গ্রামীণ প্রবাদবৃত্তান্ত।। মাজরুল ইসলাম - শৃণ্বন্তু গ্রামীণ প্রবাদবৃত্তান্ত।। মাজরুল ইসলাম - শৃণ্বন্তু
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৪ অপরাহ্ন

গ্রামীণ প্রবাদবৃত্তান্ত।। মাজরুল ইসলাম

আপডেট করা হয়েছে : বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪, ৫:৫২ অপরাহ্ন
গ্রামীণ প্রবাদবৃত্তান্ত।। মাজরুল ইসলাম

গ্রামীণ প্রবাদবৃত্তান্ত
   (ধারাবাহিক রচনা)                

              

মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের একটি প্রান্তিক জেলা। শুধু তাই নয়। কৃষি নির্ভর জেলা। লালগোলা, ভগবানগোলা, রানিতলা, ইসলামপুর, রানীনগর জলঙ্গী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী থানা। এইখানে যে সমস্ত প্রবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করব তা উল্লেখিত অঞ্চল সমূহ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রবাদ-প্রবচন সৃষ্টিতে গ্রামগুলি ছিল সমৃদ্ধ। তবে সে আজ লোকশ্রুতির আখ্যান হয়ে লোক মুখে মুখে ফেরে।


                 গ্রামীণ শ্রমজীবী জনমানুষ কর্মরত অবস্থায় অসংগতির কোন পূর্বাভাস বা ঘটনার সম্মুখীন হলে নিরক্ষর পুরুষ কিংবা মহিলারাই লোকপ্রবাদ সৃষ্টি করে বা তারাই এর ধারক ও বাহক। নিরক্ষর গণমানুষ সহজাত জ্ঞানের পরিধি বা অভিজ্ঞতায় রসোত্তীর্ণ কাব্যময় বাক্য সৃষ্টি করে গেছেন।যা আজও প্রবাহমান। তবে এইসব বাক্যে যেমন কাব্যময়তা আছে তেমনি যথেষ্ট অশ্লীলতাও পরিলক্ষিত হয়। কোন সময় কোন অবস্থায় কে বা কারা রচনা করেছেন,এর উৎস বোঝা এবং খোঁজা কঠিনসাধ্য। তবে সৃষ্টিকর্তা খুঁজে না পেলেও কখন কী অবস্থায় এই প্রবাদ রচনা হয়েছে তা অবশ্য বিশ্লেষণে বোঝা কঠিন হলেও কিছু কিছু প্রবাদের অর্থ মূল্যায়ণ করা যায়। প্রবাদ রচনার সৃষ্টিকর্তা ঠিকই আছে।যা আজ নিরুপন করা যায় না।বলাই বাহুল্য প্রবাদ তৈরির ক্ষেত্রে লোককবির অবদান অনস্বীকার্য। আমরা প্রবাদে পায় গ্রাম- বাংলার মানুষ, মাটি আর ঘর-সংসারের নিটোল চালচিত্র। প্রবাদ প্রবচন লোকসাহিত্যের মুখো সাহিত্যের এক অনন্য অমূল্য সম্পদ। এতে অস্বীকার করার কোন অবকাশ থাকে না। এই প্রবাদ গুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনের মুখে মুখে ঘোরে। এবং কথ্য ভাষাতেই বেশির ভাগ রচিত। এটা কোন সভ্য কালচারাল ব্যক্তির মুখে কখনও শোনা যাবে না।তার কারণ শাহুরিক মানুষেরা এঁদের মতো কখনও কর্মক্ষেত্রে বা কোন অবস্থাতে পড়ে না গ্রামীণ মানুষগুলোর।তাই এঁরা ভীষণ তিক্ততার বয়ান হিসেবে লেখে না রাখতে পারলেও মুখোসাহিত্য হিসেবে মুখে মুখে ধরে রেখেছে।আজও নাম না জানা অখ্যাত লোককবিদের স্মরণযোগ্য প্রবাদ বাস্তবতায় চিহ্নিত ও সমুজ্জ্বলতায় আকর। এবার একটু প্রবাদগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
              ” আগকার মাগ হেলাফেলা
              পেছনকার মাগ গলার মালা।”
                 আমরা সব সময় একটা ভুল করে থাকি।আপন জনকে চিনতে ভুল করি অথচ কূটলোককে গলায় গলায় করে চলি। বিপদের সময় দেখি যে মানুষটি বীরদর্পে আমার দিকে এগিয়ে এল তাকে একদিন আমি চিনতে পারিনি।অথচ যাকে এতদিন আমি গলায় গলায় করে ঘুরলাম সে আজ কোথায় !তাই লোককবি কথাগুলো প্রমাণ করতে প্রথম পক্ষের ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর আচরণের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। প্রথম স্ত্রী প্রথম থেকেই ঘরসংসার আগলে রাখল আর একটু ত্রুটি পেল কী না দ্বিতীয় স্ত্রী তুলে নিয়ে আসে কিন্তু প্রথম স্ত্রীর মতো আদরে রাখেন না। প্রবাদটিতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যেকার ঘটনা বলে মনে হলেও আসলে যে কোন সম্পর্কের বেলাতেও প্রযোজ্য।
                এইরকম ভুল করার পর যখন আমরা বুঝতে পারি যে, কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক বা কে আপন আর কে পর তখনই মনে মনে কাল মলি।তাই লোককবির মুখে নিচের প্রবাদটি শুনিয়ে গেছেন:
                 “বানে বানে গুনছি।”
               আবার,
              “লোহাই লোহাই এক
               কামার শালা পর।”
                এখানে মনে হচ্ছে কামার ও লোহার সম্পর্ক কিন্তু এই লোককথাটা অন্য ক্ষেত্রেও খাটে। ধরুন স্ত্রী আর স্বামীর মধ্যে খুনসুটি চলছে —সেখানে অন্য কেউ তাদের মধ্যে নাক গলাতে গিয়ে পক্ষপাত আচরণ করল।পরে স্বামী-স্ত্রী আবার নিজের নিজের ভুল বুঝে পরস্পর এক হয়ে মিলে যায় তখন সে ব্যক্তি ওই দম্পতির কাছে শত্রু বলে গণ্য হচ্ছে।
              “যার নাই বেগানা
                সে যাক মেঘনা।”
                 এই সমাজ সংসারে অনেকেরই আত্মীয় স্বজন থাকে না। অর্থাৎ অনাথ ব্যক্তি।তাই সে ব্যক্তি আগপিছ না ভেবে যদৃচ্ছা গমন করতে পারে । মেঘনা নদী খুব ভয়ঙ্কর। সেখানে নৌকা বাইতে কিংবা মাছ ধরতে গিয়ে অনেক মানুষেরই বিপদ এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। সেই জন্য কোন লোক কবি এই রকম প্রবাদ রচনা করেছেন।
                “ঠ্যালা ঠ্যালির ঘর
                খোদাই রক্ষা কর।”
                 কোন গেরস্থালিতে যখন লোকাধিক্য দেখা যায় এবং তখন কেউ বসে বসে ভাতে শ্রাদ্ধ করে তো আবার অন্যজন সংসার ঠিক রাখার জন্য জীবন দিয়ে খাটে। এতে আর যাহোক সংসারের মান ঠিক রাখা যায় না।ঠেলা ঠেলিতে ঘর সংসার ঝুর ঝুরে হয়। এই রকম ঘটনাকে ভেবে অজ্ঞাত কোন লোককবি উপরিক্ত প্রবাদের প্রচলন করেছেন।
                  “ছোট ছোট ঘর
                  খান পাঁচেক কর।”
                  গাঁ-গেরামে বেশির ভাগ হত দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাঁদের একটা নয়,দুটো নয়, অনেক কিছুরই অভাব থাকে। এই রকমই কোন এক গরিব মানুষের ঘরের অভাব দেখে তাকে যুক্তি স্বরূপ কেউ বলেছিল। কারণ বড় একখানা ঘরে বাড়ির সবকিছু রাখা যাবে না এবং সবাই মিলে এক ঘরে থাকাও যায না। একখানা বড় ঘর না করে যদি ছোট ছোট পাঁচ-ছয়খানা ঘর করে তাহলে তারা বেশি কিছু না হলেও কিছুটা সুবিধাজনক ভাবে কিংবা ইজ্জতের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। অভাবী সংসারে এই প্রবাদটি অত্যন্ত জরুরি।
               পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষ্য করলে দেখা যায় দুর্বল মানুষের উপর সবলদের অত্যাচার নেমে আসে সর্বত্র। সেখানে গ্রামীণ নিরক্ষর,অভাবী লোকজনের মধ্যে হর হামেশাই দ্বন্দ্ব লেগে থাকায় স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তাহলে কী হবে যার অর্থবল কিংবা লাঠির জোর বেশি —সে কাকে পরোয়া করে। দোষ করেও নির্দোষী ব্যক্তিকেই ঘুরিয়ে লাঠির খেল দেখায়।তাই প্রবাদটি নিম্নরূপ:
               “জোরের লাঠি,শিরায় বহে।”
         আরও,
                “ভাস্যা আইল পানহা
                সে অ্যখন দ্যাশের হালসাহানা।”
                 সমাজদার পাঠকবৃন্দ প্রবাদটি পড়ে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে,ব্যক্তি কোনদিন দেশ ও দশের কাজে লাগেনি সে আবার মওকা বুঝে মোড়লির দখলদার হয়ে বসে। এখানে বলে রাখি —(পানহা অর্থাৎ শৈবাল জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।আর হালসাহানা অর্থাৎ তহসিলদার।)
                    আর যে বা যারা এতদিন দেশ ও সমাজের ভালো কাজ করে আসল সে এখন অপাঙক্তেয় বনে যাচ্ছে। এই রকম ঘটনাবলী সমাজে এখনও আকসার চলছে। এই প্রবাদ আমাদের কাছে আজও গ্রহণ যোগ্য বা স্মরণযোগ্য বলে বিবেচিত।
               “কাজে কুড়হা,ভজনে দেড়হা
               পাত পাড়ে,মাঝহ্যা জউড়হ্যআ।”
                  কোন এক লোক কবি কবে এই প্রবাদ-প্রবচন সৃষ্টি করে গিয়েছেন।তা জান যায় না। তবে প্রবাদটি আজও সমানে সমানে গ্রহণ যোগ্য।দেশ,সমাজ ও পরিবারের অকর্মণ্য ব্যক্তি ফাঁকি দিয়ে গলধঃকরণ করতে বেশ আরামপ্রিয়। কাজের লোককে যেনতেন প্রকারে ঠকিয়ে কাজ হাসিল করে।সে কোন মর্যাদা পাইনা।আর অকর্মণ্য ব্যক্তিটি ফাঁক তালে আখের গুছিয়ে নেয়। প্রবাদটি মূল্য এখনও কিছু কম নয়। প্রবাদটি পড়ে মনে হচ্ছে —কোন ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছে কিন্তু তা নয় গোটা সমাজ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
            ” রূপ আছে তার গুন নাই
             গুন আছে তার রূপ নাই।”
                 প্রবাদটি পূর্বের প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তবু আরও কিছু না বললেই নয়। প্রবাদটি মাকাল ফলকেও বলা যায়।মাকাল ফলের ভেতর বিটকেল গন্ধ আর উপর দেখতে ভারী সুন্দর। সমাজে এই রকম সুন্দর লোককের অভাব নেই। তাদের ভেতর খুব কুটিল বা জটিল। এদের ভেতর মাকাল ফলের মতো আর বাইরে চটকদারীতে পরিপূর্ণ থাকে। এদেরকে প্রবাদটির মতোই গণ্য করা চলে।
            “হাঁড়িতে আছে ক্ষীর
             মনে নাই স্থির।”
                এই প্রবাদটি যে লোক কবি সৃষ্টি করুক না কেন, আজও তার অর্থ অমান্য করা যায় না। অস্থির ব্যক্তি আগেও যেমন ছিল আজও তেমনি আছে।আগামি দিনও থাকবে।যে কোন বিষয়ে কিছু কিছু মানুষের স্থিরতা থাকে না। স্থিরতা হারায়। স্থিরকৃত ভাবে কোন কাজ করতে মন বসে না।তড়িঘড়ি কাজ করতে চাই। এবং নির্ভুল ভাবে সে কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন না। এবং শিশুদের ক্ষেত্রেও এই প্রবাদ খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ।সব বাড়িতে সবদিন ভালমন্দ খাবার হয় না। কোন এক বিশেষ দিনে হয়তো কোন ভালো খাবার হচ্ছে আর ওই শিশুরা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য তর সই না। আবার এও হতে পারে ঘরে খাবার মজুত থাকা খাবারটুকু শেষ না করা পর্যন্ত স্থির থাকে না। এই প্রবাদটি আসলে কালজয়ী। কোনদিনও এর ভাবার্থ ক্ষুন্ন হবে না।
            “হাঁড়িতে থাকলে ডইয়ে বারহাই।”
                 প্রবাদটি লক্ষ করলে দেখা যাবে দুটি শব্দ আঞ্চলিক।’ডই’ ও ‘বারহাই’।’ডই’ লুপ্তপ্রায় রান্নায় ব্যবহৃত বিশেষ লোকযন্ত্র। মুসলিম পরিবারে ডাল মসৃণ বা তোলার জন্য ব্যবহৃত লোকযন্ত্র। লম্বায় প্রায় ২ ফুট একটি শক্তপোক্ত খরাদ করা কাঠ। গোলাকার ডাভা দেখতে ঠিক যেন একটা তাল আকৃতির মতো।উপর দিক অর্থাৎ ধারার জন্য ক্রমশ সুরু। মোটা কিন্তু সাপের লেজের মতো।আর ‘বারহাই’ শব্দটি আসলে বের হয়-এর অন্য রূপ। মোদ্দা কথা লোকভাষা। এখন প্রবাদটির ভাবার্থ বোঝা যাক। সংসারে কোন কিছু প্রতুল হলে সবাইকে দিয়ে থুয়ে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সেই দ্রব্য যখন অপ্রতুলতা দেখা যায় তখন অন্যকে দেবার কথা ভাবাই যায় না।
                   “মাকাল দেখতে ভালো
                   তার ভেতর কালো।”
                 গ্রামীণ লোককবিরা মানুষের চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। উক্ত প্রবাদটি এমনই একটা প্রবাদ। মাকাল দেখতে খুব সুন্দর হলেও ভেতর কালো এবং বিটকেল যুক্ত দুর্গন্ধ।মনুষ্য সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা মাকাল ফলের মতো। এদের বাইরে থেকে চেনা যায় না। কিন্তু তাদের সঙ্গে মিলামিশা করলে আসল রূপ বা পরিচয় ধরা পড়ে। এই লোকগুলো চেহারা ভালো, মুখের কথায় চিড়া ভিজবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কুমতলব আঁটে। অর্থাৎ মাকাল ফলের মতো এদের ভেতর বিটকেল যুক্ত দুর্গন্ধ বা কালো।
                  সাধারণ মানুষ যখন কোন কারণে অসাধারণ হয়ে ওঠে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে।কাছের এবং দূরের — কাউকেই পাত্তা দেয় না।সে তখন আর মানুষ থাকে না।অন্য গ্রহের বা জগতের প্রতিনিধিত্ব করতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। এই অবস্থার বর্ণনা করতে নিম্নরূপ প্রবাদটি রচনা করেন।
         ” দারগায় বুল্যাছে চাচি
          আমি কী মানুষ আছি।”
               আবার,
      “যাকে দেখিনি সে বড় সুন্দরী
      যার হাতের খায়নি সে বড় রাঁধুনি।”
               পাঠকবর্গ প্রবাদটি পড়ে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে প্রবাদটির কী অর্থ দাঁড়াবে। তবুও দু’এক কথা না বললে নয়। তাকই বলছি। আসলে যে ব্যক্তির হাতের রান্না কখনও খায়নি বা তাকে কোনদিন দেখিনি তার সম্পর্কে অনেক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প ফাঁদে। কিন্তু সে আদৌ রাঁধুনি হিসেবে পরিপক্ক নয় বা সে তত সুন্দরী কিনা তাও সংশয় থেকেই যায়। আসলে পাকা রাঁধুনিও নয়, এবং রূপসীও নয়।
          “আলোর নিচে অন্ধকার “
                এই প্রবাদটি হয়তো বিজলী বাতি না আসার পূর্বের কথা। তখন গ্রামীণ মানুষেরা কুপি রাখত গাছার উপর।আর সেই বাতির চারপাশ আলোতে আলোকিত করলেও কিন্ত গাছার তলার দিক আঁধারই থাকে। আবার অন্য ভাবেও বলা যেতে পারে। আসলে সভ্যতার বড়াই করে থাকি আমরা কিন্তু সমাজে আজও অসভ্যতার অনেক দৃষ্টান্ত থেকে যায় বইকী।
                আবার,
                এই রকম ঘটনা প্রবাহ দেখে বিরক্ত ধরে যায়। তখন কোন লোক কবি সৃষ্টি করলেন —
              “কালে কালে কী হলো।”
                এই রকম গ্রামীণ লোককথার শেষ নেই।হাজারও প্রবাদ খুঁজে পাওয়া যাবে। নিচের প্রবাদটি এই রূপ:
         “কালকের ল্যাঢ়, আজকের শ্যাট।”
              এখানে দু’টি শব্দ এক্কেবারে লোক ভাষার পরিচয় বহন করে।’ল্যাঢ়’ অর্থে তুচ্ছ বা গ্রাম্য মহিলাদের মুখের গালমন্দ।আর ‘শ্যাট ‘ অর্থে শেঠ বা বনিক বোঝায়।
               শ্রমিক থেকে সৈনিক বা জিরো থেকে হিরো বনে যাবার ব্যাপারটাকে বোঝাতেই অজ্ঞাত লোক কবি মৌখিক সাহিত্যের মধ্য দিয়ে রচনা করলেন। কোন লোক ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর হয়ে উঠলে সে তখন পূর্বের কথাগুলো ভুলে যায়। এবং শেঠের মতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে।
              “ত্যালে চুল তাজা
              ছাইয়ে মান তাজা।”
                গ্রাম মানেই কৃষি নির্ভরশীল।মাঠ ছাড়াও বাড়ির আশেপাশে কৃষিজ ফসলের চাষাবাদ করে থাকে।যেমন, সেদিনও ওল,মানকচু প্রভৃতি বাড়ি সংলগ্ন বাটিকা উদ্যানের সবজি চাষ করত। কখন কী সবজিতে কেমন যত্ম নিতে হয় তারই প্রমাণ মেনে উক্ত প্রবাদটি। হয়তো কোন চাষি তাঁর আশেপাশের চাষিকে বা পরিবারের লোকজনকে প্রবাদটির মধ্য দিয়ে আদেশ করেছেন। আমরা সবাই জানি চুলের পরিচর্যা করতে তেলের জুড়ি নেই। সেই রকম মানের যত্ম নিতে আর মানে ছাই দিতে উপদেশ দিচ্ছেন।ছাইয়ে মান স্থুল বা মোটা হয়।
          ” ঝড়ে পড়ছে কলা
           বউ বলে,
           এবেলা আর এবেলা।”
               প্রবাদটিতে পরিলক্ষিত হয় একটি পারিবারিক অভাব অনটনের কথা।ঝড়ে পড়ছে কলা — আসলে গেরস্থ বাড়িতে ফসল উঠেছে আগামির কথা না ভেবে বৌ-ঝি বেপরোয়া খরচ করছে —যা হয় হোক, এখনতো বেহিসাবি ব্যয় করে যায়। এই দেখে বাড়ির কর্তা- কর্ত্রী হয়তো বৌকে উদ্দেশ্য করে বলা।
                “মন্ত্রী খায় পান
                আর
                জলের দামে ধান।”
                প্রবাদটি সাবেক কালে যেমন সত্য তেমনি সাম্প্রতিককালেও ততটাই প্রযোজ্য। মনে করা যেতে পারে কৃষক তার নাজেহাল অবস্থা থেকে এই প্রবাদটি সৃষ্টি করেছেন। তার কারণ যখন মন্ত্রী কোষাধ্যক্ষদের সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধির দাবি উঠছে আর কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। ধান বিক্রি করতে না পেরে অভাবে পড়ে আত্মহত্যা করছে। এমন সময় কৃষিজীবী মানুষ দ্বারা এই লোক কথা সৃষ্ট।
                  “কলকাতা হবে লণ্ডন
                  গরিবের হাতে লণ্ঠন।”
                 যেকোন প্রশাসন গ্রাম অপেক্ষা সহরকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু যারা কায়িক পরিশ্রম করে জনসাধারণের মুখে আহার তুলে দেয় তাদের কথা একবারও ভাবেনা। এই রকম ঘটনাকে ভেবে এই খেদোক্তি। অনুমেয় প্রান্তিক চাষীরা সৃষ্টি করলেন প্রবাদটি।
                নেতারা বুঝে না বুঝে অনেক সময় জনগণকে বোকা বানাতে চান।আর যদি সেই বোকা তার পাণ্ডিত্য ধরে ফেলে বা পাল্টা উত্তর দেয়,তখন সেই পণ্ডিতের মুখ ব্যাজার হয় বইকী। সেই রকমই বোঝাতে প্রবাদটি একেক অঞ্চলে চালু আছে।
             “হক কথায় বন্ধু ব্যাজার।”
             বা,
              “গরম ভাতে বিড়াল ব্যাজার।”
               অসম্ভব ব্যাপার দেখে কোন মানুষই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। কোন অন্যায় দেখে অন্যায়কারীকে যোগ্য জবাব দিতে হক কথার লোক এই প্রবাদটি সৃষ্টি করেছেন।
                এককালে ভাত জুটত না এখন আবার বাসি ভাতে খসির মাংস খেতে চায়। এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কোন কারণে হয়তো বাড়িতে মাংস উঠেছে। কিন্তু গরম ভাত হওয়ার উপায় নেই। তাই পরিবারের কোনো সদস্য বাসি ভাতেই মাংস খেতে চাইছে দেখে এ প্রবাদের জন্ম। প্রবাদটি এই রূপ:
           “বাসি ভাতে খাসির মাংস।”
             আরও —
        “বেঁচে থাকতে পাইনা ভাত-কাপড়
         মলে গোর কাফন।”
              মানুষ মরণশীল সর্বজনবিদিত।আর মানুষ মৃত্যু বরণ করা মানেই হয় শ্মশান না হয় কবরে গমন করে ঠিকই যেমন, তেমনি সেই ব্যক্তির জীবিত অবস্থায় ভাত ও কাপডের দরকার। কিন্তু তা পাইনি বা ছেলে মেয়েরা জোগান দেয়নি।অথচ মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের কতই না কান্না , শ্রাদ্ধ,মিলাদের তোড়জোড় লাগায়। এতে আর যা হোক জীবিত কালে যারা ভাত কাপড় দিল না এখন মৃত্যুর পর এই সব ঘটনা দেখেই এই লোককথার প্রচলন হয়েছে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
               ” বাপ জানেনা লাইলাহা
                 বটায় বলে মৌলভী হব।”
                 যে কোন পরিবারের শিশুরা তাদের পারিবারিক বৈশিষ্ট্য অধিকার লাভ করে। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও কোথাও পরিলক্ষিত হয়। এখানে প্রবাদ সৃষ্টিকারী আসলে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন বাবা মা যদি ভাল করতে না জানে তাহলে ছেলেপিলে কোথা থেকে শিখবে? এবং বাপ মা ভালো কাজ করে গেছেন কিন্তু ছেলে মেয়েরা ভালো কাজ করার ভান করে।
          “সাজন্যার শাক সিজেনা
           বুড়হ্যা ভাতার মজেনা।”

                                (চলবে)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!