গোলাপ কাঁটা
হোটেলে নিজেদের রুমে পৌঁছে পোষাক পরিবর্তন করার অবসরে আকাশ আর্তনাদ করে উঠল, আমার মোবাইল!
আর একপ্রস্থ সার্ট প্যান্টের পকেটে দেখে নিল আকাশ। তারপর ব্যাগের সাইড পকেটের চেন খুলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, আমি কখনো ব্যাগে মোবাইল রাখি না। সাধারণত প্যান্টর পকেটে থাকে। কিন্তু আজ….
এক এক করে ব্যাগের সবকটা পকেট হাতড়ে দেখে না পেয়ে আকাশ মনে করার চেষ্টা করে শেষ কখন মোবাইল ব্যবহার করেছে। টোটোয় চেপে বাসস্ট্যান্ডে আসার পথে রবিঠাকুরের গান শুনেছে স্পষ্ট মনে আছে। লাঞ্চ সেরে হোটেল থেকে বেরোনোর পথে রোজের মেসেজ এসেছিল, উত্তর দিয়েছে। আর কোন কল এসেছিল কিংবা সে কাউকে কল করেছে? স্মৃতি হাতড়ে কোন উত্তর পেল না।
ততক্ষণে আমজাদ আকাশের নম্বরে কল দিতে শুরু করেছে। পরপর কল করে যাচ্ছে সে। প্রতিবার একই রিপ্লাই আসছে – আপনার ডায়াল করা নম্বরটি বর্তমানে সুইচ অফ রয়েছে।
একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে সে বলল, না আর কোন সম্ভাবনা নেই।
সময়ের নিরেখে মোবাইল জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ। মুখভাষ্য আদানপ্রদান শুধু নয়, বিনোদন থেকে বাণিজ্য, এমন কোন কাজ নেই ছোট্ট এই যন্ত্রটি করতে পারে না। অনেকে ব্যক্তিগত তথ্য সঞ্চয় করে রাখে, সেক্ষেত্রে মোবাইল হারালে তথ্যের অপব্যবহার হবার ভয় থাকে। আকাশ সেদিক থেকে সেফ, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মোবাইলে রাখে না সে। কিন্তু যা ছিল তাইবা কিসে কম? শুটিং ক্যাম্পের কর্তা কোচ অফিসিয়ালদের কন্টাক্ট নম্বর মজুত ছিল ফোনে, সেগুলো আবার জোগাড় করতে হবে। খুব একটা কঠিন কাজ নয়, গুগল সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু….
বন্ধুর চঞ্চল ভাব আমজাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। সে বলল, ভাবছিস রোজের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ রাখবি?
দেবু তাড়া দিলে একে একে তিনজনে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এল। তারপর একসঙ্গে হাঁটা দিল গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে।
গ্রাউণ্ড ফ্লোরের অর্ধেকটা নিয়ে ডাইনিং স্পেস। কম করে হলেও চার সিটের বিশখানা টেবিল পাতা আছে। কোণের দিকের একটা টেবিল বাদে সব ভরে উঠেছে। সবার সামনে প্লেট ভর্তি খাবার। কেউ কেউ মন দিয়ে খেলেও সেন্ট পারসেন্ট মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ টিভি স্ক্রিনে। কী ব্যাপার!
সকালের ঘটনার কথা তারা জানে না। ট্রেন-বাস করে ব্যস্ততার মাঝে সময় অতিবাহিত হয়েছে। পথে এ নিয়ে কাউকে কোনরূপ আলোচনা করতে শোনেনি। অথবা আলোচনা হয়ে থাকলেও, শোনার মানসিকতা না থাকায় তাদের কানে ঢোকেনি।
ততক্ষণে দেবু ও আমজাদ চেয়ারের দখল নিয়েছে। আকাশকে আর্তনাদ করতে শুনে আমজাদ বলল, আবার কী হল?
বেয়ারার থেকে মেনু কার্ড নিয়ে নিজের নিজের পছন্দের খাবার অর্ডার করল তিনজনে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টিভি স্ক্রিনে।
তৃতীয় আর একজন পিছনের টেবিল থেকে বললেন, সরকারি দপ্তরগুলো কর্মীর অভাবে কোমায় যেতে বসেছিল। ধীরে হলেও কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমার পাড়ার দুটো ছেলে স্কুল শিক্ষকের পরীক্ষায় পাশ করেও নিয়োগ পাচ্ছিল না। গতমাসে ওরা জয়েন করেছে।
আরও অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করছে। আকাশ চুপচাপ শুনছিল। সে এবার মুখ খুলল, রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিসর্জন দেওয়া, সিএম স্যারের এই কাজে আমি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছি। বিগত কয়েক বছর আমরা মন্দির-মসজিদ কাজিয়া করে শক্তি ক্ষয় করেছি। উঃ! কী দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল? মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল ক্রমশ। সবার মনে ভয়, এই বুঝি বিধর্মীর খড়গ আছড়ে পড়ল গর্দানে।
ইত্যাবসরে এক যুবক এসে আকাশের পাশের চেয়ারে বসল। পরনে জিন্স টি-সার্ট। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল, মুখে চাপদাড়ি। ঘোলাটে চোখ। ডানহাতের কব্জিতে লোহার বালা। বসে বসেই সে চিৎকার দিল, বেয়ারা একমগ ব্ল্যাক কফি দাও। তারপর আকাশের কানের গোড়ায় মুখ লাগিয়ে আস্তে করে উচ্চারণ করল, মিস্টার আকাশ।
চারশ চল্লিশ ভোল্টের কারেন্ট খেল যেন আকাশ। – কে আপনি? আমার নাম জানলেন কী করে?
আকাশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালে সে পুনরায় বলল, রোজ ম্যামের সঙ্গে একদম ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করবে না।
বেয়ারা খাবার দিয়ে গেল। কোনদিকে না তাকিয়ে দেবু-রা হামলে পড়েছে, যেন কতদিন না খেয়ে আছে। আকাশ প্লেট থেকে একপিস স্যাণ্ডউইচ তুলে নিয়ে ছোট করে কামড় দিল। চিবোতে চিবোতে যুবকের দিকে কাত হয়ে বসল। তারপর বলল, একথা বলতে রোজ তোমাকে পাঠিয়েছে এখানে?
আকাশের শেষ কথাগুলি আমজাদের কানে গিয়ে থাকবে। সে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে রে?
স্যাণ্ডউইচে দ্বিতীয় কামড় দিল আকাশ। যুবক ক্ষুব্ধ হলেও বিস্ফোরিত হল না। হিমশীতল কন্ঠে হিসহিস করে বলল, এই তোমার শেষ কথা?
ছেলেটি কী বুঝল সেই জানে। কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেল।
রুমে ফিরে ভিতর থেকে দরজা লক করে দিয়ে খাটের উপর গোল হয়ে বসল তিনজনে। বিষয়টা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা দরকার। আমজাদ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলল, তোদের সব কথা শুনতে পায়নি। কী বলছিল ছেলেটা খুলে বল?
দেবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমজাদ বলল, রোজ নামের মেয়ে দুনিয়ায় একটাই আছে বুঝি? আমরা যাকে নিয়ে আলোচনা করছিলাম সে-ই যে তার রোজ, ও ব্যাটা বুঝলো কী করে? থামল আমজাদ। তারপর বলল, আকাশের মোবাইল চুরি, তারপর এই হুঁশিয়ারি। সমীকরণ খুব সহজ নয় ফ্রেন্ড।
আমজাদ কথা শেষ করতে পারল না, দেবুর মোবাইল চিৎকার করে উঠল। আননোন নম্বর। কল রিসিভ করলে ওপ্রান্তের লোকটা হিসহিস করে বলল, গোলাপ তুলতে এসেছ, কাঁটার খোঁচা সহ্য করতে পারবে তো?