আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক। প্রদীপ মাশ্চরক। পর্ব-১৫ - শৃণ্বন্তু আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক। প্রদীপ মাশ্চরক। পর্ব-১৫ - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৩ পূর্বাহ্ন

আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক। প্রদীপ মাশ্চরক। পর্ব-১৫

আপডেট করা হয়েছে : শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮:৪৭ অপরাহ্ন
আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক। প্রদীপ মাশ্চরক। পর্ব-১৫

আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক: প্রদীপ মাশ্চরক।। পঞ্চদশ পর্ব

এই পর্বে: জন চিভার (John Cheever)

John Cheever (1912-1982)
জন চিভার (১৯১২ -১৯৮২)

জন চিভার একজন আমেরিকান novelist আর ছোটগল্প লেখক। তাকে অনেক সময় আমেরিকার শহরতলির চেকভ (Chekov) বলা হয়। ম্যানহাটানের Upper East side, নিউ ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীরের ছোট শহর (যেমন Quincy) আর ইতালির Rome শহর জনের লেখার প্রেক্ষাপট। তার ছোটগল্পের সখ্যা প্রচুর, কয়েকটি গল্পের এক সঙ্কলন The Stories of John Cheever ১৯৭৯ সালে Pulitzer Prize for Fiction আর National Book Critics Circle Award পায়। ১৯৮২ সালে মৃত্যুর ছয় সপ্তাহ আগে আমেরিকান একাডেমি অফ আর্টস এন্ড লিটারেচার তাকে National Medal for Literature পুরস্কারে সম্মানিত করে।
ছোটগল্প ছাড়াও চিভার ৫টি উপন্যাস, The Wapshot Chronicle (National Book Award, 1958), The Wapshot Scandal (William Dean Howells Medal, 1965), Bullet Park (1969), Falconer (1977) আর Oh What A Paradise It Seems (1982) লিখেছিলেন। তার লেখায় মানুষের চরিত্রের বাইয়ের শোভন দিকের সাথে অন্তরের কদর্যতার দ্বন্দ্ব বারবার ফুটে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব কখনো দুই ভাইয়ের মধ্যে দিয়েও দেখান হয়েছে। এছাড়া সময়ের সাথে সাথে আমাদের হারিয়ে যাওয়া দৈনন্দিন জীবনের রীতিনীতি আর সাংস্কৃতিক ভাবধারার বদলের ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কিভাবে শহুরে জীবনের বিচ্ছিন্ন যাযাবরের জীবনযাত্রায় নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে তাই নিয়েও জন চিভার অনেক লিখেছেন।

জন উইলিয়াম চিভার ১৯১২ সালে Massachusetts ষ্টেটের Quincy শহরে এক উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২০ সাল নাগাদ যখন এই এলাকার চামড়া ও বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্যে ভাঁটা পড়ে, জনের বাবা (এক জুতোর ব্যবসায়ী) দৈন্যতার কবলে পড়েন। স্কুলে পরার সময় জন এক গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান। কিন্তু ক্রমে তার পড়াশোনায় উৎসাহ চলে যায়। তার সাথে বাবার অর্থনৈতিক পতনের পর বাড়ি নিলাম আর মা বাবার ডিভোর্স হবার ফলে জন ও তার বড় ভাই Fred বাড়িছাড়া হয়ে এক ছোট ফ্লাটে গিয়ে ওঠেন। এর পর জন নিউ ইয়র্ক শহরে চলে যান আর জীবনের বেশির ভাগ সময় ওই শহরেই কাটান।

১৯৩৫ সালে The New Yorker পত্রিকা জনের Buffalo গল্পটি ৪৫ ডলারে কেনে, শুরু হয় চিভারের লেখক জীবন। এর পর কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করার পর তার সাথে Mary Winternitzএর পরিচয় হয় ও ১৯৪১ সালে তাদের বিবাহ হয়। পরের বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জন US Armyতে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে তার The Way Some People Live নামের ছোটগল্প সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজের তেমন সাড়া না পাওয়ায় জন লজ্জা ও রাগের মাথায় বইটির অনেক কপি পুড়িয়ে দেন। কপাল ক্রমে বইয়ের এক কপি MGM স্টুডিওর চোখে পড়ে এবং তিনি নিউ ইয়র্ক শহরের Paramount স্টুডিওতে চাকরি পেয়ে যান। সেই সময় তিনি শহরের East sideএ এক ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন, সেখানেই তিনি লেখায় পুরোপুরি ভাবে মনোনিবেশ করেন। চিভার তার অনেক গল্প নিউ ইয়র্কের এক কল্পিত Shady Hill এলাকার প্রেক্ষাপটে লিখে গেছেন।১৯৪৭ সালে The Enormous Radio গল্পটি The New Yorker পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহলে সাড়া জাগে আর জন আরও বড় আর জটিল গল্প লেখার প্রেরণা পান। ১৯৫১ সালে Goodbye My Brother গল্পটি প্রকাশের পর তিনি Guggenheim Fellowship পান ও শহরের সম্ভ্রান্ত Westchester এলাকায় একটি ছোট বাড়িতে এসে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে The Wapshot Chronicle প্রকাশের পর জন সপরিবারে ইটালি চলে যান। ১৯৬৪ সালে The Wapshot Scandal বইটির প্রকাশের পর জনের ছবি Time ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হয়। পরপর অনেক গল্পের প্রকাশের মাঝে The Swimmer গল্পটি নিয়ে চলছিত্র নির্মাণের পর জনের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়ে চিভার মদ্যপ হয়ে পড়েন ও তার পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। তার এইসময়ের মনের গভীর অন্ধকারের ছবি ১৯৬৯ সালে প্রকশিত Bullet Park গল্পে পাওয়া যায়। সত্তর দশকে অত্যধিক মদ্যপানের ফলে চিভারের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে, বিবাহিত জীবনে অশান্তি চরমে উঠলে তিনি Boston Collegeএ পড়ানোর চাকরি নিয়ে বস্টনে চলে যান। এর পড় ভাই Fredএর সহায়তায় জন পুনর্বাসনে যোগ দেন ও ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। ১৯৭৭ সালে Falconer বইটি প্রকাশের আবার পাঠক সমাজে সোরগোল পড়ে যায়। নিঃসন্দেহে মানুষটি এক বিচিত্র জীবন কাটিয়ে গেছেন!

এবার এই লেখকের লেখায় আসি। আমি জনের গল্পের এক বিশাল Fan. তার কয়েকটি গল্প দিয়েই তার পরিচয় দিই।

প্রথম গল্পঃ The Enormous Radio (১৯৪৭)
নিউ ইয়র্ক শহরের Sutton Place এলাকার এক ফ্ল্যাটবাড়িতে Jim আর Irene Westcott তাদের দুই ছেলে নিয়ে বাস করে। পরিবারের সবাই গান শুনতে ভালবাসে, স্বামী স্ত্রী প্রায়ই কনসার্টে যায়। বাড়ির রেডিওটা খারাপ হয়ে গেলে, Jim আর একটি রেডিও অর্ডার দেয়। এই নতুন রেডিওটি Ireneএর মতে কদর্য, মস্ত এক কাঠের ক্যাবিনেট, পাঁচ ছটা দুম্বো ডায়াল, আর রেডিও অন করলে ডায়ালে একটা বিচ্ছিরি সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। এই নিয়ে অবশ্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাধে না। একদিন সন্ধ্যে বেলায় Irene যখন রেডিওতে গান শুনছে সে গানের সাথে একটা ঘসঘসে শব্দ শুনতে পেল, বিরক্ত হয়ে ডায়াল ঘুরিয়ে সেই শব্দ বন্ধ করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো ওই শব্দ আসলে পাশের বাড়ির মানুষের কথাবার্তার আবছা আওয়াজ যা রেডিও দিয়ে আসছে। পরে Jim বাড়ি এলে আবার তারা রেডিও অন করে, তখন রেডিওতে গানের বদলে ফ্ল্যট বাড়ির লিফটের আওয়াজ আর দরজার কলিংবেলের শব্দ আসতে লাগলো। Jim রেডিওর ইলেক্ট্রনিক্স এই বাইরের বৈদ্যুতিক সিগনাল ধরছে ভেবে রেডিও সারাবার লোক ডাকলো। রেডিও সারাবার পরের দিন Irene এক সিম্ফনি শুনতে বসেছে, আচমকা বাজনার বদলে সে পাশের বাড়ির এক পুরুষ আর এক মহিলার ঝগড়া স্পষ্ট শুনতে পেল। ঝামেলা এড়াবার জন্য রেডিওর স্টেশন বদল করলে সে পাশের ফ্ল্যটের ছোট মেয়েটার ধাত্রীর তাকে গল্প বলার কথা শুনতে পেল। এরপর সে রেডিওয় যে স্টেশনই ধরে, কোন না কোন ফ্ল্যটের কথোপকথন শোনা যায়। কৌতূহলী হয়ে এরপর থেকে Irene রেডিওতে নিয়মিত প্রতিবেশীদের জীবনের কথাবার্তা শুনতে শুরু করলে তাদের নানা বচসা, মনোমালিন্য আর চক্রান্তের কথা তার কানে আসে। ক্রমে Ireneএর এই রেডিওর মাধ্যমে কানপাতার নেশা ধরে গেলো, সে বন্ধুর সাথে পার্কে বেড়াতে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যায়, প্রতিবেশীদের জীবনে আর কি গোলমাল হোল তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। বাড়িতে এক ডিনার পার্টিতে Jim তার স্ত্রীর এই রেডিও শোনার জন্য ছটফটানি লক্ষ্য করে। কিছুদিনের মধ্যে Irene তার সহজ সরল মনোভাব আর মিষ্টি ব্যবহার হারায়, সে নিজের জীবনে তার সাথে Jimএর সম্পর্ক নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ে। মরিয়া হয়ে Jim অনেক খরচ করে সেই রেডিও সারায়, কিন্তু Westcott পরিবারের সেই আগের সুন্দর শান্তির জীবন হারিয়ে যায়।

দ্বিতীয় গল্পঃ Goodbye, My Brother
সমালোচকদের মতে এই গল্পটি চিভারের “fiction masterpiece”। ১৯৫১ সালে The New Yorker ম্যাগাজিনে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গল্পে Massachusetts ষ্টেটের সমুদ্রপারে এক ধনী Pomeroy পরিবারের গ্রীষ্মাবাসে পরিবারের মানুষগুলোর শেষ জমায়েতের এক বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনা পাওয়া যায়। এই গ্রীষ্মাবাসে দুই ভাই, এক বোন আর তাদের বিধবা মা একত্রিত হয়েছে। যদিও তাদের দেখাশোনা খুব কমই হয়, তাদের মধ্যে গভীর হৃদ্যতা রয়েছে। পরিবারের তৃতীয় ছোট ভাই Lawrence এক মুখকাটা উকিল, যে তার ভাইদের নৈতিক ত্রুটি নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা করে। এই তিক্ত বদরাগী ভাই Lawrence জমায়েতে হাজির হলে তার নিজের গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ভাইদের এবং বিশেষ করে পরিবারের মহিলাদের সহনশীল জীবনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির খটাখটি লাগে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিল কম, বিশেষত Lawrence জমায়েতে আসার পর বাড়িতে একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সবাই ড্রিঙ্ক নিয়ে বসলে Lawrence সমুদ্রতীরে একা ঘুরতে চলে যায়। ডিনার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে জেনেও সে টেবিলে আসতে দেরি করে। খাবার পর বড় ভাইয়ের বউ Diana তার এক বন্ধুর সাথে একটু বেড়াতে গেলে Lawrence Dianaর নামে নোংরা ইঙ্গিত করে। সবাই বোঝে পরিবারের এইসব খোলাখুলি মেলামেশা সে পছন্দ করে না। Lawrence এই পৈত্রিক বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের অভাব নিয়ে প্রায়ই সবাইকে বিরক্ত করে। ছেলেমেয়েদের বিনা কারণে কাঁদায়। বাড়িতে রান্নার মহিলাকে ভীষণ বিরক্ত করে। রাত্রে খাবার পর পরিবারের সবাই যখন সামান্য বাজি ফেলে বোর্ডগেম খেলা শুরু করে, সে যোগ দেয় না আর জুয়া নিয়ে সবাইকে জ্ঞান বিতরণ করে। ভাইদের আর মার খেলায় হারজিত নিয়ে বিদ্রূপ আর তাচ্ছিল্য করে। এক সন্ধ্যে বেলায় দ্বিতীয় ভাইয়ের বউ Odette বড়ভাইকে নিয়ে মস্করা করলে সে সরাসরি তাকে flirt বলে অপমান করে। পাড়ার ক্লাবের পার্টিতে সবাই নাচগান করার সময় Lawrenceএর দেখা নেই। অবশেষে একদিন সকালে সমুদ্রতীরে বড় ভাইয়ের সাথে হাঁটার সময় সে জানায় তার পরিবারের এই জীবনযাত্রার ধারা সে ঘৃণা করে, সে শুধু Pomeroy পরিবারের গ্রীষ্মাবাসে শেষ বারের মতো এসেছে এই বলতে যে সে তার বাড়ির ভাগ ভাইদের বিক্রি করে চলে যাবে। সারা জীবনেই Lawrence পরিবারের সব রীতি ভেঙ্গে আজ এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সে সব কিছু থেকে আজীবন Goodbye বলে বিদায় নিয়েছে। বড়ভাই তার মত বদল করার অনুরোধ করলে সে বলে বাড়ির দুই বউ বোকা আর ফষ্টিনষ্টি করে, মা মাতাল, বাড়ি সমুদ্রে ভেঙ্গে পড়ল বলে, আর তুই এক মূর্খ! বড়ভাই ক্রোধে অন্ধ হয়ে এক ভারী কাঠের তক্তা দিয়ে Lawrenceএর মাথায় মারে, রক্তাত্ত মাথা চেপে Lawrence বালির ওপর পড়ে যায়। গল্পের শেষে সবাই ফেরার জন্য তৈরি হয়, আহত Lawrence তার পরিবার নিয়ে পেছনে না তাকিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

Goodbye, My Brother গল্পটি বিংশ শতাব্দীর মানুষের প্রাণখোলা জীবনযাত্রার সাথে গোঁড়া খ্রিস্টীয় সামাজিক রীতিনীতির সংঘাত নিয়ে। এক পরিবারের বিভিন্ন মানুষ এই সংঘাতের ফলে একে অন্যের থেকে কিভাবে দূরে চলে যায় তার এক প্রাণবন্ত বর্ণনা আমরা পাই চিভারের এই গল্পে। প্রসঙ্গত চিভার এই গল্পে প্রথম মানুষের শরীরের নগ্নতা নিয়ে সমাজে যে গোঁড়া মনোভাব আছে তাকে নড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন। ইডেনের বাগানে যেমন নগ্নতা স্বাভাবিক, চিভার সেই নিষ্পাপ স্বাভাবিকতার ইঙ্গিত দিয়েছেন গল্পের শেষ প্যারাগ্রাফে।
The sea that morning was iridescent and dark. My wife and my sister were swimming- Diana and Helen – and I saw their uncovered heads, black and gold in the dark water. I saw them come out and I saw that they were naked, unshy, beautiful, and full of grace, and I watched the naked women walk out of the sea”. এখানে গ্রীক সৌন্দর্যের দেবী Venus যেন সমুদ্র থেকে উঠে আসছেন এমন এক ছবি আঁকা হয়েছে।

তৃতীয় গল্পঃ The Five-Forty-Eight
এই গল্পটি The New Yorker পত্রিকায় ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। গল্পটি The Stories of John Cheever সঙ্কলনেও রয়েছে। গল্পের প্রেক্ষাপট নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানের শহরতলিতে, চিভারের কল্পিত Shady Hill এলাকায়। গল্পের নাম একটি সাবওয়ে ট্রেনের নম্বর যেটি মানুষকে ম্যানহাটানের অফিসপাড়া থেকে শহরতলিতে নিয়ে যায়। গল্পের নায়ক এক বিশাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ Mr. Blake। গল্পের শুরু অফিসবাড়ির লিফটে, পাঁচশো আটচল্লিশ নম্বর ট্রেন ধরবেন বলে Mr. Blake নিচে নামার পথে। হঠাৎ তার মনে হোল তাকে তার এক পুরনো সেক্রেটারি অলক্ষ্যে ফলো করছে। পাছে কোনো অপ্রীতিকর মোকাবিলা হয় এই ভয়ে তিনি সেক্রেটারিকে এড়ানোর জন্য শহরের এক পানশালায় ঢুকে পড়েন। যখন পানীয় হাতে নিয়ে তিনি সেই মহিলা সেক্রেটারির (নাম Miss Dent) সঙ্গে তার পুরনো স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, আমরা সেই রহস্যময়ি Dentএর পরিচয় পাই। এই Dent কয়েক মাস আগে Mr. Blakeএর পার্সোনাল সেক্রেটারি হয়ে অফিসে আসে। মেয়েটি বেশ অপ্রতিভ, আত্মসম্মান জ্ঞান কম। প্রথম দিন এসেই সে Mr. Blakeকে একটি গোলাপ ফুল দেয় যা Mr. Blake একটু পরে ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে দেন। সপ্তাহ তিনেক বাদে Mr. Blake তাকে কাজের পর পানশালায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব করলে Dent তাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। ডিনারের পড় তারা সহবাসে মত্ত হয়। পরের দিন অফিসে লাঞ্চের সময় Mr. Blake কর্মকর্তাদের ডেকে Dentকে চাকরি থেকে বার করে দেন এবং অফিসের দারোয়ানকে বলে দেওয়া হয় সে যেন Dentকে অফিসের ত্রিসীমানায় আসতে না দেয়। Mr. Blake ভাবেন যে ঝামেলা বিদায় হয়েছে।
সেদিন পাঁচশো আটচল্লিশ নম্বর ট্রেনে সীটে বসার একটু বাদেই Mr. Blake দেখলেন Dent নিঃশব্দে তার পাশে এসে বসেছে। খসখসে নিচু গলায় সে জানায় তার ব্যাগে একটি পিস্তল আছে এবং Mr. Blake পালাবার চেষ্টা করলেই সে তাকে গুলি করবে। ট্রেনে যে দুএকজন চেনা প্রতিবেশী ছিল, তারা এই ধমকির কোনো টের পেল না। Dent এরপর অসংলগ্ন ভাবে বলতে লাগলো যে সে কিভাবে Mr. Blakeএর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তারপর সে তার ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বার করে Mr. Blakeকে পড়তে বলে। সেই চিঠিতে Dent Mr. Blakeকে তার স্বামী বলে সম্বন্ধ করেছে, Mr. Blakeকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেছে, আর বলেছে সে যখন অনেকদিন মানসিক হাসপাতালে বন্দী ছিল তার ইতিহাস। চিঠির শেষে এক প্রস্তাব, Mr. Blakeকে সে শেষ করতে চায়। ট্রেন Shady Hill স্টেশনে থামলে Dent পিস্তলের ভয় দেখিয়ে Mr. Blakeকে এক নির্জন অন্ধকার জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসায়, তারপর শক্ত গলায় বলে যে সে Mr. Blakeকে এক শিক্ষা দিতে চায় যা Mr. Blake নিজে শিখতে অক্ষম। তারপর Dentএর আদেশ মত Mr. Blake নতজানু হয়ে মুখ রাস্তার ধুলোয় গুঁজে তার জীবন ভিক্ষা করেন। Dent তার প্রতিশোধ এই ভাবে নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয়। চোখের জল মুছে Mr. Blake একটু পরিষ্কার হয়ে তার বাড়ির পথ ধরেন।
গল্পটিতে সমাজের উঁচু মহলের হামবাগ দাম্ভিক মানুষরা কিভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের অবহেলা আর উপেক্ষা করে, তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় তার এক নিদারুণ আভাস পাওয়া জায়। গল্পের উপসংহারে Mr. Blakeএর এই শিক্ষালাভ পাঠকের কাছে তাই উপযুক্ত বলেই মনে হয়েছে। ১৯৫৫ সালে গল্পটি Benjamin Franklin Magazine Award পায়।

চতুর্থ গল্পঃ The Country Husband
১৯৫৪ সালে The New Yorker পত্রিকায় প্রকাশিত চিভারের এই গল্পটি ১৯৫৬ সালে O. Henry Award পায়। গল্পটি টিভি ও চলচিত্রেও রূপায়িত হয়েছে। গল্পের নায়ক Francis Weed তার চার ছেলেমেয়ে আর বউ Juliaকে নিয়ে Shady Hill পাড়ার মধ্যবিত্ত এলাকায় থাকে। এক ব্যবসার কাজ থেকে ফেরার পথে তার প্লেন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়ে যদিও Francis বেঁচে যায়। বাড়িতে সেই গল্প বলার পর তার খেয়াল হয়ে যে পরিবারের কেউ তার ব্যাপার নিয়ে মোটেই তেমন ভাবে না। বাড়িতে এক পার্টিতে আচমকা তার এক পরিবেশিকার সাথে দেখা হয়, তার মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের সময় সে যখন ফ্রান্সে ছিল, তখন এই মহিলাকে জার্মান সৈন্যদের সাহায্য করার অপরাধে মাথা কামিয়ে উলঙ্গ করে শহরের রাজপথে ঘোরান হয়। এই গল্পও সে তার পরিবারের সাথে করে কোনও সাড়া পায় নি, Shady Hill এলাকার মানুষ এসব নিয়ে নিজেদের শান্ত নিরুপদ্রব জীবনে নাড়া দিতে চায় না। এই উপেক্ষিত জীবনে Francis একদিন তার বেবিসিটার Anneকে বাড়ি নিয়ে যাবার পথে তার মদ্যপ বাবার দুর্ব্যবহারের কথা শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করে, খুশি হয়ে Anne Francisকে চুমু খায়। উদ্ভিন্নযৌবনা Anneএর এই চুমু Francisকে আবার তার যৌবনের জীবন শুরু করার উদ্ভট স্বপ্ন দেখায়, সে ভাবে Anneএর সাথে সে কোথাও পালিয়ে যাবে। Anne এসব মোটেই ভাবে না, সে তার ছেলে বন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়ায়। রাগের মাথায় Francis সেই ছেলে বন্ধুকে জ্বালিয়ে মারে। Francisএর এই পাগলামির কথা শুনে পাড়ার গির্জার অভিভাবিকা কিছু বলতে গেলে সে অভিভাবিকাকে সোজাসুজি অপমান করে। এর ফলে গির্জার উৎসবের লিস্ট থেকে Weed পরিবারকে বাদ দেওয়া হয়। Francisএর বউ Julia আর বড় মেয়ে Helen সব কথা শুনে ভীষণ রেগে যায়। এমনিতেই সংসারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তেমন সম্পর্ক ছিল না, এই ঘটনার পর Julia ডিভোর্স করতে চাইলে Francis বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করে। এসবের পরও Anneকে নিয়ে Francisএর ফ্যান্টাসি যায় না, একদিন ট্রেনে Anneএর সাথে কথা বলার পর সে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জীবনের সব তোলপাড় দুর করার জন্য সে অবশেষে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। চিকিৎসার সাথে সাথে সে আবার তার শান্তি খুঁজে পায়, Shady Hillএর মধ্যবিত্ত মানুষের সাধারণ একঘেয়ে জীবনযাত্রাকে সে আবার তার আপন করে নেয়।
গল্পটিতে চিভার শহরতলির মাঝবয়সী মানুষের প্রেমহীন, উপেক্ষিত, গতানুগতিক জীবনে আচমকা কোনো এক ভালবাসার অভিব্যাক্তি কিরকম তোলপাড় আনতে পারে তার এক অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন। সমালোচক John O’Haraর কথায় The Country Husband …Just enough is said, and just enough withheld, for the reader to catch a glimpse of the mysterious something that makes us human. ..To his great credit, to the very end he remained obsessed with the ethical conduct that gives life shape and meaning, and the record of his moral soundings is to be found in all his published works।

পঞ্চম গল্পঃ The Swimmer
সমালোচকদের মতে ১৯৬৪ সালে The New Yorker পত্রিকায় প্রকাশিত এই গল্পটি চিভারের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প। ১৯৮৬ সালে গল্পটি নিয়ে ওই একই নামে একটি চলচিত্র তৈরি হয় যাতে Burt Lancaster অভিনয় করেন। এই গল্পে চিভার third-person স্টাইল ব্যবহার করে নিউ ইয়র্কের Westchester Countyর বাসিন্দা Neddy Merrillএর কথা বলেছেন। Neddy মধ্যবয়স্ক বিত্তশালী মানুষ যার মধ্যে এখনো যৌবনের উচ্ছ্বাস, কর্মশক্তি, আর আশাবাদ পুরোমাত্রায় সক্রিয়। একদিন অফিসের পর খামখেয়ালের মাথায় সে তার বাড়ি ফেরার পথে কয়েক জন পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার প্ল্যান করে। বাড়ি তার আট মাইল দূরে, কাজেই সে বেশ কয়েকজনের বাড়িতে বিকেলে পুলের ধারের হুটোপুটিতে যোগ দিতে শুরু করে। প্রথম দুটি বাড়িতে সে সাদর অভ্যর্থনা পায়, বাড়ির মহিলা ও পুরুষ সবাই একসাথে বসে পানাহার করে, কিছুক্ষণ জলে ঝাঁপাঝাপির পর সে চলে যায় তার পরের বন্ধুর বাড়ি। বিকেলের আলোর উজ্জ্বলতা কমার সাথে সাথে Neddyর বন্ধুদের অভ্যর্থনা ও পুলের ধারের আলাপ আলোচনা ক্রমশই বিষণ্ণ ও হতাশাজনক হয়ে ওঠে। মনের গভীরের অশুভ দুশ্চিন্তা এক এক করে বন্ধুদের আড্ডায় হাজির হয়, আবহাওয়া বদলাতে শুরু করে। এক বন্ধু জানায় তার আর্থিক দুর্বিপাকের কথা, আর এক বন্ধুর বাড়িতে মধ্যবয়সের শারীরিক ঝঞ্ঝাটের কথা ওঠে। Biswanger পরিবারের পুলের ধারে সে প্রচ্ছন্ন অপমান আর দুর্ব্যবহার পায় কারণ সেই পরিবার জেনে গেছে যে Neddy ও তার বউ Lucinda তাদের তেমন পছন্দ করে না। এর পর প্রিয়বন্ধু Eric Sachsএর বাড়ির পুল পার্টিতে সে জানতে পারে Ericএর এক বিপদজনক অপারেশানের কথা, যা Neddy জানতই না! তার পর পুরনো বান্ধবী Shirley Adamsএর পুলের ধারে Shirley তাকে অপমান করে কোনো ড্রিঙ্ক না দিয়ে বার করে দেয়। Neddyর মনের উৎফুল্লতা আর শরীরের শক্তি ক্রমশই কমে আসে, সে যতই এগিয়ে যায় তার পরের বন্ধুর বাড়ি, আড্ডার আবহাওয়া ততই খারাপ হতে থাকে। Neddy এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে সে আর ভাল করে সাঁতার কাটতে পারে না, তার শীত লাগতে শুরু করে, সে দেখে চারপাশের আলো কমে আসছে। এইভাবে বিষণ্ণতা Neddyকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করার পর সে রাস্তার ধারে বসে কাঁদতে শুরু করে। এর পর সন্ধ্যের অন্ধকারে টলমল পায়ে Neddy তার নিজের বাড়ির দরজায় পৌঁছলে সে দেখে তার বাড়ি অন্ধকার, সে বাড়িতে কেউ নেই, দরজায় অচেনা তালা।
এই গল্পটিতে চিভার তার একান্ত স্টাইলে বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে শহুরে মানুষের জীবনের ক্রমাগত ক্ষয়, সময়ের কাছে হেরে যাওয়া, আর নিজের সব কিছু হারাবার গল্প বলেছেন। সত্যি এই গল্পের তুলনা নেই।

সবশেষে আমার সবচেয়ে প্রিয় চিভারের গল্প Torch Songএর প্রসঙ্গে আসি। গল্পটি ১৯৪৭ সালে The New Yorker পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ও পরে ১৯৭৮ সালে The Stories of John Cheever সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই গল্পে চিভার মৃত্যুকে এক অনন্য উপমায় রূপান্তরিত করেছেন। গল্পের নায়ক Jack Lorey নিউ ইয়র্ক শহরে এসেছে Ohio স্টেট থেকে চাকরির খোঁজে। শহরে এক পার্টিতে তার সাথে Ohioর এক পুরনো বন্ধু Joan Harrisএর সাথে দেখা হয়ে যায়। Joan মডেলের চাকরির আশা ত্যাগ করে বর্তমানে ছোটখাটো চাকরি করে দিন যাপন করে। Joanএর ঝকঝকে চেহারা, নম্র স্বভাব, আর সহনশীল হাবভাব সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। Joanএর দেখা হওয়ার পর থেকে Jack তাকে তার এক পরিচিত বন্ধু হিশেবেই ধরে নেয়। যথারীতি দুজনেই নিজের নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে যায়। পার্টিতে সাক্ষাতের পরবর্তী বছরগুলোয় Jack দুবার বিয়ে করে এবং দুবারই সেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়। এই সব দিনে Jack আর Joan তাদের যোগাযোগ ঠিক রাখে। Jack শুধু দেখে অবাক হয় যে Joanএর সেই সতেজ প্রাণবন্ত রূপ একই রকম রয়েছে। আর একটা বিষয় তার লক্ষ্যে পড়ে যে Joanএর সব প্রণয়ীরাই আধবুড়ো মদ্যপ হতভাগ্য মানুষ। Joanএর সাথে তারা প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করে কিন্তু সব সয়ে নিয়ে ধৈর্য ধরে সে তাদের যত্ন করে যায়। সেই মানুষগুলোর শরীর ক্রমে ভেঙ্গে পড়ে, একজন একজন করে মারা যায়। কিন্তু Joanএর রূপ থাকে অমলিন, সে চলে যায় আর একজন প্রণয়ীর ফ্ল্যাটে তাকে সাহায্য করার জন্য! এই সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে Jack যুদ্ধে চলে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সে যখন আবার নিউ ইয়র্কে ফিরে আসে তখন তার শরীর খুব খারাপ আর আর্থিক অবস্থা বড় করুণ। হঠাৎ একদিন তার ফ্ল্যাটে Joan হাজির হয় তাকে শুশ্রুষা করার জন্য। তার সেই অপরূপ অমলিন রূপ, কালো পোশাক, মুখে শান্ত হাসি। Jackএর সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেলো Joanএর সব পুরনো প্রণয়ীদের কথা, তারা কেউ তাদের শরীর খারাপ বা দুর্দশার হাত থেকে রেহাই পায়নি, এক এক করে তারা মারা গেছে Joanএর হেফাজতে! এইবার Jack বুঝলো যে Joan মৃত্যুর হিতৈষী দূত, সে এসেছে তাকে তার শেষ দিনগুলো পার করে দিতে। “বেরিতে যাও, দুর হয়ে যাও” চিৎকার করে Jack তাকে ঘর থেকে বার করে দেয়, তবুও শান্ত স্বরে Joan “সন্ধ্যের পর আসব” উত্তর দিয়ে বিদায় নেয়। এর পর Jackএর খবর কেউ জানে না। গল্পটির প্রসঙ্গে সমালোচক Patrick Meanor আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, “There is no question that her (Joan’s) character has a vampiric quality, but what makes her the frightening figure she becomes as the story unfolds is that she seems totally unaware of her mythical identity or her necromantic powers… Nowhere does Cheever state or suggest that Joan consciously seeks out men to destroy. She takes them as she finds them, and if anything, it is her passivity that seems to draw out the worst in them.”

John Cheever নিঃসন্দেহে আমেরিকার এক অন্যতম গল্পকার। তিনি সারা জীবন মানুষের গল্পই লিখে গেছেন, তার চোখ দিয়ে আমরা আমেরিকার শহুরে মানুষগুলোর জীবনের সাথে পরিচিত হয়েছি, তাদের জেনেছি। এই কারণেই চিভারের লেখা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!