথা। জিজ্ঞেস করলাম,”আপনার দাদা কীভাবে -“
আমায় থামিয়ে দিয়ে নিমাই মন্ডল বলতে লাগলো,”স্যিডাও ছেল শরত কাল।বর্ষা যায় যায় সমায়ে আচমকাই বিষ্টি শুরু হল। আকাশ ভাঙা বিষ্টি। থামার লক্ষণ নাই। আকাশ ভত্তি মেঘ। ইদিক নদী যেন বিষাক্ত সাপ। যেমনি তার ফোসানি, তেমনি ফুলে ফেপ্যে ওঠা। সমায় যাচ্ছে,নদী চওড়া হচ্ছে। আর নদীপাড়ের ঘর সোংসার গুলোন টলমল করছে। এই বুঝি সব গেরাস করে নদী। আর তা করলোও। দিন সাতেকের মাথায় এক সন্ধেবেলায় শুরু হল ভাঙন। পেত্থম সে টেন্যে নেল গাঁয়ের পেরায়মারী ইসকুলডা।তারপর শিব মন্দির। পরান সরকারের আমবাগান। সুবল সাহার গোয়াল। এক সমায় আমাগের উঠোনের কাছটায় এস্যে থামলো। ভাবলাম যাক,এবারের মতন বাঁচলাম। কিন্তুক না,বাঁচ্যা হল না আমাগের। নদী বুঝি দম নেওয়ার জন্যিই থেম্যেছিল। তারপর য্যাকন ফের শুরু করলো ত্যাকন তারে আটকায় সাধ্যি কার। কত বাড়িঘর সে টেন্যে নেল রাতারাতি। আমাগের ঘর সোংসার সবডাই গেল। সেইসাথে গেল দাদার একমাত্তর ছিলেডাও। কতইবা আর বয়াস ত্যাকন তার। জেবনের সুখ-আহ্লাদ গুলোন ঠিক মতন বুঝে ওঠার আগেই হারায়ে গেল।”
কথা গুলো ঈষৎ জড়িয়ে আসছিল নিমাই মন্ডলের। ক্ষনিক থামানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম,”কীভাবে হল?”
চোখ দুটো মুছে নিয়ে ফের একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিমাই মন্ডল। তারপর বলতে লাগলো,”উঠোনডা য্যাকন ভাঙা শুরু হল ঘর থ্যিকে জিনিসপত্তর বাইর করার করার খুব চেষ্টা করছিলো ছিলেডা। কিছু আনতি পারছিলোও বাইরে। কিন্তুক নিজির সাইকিলডা আনার সমায় আচমকাই ঘরশুদ্ধু – আন্ধার নদীগভ্ভে কুথায় যে হারায়ে গেল ছিলেডা।”
এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেললো নিমাই মন্ডল। একটু তফাতে নতুন করে গড়ে তোলা ঘরের দাওয়ায় বসে আনমনে বিড়বিড় করে চলেছিলো মধু মন্ডল।আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে, “নদী জাগছে গো-ও-ও-ও- ” বলতে বলতে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল নদীপাড় ধরে। তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ফের একবার নদীর দিকে চেয়ে রইলাম আমি। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সারি সারি কতগুলো বাড়ি। টিন টালির ছাউনি দেওয়া ঘর। গোয়াল। আমগাছ। জামরুল গাছের ছায়া। আর বছর সতেরোর কিশোর – যার হাতে ধরা একটা সাইকেল।।
( সমাপ্ত)