ধারাবাহিক উপন্যাস: মায়ের বাড়ি।। বিষ্ণু সরকার।। পর্ব-২ - শৃণ্বন্তু ধারাবাহিক উপন্যাস: মায়ের বাড়ি।। বিষ্ণু সরকার।। পর্ব-২ - শৃণ্বন্তু
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

ধারাবাহিক উপন্যাস: মায়ের বাড়ি।। বিষ্ণু সরকার।। পর্ব-২

আপডেট করা হয়েছে : সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫:১৮ অপরাহ্ন
ধারাবাহিক উপন্যাস: মায়ের বাড়ি।। বিষ্ণু সরকার।। পর্ব-২

ধারাবাহিক উপন্যাস
মায়ের বাড়ি
বিষ্ণু সরকার

(পর্ব – ২)

মাস্টার আমাকে অনেক বকা দিয়েছে। বকা দিয়েছে পড়া কিছুই পারিনি বলে। আরও বলেছে, সামনের দিন পড়া না পারলে আমাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে রাখবে বড় রাস্তার সামনে। মাস্টার চলে যাওয়ার পড়ে আমি ভীষণ কেঁদেছি। কেঁদেছি পড়া কেন পারিনি তার চেয়েও মায়ের কথা ভেবে। মা নিশ্চয়ই ভেবেছে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না আর। অন্তত পড়াশুনো তো নয়ই। মাস্টারদা যখন বকা দিচ্ছিল, মা নিশ্চয়ই আড়াল থেকে শুনছিল সে সব। আমার আরও কান্না পাচ্ছিল সে-কথা ভেবে। অথচ মাস্টার চলে যাওয়ার পড়ে আমি মায়ের কাছে গেছি, দেখি দিব্যি মা আমাকে সে-সব কথা কিছু জিজ্ঞেস না করে, ভাত বেড়ে দিয়েছে খেতে। গরম ভাত। সঙ্গে আরও কত কি। আমি ভাত খেয়ে উঠে বেড়িয়ে পড়েছি খেলবো বলে।
আজ তো ছুটির দিন। ছুটির দিনে আমি সারাদিন খেলি। আমার স্কুল থাকে না, বাড়ির পড়া থাকে না। মাও সেদিন আমাকে আর পড়তে বসতে বলে না। সোনামণিদের বাড়ি পেরিয়ে ফাঁকা মাঠটাকে ঘিরে আমাদের ফুটবল, ক্রিকেট খেলার আয়োজন। আমরা ছেলেরা সেই মাঠে দাপিয়ে সারাটা দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, একদম সন্ধ্যে পর্যন্ত খেলবো। যতক্ষণ না মায়ের ডাক আসবে। মা ডাকলেই আমাকে ফিরে আসতে হবে ঘরে।
সোনামণিদের বাড়ি পেরলে এদিকে অনেক মাঠ। একদিকে ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে ফসল তোলা হয়ে গেলে কেমন আল ধরে আমাদের ছুটে চলা। সেই মাঠে স্যালো মেশিনের জল। ধান তোলা হয়ে গেলে হয়তো অন্য কোনও সবজি চাষ। আমরা সেই আল ধরে বয়ে চলা স্যালো মেশিনের জল ধরে এক মাঠ পেরিয়ে অন্য মাঠে পৌঁছে যাবো। এদিকের সব মাঠই সবুজ, সব মাঠই ঘাসে ভরা। এখন বর্ষার সময় নয়, তবু মাঠগুলো এখনও সবুজ হয়ে আছে। আমরা ছেলেরা দল বেধে সেই মাঠে নেমেছি। আরও কত ছেলেরা এসেছে আশপাশের পাড়া থেকে। আমাদের খেলা দেখতে এসেছে বড়রা কেউ কেউ। সবাই দেখছে আমাদের ছোটদের খেলা। দেখছে আমাকে আর মিঠুনে।
মিঠুন দিন কয়েক হল আমাদের পাড়ায় এসেছে। সরকার বাড়ির ঘর ভাড়া নিয়ে উঠেছে ওরা। মিঠুন পড়াশুনোয় যেমন ভালো, খেলাধুলাতেও দারুণ। সব বিষয়েই ওর অন্যরকম আগ্রহ। অল্প দিনেই কত ভালো বন্ধু হয়ে গেছি আমরা। যেদিন দুপুরে খেলা থাকে না, স্কুল থেকে ফিরে আমি আর মিঠুন মাঠের একপাশে বসে গল্প করি। কত গল্প জানো মিঠুন। রোজ আমাকে সে-সব শোনায়। আমি মিঠুনের হাত ধরে কল্পনার সাগরে ডুব দেই।


এই মিঠুনদের কোন বাড়ি ছিল না। কয়েক মাস কিংবা বছর, কিছুদিন অন্তর ওদের ভাড়া বাড়ি বদলাতে হত। এক পাড়া থেকে চলে যেতে হত অন্য পাড়ায়। আমি মিঠুনকে বলি, ‘আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না তো।’ মিঠুন আমার হাত চেপে ধরে। ওর চোখ ছলছল করে ওঠে হঠাৎ। তারপর একদৌড়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আরও বেশি করে পড়ালেখায় মন বসায়। মিঠুন জানে, সেকথা একদিন বলেওছিল আমায়, ‘যদি ভালো করে পড়াশুনো করো, দেখবে একদিন তোমার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, যাবেই—।’ মিঠুনের গলায় প্রত্যয়। অথচ মিঠুন ঠিক কী চাইছে বুঝতাম না। শুধু রাগ হত খুব ওকে মাঠে না পেলে। এমনকি বিকেল হয়েছে, আমাদের খেলার সময় আমরা সবাই মাঠে হাজির, শুধু মিঠুন নেই তখনও।
সঞ্জয় বলল, আজ মিঠুনের খেলা বন্ধ। ওর বাবা বাড়ি এসেছে সবে।
মাইকেল বলল, ওর বাবা তো কাপড়ের কারখানায় কাজ করে। আবার বাড়ি ফিরে সেলাইও করে। এই সময় মিঠুন ওর বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগায়।
আমার তখন খুব রাগ হয়। তাই বলে খেলার সময়ও মিঠুনকে কাজ করতে হবে?
আমাদের তখন খেলার মাঠ জুড়ে মনখারাপ। আমরাও তখন খেলা ছেড়ে মিঠুনের অপেক্ষায়। কখন ওর কাজ শেষ হবে, কখন ওদের পাচিল টপকে একদৌড়ে ছুটে আসবে সোজা মাঠের দিকে। এসেই বলবে, চল শুরু করি এবার।
সন্ধ্যেবেলা মায়ের ডাকে ঘরে ফিরি। মনটা তখনও মিঠুনের জন্য খারাপ। মা কেন জানি আমার মন খারাপ হলে ঠিক বুঝে ফেলতে পারে। জানতে চায়, ‘কি হয়েছে বল আমায়।’ আমি বলি মিঠুনের কথা। বলি আমার বন্ধুর কথা। বলি আজ সারাটা বিকেল কাজ করলো বলে, মাঠে খেলতে আসতে পারেনি সেই কথা। বলি, লেখাপড়ায় কত ভালো মিঠুন জানো মা। ও নিজেই বলেছে আমায়। এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হবেই হবে, দেখে নিও। আমার চোখে জল দেখে মা কেমন বুকে জড়িয়ে নেবে আমায়।
রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখবো, আমি আর মিঠুন কতদূর চলে এসেছি ক্রিকেট খেলতে। কত বড় মাঠ। হয়তো ম্যাচ হবে আজ। আমাদের পেছন পেছন এসে দাঁড়াবে সঞ্জয়, সুবীর, মাইকেল, সাহেব, লিটন, পার্থ— আমাদের সমবয়সী ছেলেদের দল। আমি দেখবো মিঠুনের হাতে ব্যাট। এগিয়ে যাচ্ছে সবার আগে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমরা। আমাদের সামনে ফাঁকা মাঠ জুড়ে বাইশ গজের পিচ। আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দলের উঁচু-লম্বা ছায়া। আমি দেখবে সেই দলের সবাই আমাদের চাইতে বয়সে কত বড়। অথচ তারাও আজ আমাদের দলকে মাঠে নামতে দেখে করতালি দিচ্ছে। আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
দেখবো, টসে জিতে আমরা ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর মিঠুন ওপেনিং জুটি মাঠে নামছি ব্যাট হাতে। পুরো মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে পরা উত্তাপ। সেই দুপুর রোদে প্রথম বলেই ছয় মারবে মিঠুন। তারপর দুটো চার। একটা শর্ট রান নিয়ে আমায় ব্যাট করার সুযোগ দেবে। চতুর্থ বলটা ইয়র্কার, কোন মতে সামলে নেবো আমি। তারপর দু-দুটো চার। এরপর তো শুধুই রানের বন্যা। ঝড় তুলবে মিঠুন। ওকে সঙ্গ দিয়ে আমিও।
এরপর হঠাৎ করে যে কি হয়ে যাব! আমাদের ঝড়ের ইনিংসটা থমকে যাবে একটা বাউন্স বলে। আউট হয়ে ফিরে যাবে মিঠুন। আমাদের দলও এরপর ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মত। গড়াতে গড়াতে একেবারে শেষ উইকেট।
আমি দেখবো, ফিল্ডিং করতে এসে মিঠুন বল তুলে দেবে আমার হাতে। কানে কানে বলবে কিভাবে ভাঙতে হবে দেওয়াল। বল হাতে দৌড় শুরু করবো আমি। আমার সামনে উঁচু উঁচু ছায়া। পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দলের ব্যাট। আপ্রাণ দৌড় শুরু করবো আমি। দৌড়তে দৌড়তে ভাববো মিঠুনের কথা। তারপর লম্বা লাফ। হাত ঘুরিয়ে বলটা সোজা ছুড়ে দেবো উইকেট লক্ষ্য করে। চিৎকার করে উঠবো ক্যাচ—ক্যাচ—বলে। অথচ কি সহজ ক্যাচটে ফেলে দেবে সঞ্জয়।
মিঠুন কিন্তু হাল ছাড়বে না তখনও। ভরসা দেবে আমায়। ফের নতুন করে ভাবতে বলবে। আমিও ফের নতুন করে দৌড় শুরু করবো আবার। এবার আরও নিখুঁত দৌড়, টার্গেট একদম লক্ষ্য করে। দেখব, বলটা সজোরে মিডল উইকেটটাকে ধাক্কা দিয়ে গড়িয়ে পড়বে একপাশে। আউট, আউট—। সঙ্গে সঙ্গে মিঠুন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে আমায়। আমার সামনে উঁচু ছায়া তখন সরে গিয়ে ফুরফুরে বাতাস। রোদের ছড়িয়ে পড়া সেই আলো।
আমরা জিতবো, জিততেই হবে আমাদের, বলে উঠবে মিঠুন। সত্যি সত্যিই এরপর সেই আমাদের চেয়ে বয়সে বড় দাদারাও কেমন পরপর আউট হয়ে ফিরে যাবে মাঠের বাইরে। আমরা প্রায় জয়ের মুখে এসে দাঁড়াবো। আর একটা উইকেট তুলে নেওয়ার আগেই ঝড়টা উঠবে হঠাৎ।
দেখবো, চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে এলোমেলো ধুলোয় ঢেকে যাবে আমাদের চোখ। আমি দেখবো আমাদের সেই খেলার মাঠটা কেমন ধোওয়ায় ভরে নিয়ে ঢেকে দেবে আকাশ। কেমন প্রবল বৃষ্টি তারপর। মাঝে মাঝে বজ্রপাত। বুক কেঁপে উঠবে আমার। আমি লাফিয়ে উঠবো ধড়ফড় করে। ঘুম ভেঙে যাবে আমার।
মা বলবে, আবার সেই খারাপ স্বপ্ন? মা বলবে, কী দেখেছিস বল। আমি নাকি মাঝে মাঝেই এমন খারাপ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি হঠাৎ। মা জানতে চাইবে সেই স্বপ্নের কথা। সেই এমনভাবে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠার আগে ঠিক যা ঘটেছিল, তা।
আমার কিন্তু তখন আর কিছুই মনে থাকবে না। আমি তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাববো, এখন সকাল নাকি রাত? ভাববো আমার গা কি গরম হয়ে উঠছে এখন? নাহলে মা এমনভাবে কপাল ছুঁয়ে দেখবে কেন। আর কেনই বা বলবে, এখন জল পট্টি দেবে আমায়। আমি শুয়ে থাকবো বিছানাকে ঘিরে। আমি শুয়ে থাকবো সারা শরীরে সবুজ ঘাসের গন্ধ মেখে।
(চলবে)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!