ড. রমজান আলি 'র প্রবন্ধ: মানবসভ্যতার উৎসমূলে রাঢ় - শৃণ্বন্তু ড. রমজান আলি 'র প্রবন্ধ: মানবসভ্যতার উৎসমূলে রাঢ় - শৃণ্বন্তু
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭ অপরাহ্ন

ড. রমজান আলি ‘র প্রবন্ধ: মানবসভ্যতার উৎসমূলে রাঢ়

আপডেট করা হয়েছে : শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪, ২:৪৯ অপরাহ্ন
ড. রমজান আলি ‘র প্রবন্ধ: মানবসভ্যতার উৎসমূলে রাঢ়

মানবসভ্যতার উৎসমূলে রাঢ়
— ড. রমজান আলি

সভ্যতার ইতিহাস চর্চায় যে প্রধান আঠারােটি সভ্যতার কথা বলা হয়েছে সেখানে রাঢ় সভ্যতার তেমন কোন উল্লেখ নেই। অথচ তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করত পারলে এটা নিশ্চিত রূপে প্রমাণ করা যায় যে ভারতবর্ষের প্রথম সভ্যতা, রাঢ় সভ্যতা। প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে প্রাচীন এই রাঢ় সভ্যতাই কি অস্ট্রিক সভ্যতা? তারপর দ্রাবিড় সভ্যতা অর্থাৎ হরপ্পা-মহে্দারাে? পরে আর্য ভাষা-সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং মিশ্রণ? ইতিহাসবিদ, নৃ-বিজ্ঞানী থেকে ভাষাবিজ্ঞানী কেউ থেমে নেই, অবিরাম কাজ চলছে পাথুরে প্রমাণে। 'রাঢ়' শব্দটি নিশ্চিৎ রূপে অস্ট্রিক শব্দ। যার অর্থ হলাে ‘লাল মাটির দেশ'। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে ‘গঙ্গারিডি’ রাজ্যের অবস্থান নিয়ে কিছু তথ্য আছে। টলেমির ‘Treatise on Geography’-তে জানা যায় যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ। কেউ আবার গঙ্গানদীর নিম্ন অঞ্চলকে ‘গঙ্গারিডি’ বলে উল্লেখ করেছেন। ভার্জিলের ‘জর্জিকাশ’ কাব্যে ‘গঙ্গারিঢ়ি’ নাম পাওয়া যায়। শব্দটি বাংলা অপভ্রংশে ‘গঙ্গারাঢ়ী’ হয়েছে। তার থেকে নামটি সংক্ষিপ্ত রূপে হয়তো ‘রাঢ়’ হয়েছে। প্রচলিত চর্চা অনুযায়ী, এই 'রাঢ়' নাম ধরে কাঁকসার জঙ্গালে শিব হয়েছেন রাঢ়ের দেবতা ‘রাঢ়েশ্বর’। চিন সভ্যতা এই ভূমির নাম দিয়েছিল ‘লাতি’ আর বিদেশ থেকে আগত আর্যরা এর নাম দেয় ‘রাটঠ’। ব্রাহ্মণদের অনেকেই নিজেকে রাঢ়ী বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেনি। যে ‘গঙ্গারিডি’ বা গঙ্গারিড়ি-র কথা বলা হয়েছে তা আসলে গঙ্গা-রাঢ়ি বা গঙ্গা-রাঢ় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বারবার গঙ্গা শব্দের প্রয়ােগ দেখে বােঝা যায় যে তারা গাঙ সভ্যতার বা নদী কেন্দ্রিক সভ্যতার কথা স্বীকার করেছিলেন। অস্ট্রিক শব্দ 'গাঙ' হলাে যে কোনাে নদী অর্থাৎ এখনকার মতাে শুধু গঙ্গা নয়। বলা হয় ‘রাঢ়ের মূল / গাঙের কূল'। নানা তথ্য প্রমাণে গবেষকরা এটা বলতে শুরু করেছেন, যে একসময় পৃথিবীতে আর্যাবর্ত ছিল না। বােঙাদের এই বঙ্গ ও দক্ষিণে সমতলভূমি ছিল না। এমনকি রাজস্থান, গুজরাটে মরুভূমি, আরব সাগরের উত্তরাংশও ছিল না। বরং ভারতবর্ষের দাক্ষিণাত্য উপদ্বীপের সঙ্গে সেই বরফের যুগে দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিমে আফ্রিকা, পূর্বে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া একটা ভূখণ্ড রূপে যুক্ত ছিল। একটাই মাত্র প্লেটের উপর এইসব ভূখণ্ড ছিল। ইরফান হাবিব তাঁর ‘প্রাক্-ইতিহাসঃ ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস-১’ গ্রন্থে জানিয়েছেন— “ভৌগােলিক রূপ-সজ্জার (যেমন আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে) আধারে এমন একটি প্রাচীনতর সংযুক্তির প্রস্তাবনা রয়েছে পুরােনােকালের তত্ত্ব— ‘মহাদেশীয় সঞ্চয়ণ’-এ। এই তত্ত্বে মনে করা হয় যে, আমাদের আজকের ভারতবর্ষ দক্ষিণ গােলার্ধের ‘গণ্ডোয়ানা ভূমি’নামের এক অতি-মহাদেশের (super-continent) অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কুমেরু, আফ্রিকা, এবং দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ে গড়া এই ‘গণ্ডোয়ানাভূম’ (মধ্য ভারতবর্ষের গণ্ডাোয়ানা শিলার নামে যার নামকরণ)। ঐসব অঞ্চলে আবিষ্কৃত ভৌগােলিক কালের প্রায় সমগােত্রীয় প্রজাতির জীবাশ্মেও (অর্থাৎ পাথরে প্রোথিত প্রাণিদের চিহ) এই তত্ত্ব সমর্থিত হয় যে, একদা ভারতবর্ষ ঐ অতি-মহাদেশের অঙ্গীভূত ছিল।” ( ভাষান্তর কাবেরী বসু,পৃ: ২-৩) বারে বারে ভূ-আলােড়নের ফলে পাতের ধাক্কাধাক্কিতে অনেক কিছু উলােট-পালট হয়েছে। একসময় ছিল বরফের যুগ। তারপর ক্রমে বরফ যুগ শেষ হয়েছে। বড়াে বড়াে সব জীবজন্তু ধ্বংস হয়েছে বা ক্ষুদ্রাকৃতি হয়েছে। সমুদ্রে থাকা ম্যামথ ফসিল হয়েছে। আর তার বংশধর হিসাবে স্থলে রেখে গেছে হাতি। ডাইনােসর, গুণ্টাসর ইত্যাদি প্রাণিদের যুগ শেষ হয়েছে। এদিকে বরফ গলে রাঢ়ের লাল মাটিতে জন্ম নিয়েছে অরণ্য, অরণ্যের গাছপালাই ডেকে এনেছে মেঘকে। অরণ্যের পরিবেশে জন্ম নিয়েছে নানা প্রাণি। তারপর একদিন গােরিলা থেকে কালাে কালাে সব শক্তিমান মানুষ। এই রাঢ়ভূমির মানুষই পশুচারণ থেকে ক্রমশ চাষবাস শিখেছে। কৃষিজাত ফসল পাওয়ার আনন্দে, ফাগুন মাসের আগুন ধরা পলাশ ফুল মাথায় গেঁথে একদিন তারা যে নাচ শুরু করেছিল তা আজও অব্যাহত। মনে রাখতে হবে অস্ট্রিকরা বরাবরই অরণ্য প্রকৃতিকে তাদের দেবতা হিসাবে সম্মান দিয়ে এসেছে। ‘করম’ সংস্কৃতি তার প্রমাণ এখনো বহন করছে। অর্থাৎ অস্ট্রিক বংশের সব মানুষ। বর্তমান আন্দামানে থাকা জারুয়া ইত্যাদি গােষ্ঠি, অস্ট্রেলিয়ার আদিম মানুষ, আমেরিকার আদিম মানুষ সব আদিমরা সম্ভবত রাঢ় থেকেই পৃথিবীময় ছড়িয়েছে ? তাই যদি হয় তাহলে বাইরে থেকে ভারতভূখণ্ডে মনুষ্য প্রজাতির আসা এই বহুল প্রচলিত ধারণা আমরা মানবাে কিনা সে বিষয়ে আমাদের নতুন করে গবেষণার প্রসার ঘটাতে হবে। সম্ভবত একটা বরফ গলা নদী পূর্ব বা দক্ষিণ মুখে বিস্তারিত ছিল। একটি উঁচু ভূমি হিসাবে বিন্ধ পর্বতের কথা বলা হয়েছে। কোটি কোটি বছর ধরে এই সব পর্বত শ্রেণির ঝড়, ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এদের উচ্চতা কমেছে এবং এদের ক্ষয়িত অংশ নদীপথ ধরে সম্ভবত রাঢ় ভূমিকে প্লাবিত করেছিল। আজকের রাঢ়ের লাল মাটির পলিস্তর বাহিত হয়ে এসেই ‘ডােবা’ বা ‘ডবাক’-কে গাছপালার উপযােগী জঙ্গল ভূমিতে পরিণত করেছিল। চাক্ষুস প্রমাণে বলা যায় পশ্চিম রাঢ়ের যে তরঙ্গায়িত মালভূমি পূর্ব রাঢ়ে এসে তা অনেকটাই সমতল। এই পশ্চিম থেকে পূর্ব বৃহত্তর ভূমিই হলাে রাঢ়।

রাঢ় সভ্যতার জন্মের বহু লক্ষ বছর পরে টেথিস সাগরের হিমালয়ে পরিণতি। পরে হিমালয়ের বরফগলা জল গঙ্গা দ্বারা বাহিত হয়ে এই রাঢ় ভূমিকে বালি আর পলি দ্বারা প্লাবিত করে আরও সমতল ভূমিতে পরিণত করেছে। সংস্কৃত ভাষায় সমতল হলা ‘সমতট’, রাঢ়ী তথা বাংলা ভাষায় তাকে বলা হয় ‘বাগড়ী’। মানুষের জন্ম যদি দু-লক্ষ বছর আগে হয় তবে রাঢ় ভূমি তথা সভ্যতার জন্ম হয়েছে তারও আগে। তথ্য প্রমাণে অবশ্যই বিস্তারিত গবেষণা এবং প্রাচীন নিদর্শনের জন্য খননকার্যের প্রয়ােজন।রাঢ়ের কেন্দ্র অর্থাৎ দুর্গাপুরের কাছে দামুদর নদীর তীরে বীরভানপুরে প্রায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দর মেসােলেথিক পিরিয়ডের সভ্যতা আবিস্কৃত হয়েছে। নিওলিথিক পিরিয়ডে সুক্ষ্ম পাথরের অস্ত্র পাওয়া গেছে। পানাগড় রেলস্টেশনের চার কিমি দক্ষিণে ভরতপুরের কথাও পেয়েছি। এছাড়া সাঁওতালডাঙা, তুলসীপুর, শ্রীপুর, পাণ্ডুরাজার টিবি এসব তাে আছেই। বর্ধমান জেলার আউশগ্রামে পাণ্ডুরাজারটিবি খননের ফলে যে সব তথ্যাদি পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে গবেষকরা বলছেন, প্রায় বারশাে খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময় এখানে একটা উচ্চ সভ্যতা ছিঋ। নৃতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে প্রাক্-ইতিহাসের যুগে ভারতবর্ষের প্রথম মানুষ হিসাবে অস্ট্রিক গােষ্ঠির মানুষেরাই ছিলেন, যাঁদের সংখ্যা আজ ভারতবর্ষে প্রায় ২২ কোটিরও বেশি। ভারতবর্ষ তাদেরই আদি বাসভূমি। তাই তাদেরকে নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে এই জন্য যে তারা ‘আদিবাসী’ বা মূলনিবাসী। অথচ আজও তারাই ভারতবর্ষে সব থেকে বেশি বঞ্চিত। সেই গােষ্ঠী কেন্দ্রিক লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর আর্যদের কাছে পরাস্ত হওয়া সেই ক্ষতে তারা আজও সমানভাবে অবহেলিত। প্রায় সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক শবরপা লিখেছিলেন—‘উঁচা উচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।’ গ্রামের প্রান্তে বা পাহাড়ের টিলায় ছিল তাদের বাস। রাতের অন্ধকারে সমাজের নাক উচু মানুষেরা এই অন্ত্যজ নারীদের দেহ-উপভােগ পছন্দ করলেও দিনের বেলায় ডােম, শবর, চণ্ডাল ইত্যাদি মূলনিবাসীদের সংস্পর্শ,এড়িয়ে চলতাে। স্বাধীনতার আগে ইংরাজ শাসক ও জমিদার দ্বারা আর স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদেরকে দূরে দূরেই রাখতে চেয়েছে। সভ্যতার আলাে দেখাতে চায় নি। তার জন্যই তাে তাদেরকে হুল বা বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ করতে হয়ে ছিল একদিন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!