পাহাড়ের ওপর সপরিবারে
বুদ্ধ মনাস্ট্রির সামনে প্রার্থনার
ভঙ্গিতে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম ,
চারপাশে ঝুলছিল বিভিন্ন
রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ,
হিমেল বাতাসে উড়ছিল পত পত —
নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে হাসিখুশি
ছিপছিপে পার্বত্য নদীটি
যেন নৃত্যরতা সুন্দরী ঊর্বশী —
অদূরে পাইন-দেবদারুতে ছাওয়া
রূপময়ী বনভূমি……
একজন শেরপা পিঠে কমলালেবুর
ঝুড়ি নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছিল,
ধীরে ধীরে সূর্যাস্ত নেমে আসছে
যেন চলমান একটি ছবি
আমাদের চোখের সামনে
স্থির হয়ে যাচ্ছে,
আমার স্তরীভূত ভাবনারাশি
সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেয়ে
স্থির হয়ে গেল–
আমি স্বয়ং শেরপা হয়ে গেলাম
একটু পরে আমিই সেই
রুপময়ী সবুজ বনভূমি…..
যুগব্যাপী নৈঃশব্দ বিরাজ করছিল
সকাল বেলার মিষ্টি রোদে
পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম
রাস্তার পাশে কলস্বনা ছিপছিপে নদীটি–
শুকনো পাতা,ফুল, কাঠকুটো ভেসে যাচ্ছিল আপনমনে খরস্রোতা নদীটিতে
ছোট ছোট রঙহীন মাছেরা খেলা করছিল
ঝকঝকে নীলাকাশে কয়েকটি পাখি উড়ছিল আমাকে অগ্রাহ্য করে বিশাল একটা ডোরাকাটা
সাপ ধীরে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছিল
আতঙ্কগ্রস্ত আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম….
সাপের শ্রবণশক্তির কথা মাথায় ছিল না–
আমার অন্তরের সংলাপ শুরু হয়ে গেল–
এই মুহূর্তটার কোনো শুরু বা শেষ ছিল না
পাহাড়ের মাথায় ঋজু গাছগুলো
সূর্যের অকৃপণ কিরণছটা মাখছিল
আমার চোখের ক্যামেরায় দৃশ্যগুলো
ধরে রাখলাম, স্থিরচিত্র হয়ে
মেমরি বক্সে সেভ করলাম….
দূরে কোথাও হিন্দী ভজন বাজছে
‘কা করু মদনমোহনজী’….
উচ্চস্বরে কাকেদের সভা চলছিল
কাছের গ্রাম থেকে একদল দেহাতি
নারী পুরুষ ঝুড়িতে শাক-সবজি নিয়ে
নিজেদের ভাষায় কথা বলছিল
দমকা বাতাসের মতো দমকা হাসি………
নীল আকাশে এক টুকরো মেঘের উপস্থিতি–
যেন মেঘের একতারা বাজিয়ে
আকাশপথে কোনো অচেনা বাউল
হৃদয় নিংড়ানো গান গাইছিল…
নিস্তব্ধতায় ডুবে থাকা নয়
ঘন ঘন পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপটও নয়
গভীর শান্তি বিরাজ করছিল
হিমেল সকালবেলায়…..
আমার অন্তরের সংলাপের
কেউ সাক্ষী ছিল না–
দৃষ্টিপথের সামনে সবাই সাজানো ছিল…
পার্বত্য নদীটি আমার জীবননদীর মতো
কখনো উচ্ছল, কখনো খুব শান্ত
কখনো হতাশ, অস্থির, ক্রুদ্ধ….
জীবন যেন চলমান ছবি
দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে
ফরচুনার দুপাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে
সবুজ ঘাসের গালিচা
হৃষ্টপুষ্ট ভেড়ার পাল,
লাল আভার আপেল বাগিচা।
কাওয়া,পরোটা, লোটাস-স্টেমের সবজি
চাটনি সাজিয়ে বসে আছে কাশ্মিরী
দরিদ্র নারী-পুরুষের দোকানদারি
গোলাপি আভার গালে মিষ্টি হাসি,
তীক্ষ্ণ, কাটা-কাটা চোখমুখের মালিন্যে
আতিথেয়তার বেচাকেনা চলে
শহুরে জীবনে সবই মনোহর, অদ্ভুত….
ওই চিনার গাছ, ওয়ালনাটের সারি
লিডার নদীর ছলকে উঠা হাসি
উপত্যকা জুড়ে শুধুই হিম-বসন্তের
অফুরন্ত লুকোচুরি খেলা…
স্বর্গ আছে আশেপাশে
অথবা স্বর্গের আড়মোড়া ভাঙ্গা আলস্য চরিত
পড়তে পড়তে চোখে ধাঁধা লেগে যায়…
জন্নত কাকে বলে বলো গো
বরফিয়া নদী….
ডাল লেকের পদ্মবন থেকে
উড়ে আসছে ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি
ঘন সবুজ জলজ শ্যাওলারা
লেকের জল ভেদ করে
সূর্যালোকের সান্নিধ্য প্রত্যাশী
শিকারার বুক ছুঁয়ে হিমেল বাতাস
সূর্যাস্তের রঙে ডোবা আকাশের
পালকে এঁকে দেয় রাত্রির মাধুরী
এক এক করে নক্ষত্র ফুটে ওঠে
নক্ষত্রবিতানের চিবুক ছুঁয়ে
ঝিলমের ওপরে উড়তে থাকে
রাতপাখি–
অনন্তকাল ধরে মহাজাগতিক
পথের ধারে আমি যেন স্থির
স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়েই আছি
মেঘবৃষ্টিরোদসকালসন্ধ্যা রাত্রিকুয়াশাশিশির
আমাকে স্পর্শ করে যায়
আমার চেতনার চৈতন্য নেই…
অপার নির্জনতার মধ্যে ঋকমন্ডল
প্রশ্নচিহ্নের মতো আকাশে
চোখ মেলে তাকিয়ে আছে
আমার অন্তরের সংলাপ
ধীরে ধীরে থেমে গেল…