ছোটগল্প : মহারাজা কোঠি
মহারাজা কোঠি
।। এক।।
সব ঠিকই ছিল। কেবল খাবারটা মিতালির মনমতো হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে সুদীপকে কিছু বলতেও পারছিল না। কারণ এই মহারাজা কোঠিতে রাত্রিবাসের পরিকল্পনাটা ছিল মিতালিরই। নেটে হেরিটেজ হোটেল-বাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে অনেক দিন থেকেই মিতালি মনে মনে এখানে আসার পরিকল্পনা করছিল। সুদীপের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। অবশ্য ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা সুদীপের কখনই খুব একটা হয় না। হবে কী করে ? সারাদিন রুগী, নার্সিংহোম, হাসপাতাল করে ছুটতে থাকলে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করবে কখন ! অবশ্য মন্দের ভালো, মিতালি যেখানেই ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা করুক তাতেই রাজি হয়ে যায় সুদীপ। ঘুরতে এলে নির্ভেজাল একটু রেস্ট পাওয়া যায়, সেই আনন্দটুকু চুটিয়ে উপভোগ করে সুদীপ। মিতালি মেয়ে অমৃতাকে নিয়ে নিজের মতো মনকে ওড়াতে থাকে বলাকা পাখায়।
মহারাজা কোঠি ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকের। তখন মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী সবে আলিনগরে স্থানান্তরিত হতে চলেছে। ইংরেজরা আলিনগরের নোতুন নামকরণ করেছেন ক্যালকাটা। কিন্তু বাঙলার প্রাণকেন্দ্র তখনও মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদেরই বর্ধিত অংশ বহরমপুর। অজেয়মেরু থেকে ব্যবসা করতে এসে এই বহরমপুরেই আস্তানা গেড়েছিলেন লাখেরাজ বুধোরিয়া। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী। ধর্মমতীয় বিশ্বাসে অহিংস এবং নিরামিষাসী হলেও অর্থ উপার্জনে লাখেরাজ বুধোরিয়া ছিলেন সর্বভুক। বোধকরি অবাঙালি সকল ব্যবসায়ীদের চরিত্রই এই রকম। সুদে টাকা খাটানো থেকে শুরু করে রকমারি ব্যবসা ছিল লাখেরাজ বুধোরিয়ার। বদ্বীপ বাঙলার উর্বর শস্যখেতের কৃষকদের সোনালি ফসলবেচা অর্থে অল্পদিনেই স্ফীতোদর হয়ে উঠেছিলেন লাখেরাজ বুধোরিয়া। বানিয়েছিলেন প্রাসাদোপম এই বাড়িটি। হয়তো মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রাসাদ দেখে !
অবাঙালি ব্যবসায়ীরা সাধারণত প্রচুর অর্থ থাকলেও সৌখিন বাড়ি তৈরি করে অর্থের অপচয় করেন না। চলনসই একটি বাড়ি হলেই হলো। কিন্তু এই লাখেরাজ বুধোরিয়া ছিলেন ব্যতিক্রমী সৌখিন মানুষ। রাজা না হয়েও রাজাদের মতো বানিয়েছেন রাজমহল। বিশাল বিশাল সব ঘরদোর। একই ঘরে রাজা-রাণীর জন্য আলদা আলাদা পালঙ্ক। খাটবিছানা। আলদা আলাদা স্নান ঘর। ঝাড়লন্ঠন। সুদৃশ্য কারুকার্যময় আসবাবপত্র। দেওয়াল জুড়ে কারুকার্য খচিত আয়না। হলঘর, রঙমহল, নাটমন্দির। কী নেই সেই প্রাসাদোপম বাড়িতে।
লাখেরাজের নিজের শখের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকে মর্যাদা দেবার ব্যাপারটিও জড়িত আছে এই প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরির পিছনে। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সিন্ধু প্রদেশের কোনো এক রাজ-আমত্যের কন্যা। ব্যবসায়িক পরিবারের বধু হিসেবে এলেও শখ ছিল নবাব জমিদারদের মতো। লাখেরাজ নিজের শখ এবং স্ত্রীর আবদার মেটাতেই এমন প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছিলেন। আজ সেই প্রাসাদোপম বাড়ি হোটেল বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লখেরাজের উত্তর পুরুষেরা এখানে থাকেন না। তাঁদের ব্যবসার পসার এখন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই। এই বাড়িটিকে হোটেল বানিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা লাখেরাজ বুধোরিয়ার উত্তর পুরুষদের। তবে হোটেলে আগত অতিথিদের বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করে চলতে বলা হয়। সেসব হোটেলের গাইড বুকে লেখা আছে। লেখা আছে এই বাড়ির ইতিহাস। বাড়ির পুরোনো বাসিন্দাদের নাম, শখ ইত্যাদি। এখানের খাদ্য-খাওয়াও নিরামিষ। নতুন সংযোজন হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উত্তর-পশ্চিমভারতীয় নানান ঘরাণার সঙ্গীত, নৃত্য পরিবেশন করা হয় সন্ধের পর থেকে।
মিতালিরা যে ঘরে উঠেছে, তার দেওয়ালে বড় বড় দুটি প্রোট্রেট। একটি লাখেরাজ বুধোরিয়ার অন্যটি তাঁর স্ত্রীর। অপূর্ব সুন্দর সেই পুরুষ আর নারীর ছবি। রাজকীয় ভঙ্গিমায় নারী মূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছেন একটি তেপায়া টেবিলের পাশে। আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ কী পঞ্চাশ বছর বয়সের ছবি। তাঁর ব্যষ্টিত্ব যেন ঠিকরে পড়ছে প্রোট্রেটের ভেতর থেকে। মিতালি গাইড বুক পড়া শেষ করে তন্ময় হয়ে আর একবার দেখল অপূর্ব সুন্দর সেই প্রোট্রেটের নারীকে। মনে মনে ভাবলো, মানুষ এত সুন্দর হয় ! সেই সঙ্গে ভাবলো যাঁর স্বামী স্ত্রীর মর্যাদা দিতে এতো কিছু করেন, সেই স্ত্রী সত্যিই ধন্য। জগতে এমন নারীও তো কম নেই। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম, মহারাণী ভিক্টোরিয়া সবাই ধন্য হয়ে আছেন তাঁদের স্বামীদের তৈরি কীর্তি-সৌধে । মিতালির মন বলে উঠলো, ‘মিতালি কেন ধন্য হতে পারবে না ?’ সুদীপ এতো অর্থ ইনকাম করছে কিসের জন্য ? শুধু ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রেখে লাভ কী ? শুধু ডিজিট গুণে গুণে তৃপ্তি পাওয়া। মরে গেলে মেয়ে-জামাই কেউ মনেও রাখবে না । তাঁর চেয়ে একটা কিছু স্থাপত্য বা সুন্দর একটি বাড়ি থাকলে মন্দ হয় না। ছোটো থেকেই মিতালির ইচ্ছে ছিল পরিখাবেষ্টিত সুন্দর একটি বাড়ির। বাড়ির সামনের পরিখার জলে পদ্ম ফুটে থাকবে। রাজহাঁস চড়ে বেড়াবে। রাতে বাড়ির আলো পরিখার জলে প্রতিফলিত হয়ে দোল খাবে। সেই দোলায় দুলতে থাকবে মিতালির মন। ভাবতে ভাবতে মুহূর্তেই যেন মিতালি নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরল সুদীপের কথায়।
এতক্ষণ পাশের খাটে গা এলিয়ে শুয়ে ছিল সুদীপ। বিছানায় পাশ ফিরতে গিয়ে বলে উঠলো, আমার কিন্তু দারুণ লাগছে এই পালঙ্কে গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে !
— তোমার আর কী ? ভালো শোয়ার জায়গা পেলেই হলো ! এসে অব্দি তো শুয়েই আছো ! মেয়েটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিতে পারতে রাজমহলটা।
— আরে বাবা ! প্যাকেজের মধ্যেই তো সব আছে ! ওরাই ঘুরিয়ে দেখাবে। এখন একটু বিশ্রাম নাও তো !
সুদীপের কথায় মিতালিও শরীরটা এলিয়ে দিলো বিছানায়। একই পালঙ্কে নয় ! ঘরের অন্য পাশে রাখা রাণীর পালঙ্কে। ধবধবে শাদা নরম মুর্শিদাবাদী বালাপোশের বিছানা। তার মাঝখানে শুতেই বিছানার মধ্যে ডুবে গেলো মিতালি। মনটা হাওয়ায় ফুরফুর করে উঠলো। চোখ পড়লো সুন্দরী সেই লাখেরাজ গিন্নির প্রোট্রেটের ওপর। তাঁর পাশেই আর একটু বড় সাইজের প্রোট্রেটে লাখেরাজ বুধোরিয়ার ছবি। দু’জনের পোট্রেটই অপূর্ব সুন্দর। অসাধারণ ব্যষ্টিত্বে ভরপুর।
অমৃতা সুদীপের বিছানার মধ্যে বসে টেডি ডল নিয়ে খেলা করছিল। মা’র শুয়ে পড়া দেখে সেও বাবার পাশে শুয়ে পড়ল।
দুপুরে খাওয়ার পর মিতালির গড়িয়ে নেবার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নয়। আজকে দুপুরের খাওয়াটাও হয়েছে আগে।
হোটেলে ঢুকেছে বেলা এগারোটার সময়। ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে প্রাসাদোপম এই হেরিটেজ হোটেল। হোটেলে ঢুকতেই হোটেলের মেয়েরা গোলাপ জল ছিটিয়ে, কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে দিয়ে বরণ করে ভিতরে নিয়ে এসেছে। রাজকীয় এই অভ্যর্থনাতেই মিতালির মন ভরে উঠেছে। তারপর চন্দন সুরভিত রাজারাণীর আলাদা আলাদা স্নানঘরে স্নান করে এসে দুপুর বারোটার মধ্যে রাজকীয় দ্বিপ্রহরের আহার। এত আগে লান্স খেয়ে মিতালির চোখে ঘুম আসার কথা নয়। তাই চোখ খুলেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ দরজায় মৃদু টোকা ! বাহির থেকে পরিচারিকা বললো, বাবু, বিবি, উঠুন ! মন্দির দর্শনে যেতে হবে।
মিতালি বিছানা থেকে উঠে এসে বললো, এই অসময়ে মন্দির দর্শনে?
— হ্যাঁ বিবি ! এখানে এমনটিই নিয়ম। দ্বিপ্রহরের আহারের পর বোটে করে মন্দির দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আপনারা রেডি হোন, একটু পরে এসে ডেকে নিয়ে যাবো।
কিন্তু মিতালিদের সেদিন বোটে যাওয়া হয়নি। আকাশে মেঘ ছিল। অসময়ে ঝড় হতে পারে ভয়ে বোটে যাওয়ার ঝুঁকি নেননি কর্তৃপক্ষ। টুকটুকিতে করে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাটারি চালিত রিক্সাকে বহরমপুরে টুকটুকি বলে। পশ্চিম বাঙলায় মুর্শিদাবাদেই প্রথম ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালু হয়েছিল। সাত বছর আগে যখন মুর্শিদাবাদের নবাব প্যালেজ দেখতে এসেছিল মিতালিরা তখন প্রথম এই ব্যাটারি চালিত টুকটুকি দেখেছিল। আজ সেই টুকটুকিতে চড়ে বহরমপুরের মন্দির দেখতে মন্দ লাগেনি মিতালির । এমনিতেও ঠাকুর দেবতার প্রতি মিতালির ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু বেশিই।
ঝড়ের ভয়ে বোটে করে ভাগীরথীর বুকে ভ্রমণ না হলেও, শেষ পর্যন্ত ঝড় কিন্তু হয়নি। তবে মন্দির দর্শন শেষে সন্ধ্যায় ভাগীরথীর পাড়ে মুক্ত রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়েছিল তারা। ভাগীরথীর মৃদু-মন্দ বাতাসে মিতালির শরীর মন হালকা হয়ে উঠলো। মন বারবার চাইছিল ডানা মেলতে। মন কত কিছুর জন্যই তো ডানা মেলতে চায়। কিন্তু পারে না। মনকে শাসন করে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। আজ আবদ্ধ করলো না। মনের ফুরফুরে ভাব নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলো। অমৃতাকে নিয়ে সারা বিকেল সুদীপই ব্যস্ত থেকেছে।
ছোটবেলায় নিজে যা যা করতে পারেনি সুদীপ, মেয়ের মধ্যে দিয়ে তাই তাই পূরণ করে নেয়। মেয়েকে নাগরদোলায় উঠিয়ে দিয়ে নিজের শৈশবে ফিরে যায়। আর মাঝে মাঝে মোবাইলে পেশেন্ট আর নার্সিংহোমের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে। মিতালিকে নিয়ে ভাবনার অবকাশ তার নেই। শুধু গভীরে রাতে স্বামী-স্ত্রী’র শারীরিক সম্পর্কে যত তৎপরতা। মিতালি বুঝে উঠতে পারে না, সেই তৎপরতা সুদীপের দাম্পত্য প্রেমের রোমান্টিকতা ; নাকি সঙ্গমের ক্লান্তিতে অহংকারী পৌরুষকে ঘুমের রাজ্যে ডুবিয়ে দেওয়া ?
।। দুই ।।
সাতটার মধ্যে প্রাসাদের হোটেলে ফিরে আসার নিয়ম। মিতালিরাও ফিরে এসেছে। নিজেদের ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে একটু বসতেই আবার দরজায় টোকা। মিতালি ভেতর থেকে বললো, খোলা আছে।
সুন্দরী ওয়েটার গলা বাড়িয়ে বললো, বাবু, বিবি কমিউনিটি হলে চলে আসুন, ওখানে আপনাদের জন্য নির্দিষ্ট আসন আছে। সেখানে বসে বসে চা খাবেন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখবেন। আপনারা রেডি হোন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
সন্ধেয় মিতালির চা খাওয়ার নেশা। এতক্ষণ চা না পেয়ে কেমন উসখুস করছিল। চায়ের আমন্ত্রণ পেয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলো। মহিলা ওয়েটার্স অভিবাদন জানিয়ে আগে আগে হেঁটে চললো। অমৃতা ওয়েটারের হাত ধরে এটা ওটা জিগ্যেস করতে করতে এগিয়ে চলেছে। অচেনা লোকের সঙ্গে খুব সহজেই মিসে যায় অমৃতা। অমৃতার ঠাকুরমার এটা পছন্দ না। নাতনিকে বুঝিয়েওছে অনেক। কিন্তু অমৃতা যা, তাই হয়ে উঠছে। ওয়েটারের হাত ধরে অমৃতা এমনভাবে হাঁটছে আর এটা ওটা জিগ্যেস করছে, যেন ওয়েটার অমৃতার কত দিনের চেনা।
বিশাল একটি রুম কমিউনিটি হল। মাঝখানে সুসজ্জিত একটি মঞ্চ। মঞ্চের চতুর্দিক খোলা। হলের জায়গায় জায়গায় এক একটি টেবিল ঘিরে চারটে করে চেয়ার। প্রতিটি টেবিল বেশ কিছুটা করে দূরে দূরে। প্রত্যেক বোর্ডারদের জন্য আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট টেবিল। মিতালিদের নিয়ে গিয়ে যে টেবিলের চেয়ারে বসালো সেই টেবিলের ওপর নেমপ্লেটে লেখা আছে বাবু সুদীপ ব্যানার্জি আর বিবি মিতালি ব্যানার্জি। মঞ্চে সন্ধ্যা রাগিণীতে কেউ একজন সেতারে দক্ষিণ ভারতীয় রাগ বাজিয়ে চলেছেন। একটু পরেই সুদৃশ্য কাপ-প্লেটে চা এলো। চায়ের সঙ্গে হালকা টিফিন। চায়ে চুমুক দিতেই মঞ্চের আলো নিভে সঙ্গে সঙ্গে আবার জ্বলে উঠলো। এবার ভিন্ন আলো। অদ্ভুত মায়াময় সে আলো। ঝুমঝুম নূপুর নৃত্যে সেই আলোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একদল সুন্দরী নর্তকী। দক্ষিণী ঘরানায় অদ্ভুত কোমর দলানো, অপূর্ব অঙ্গভঙ্গিতে সেই নাচ দেখে বিমোহিত সুদীপ আর মিতালি। নাচ শেষ হতেই হালকা হাসির শিশুতোষ কিছু প্রদর্শনীর পর শুরু হলো একটি সঙ্গীত। অপূর্ব সেই সঙ্গীতের সুরমূর্চ্ছনা। সুদীপ মনে মনে বলে উঠলো, শুধু উচ্চবিত্ত হলেই হবে না, এই হোটেলে আসতে হলে উচ্চ মনেরও হতে হবে। এই সঙ্গীত কয়জন উপলব্ধি করতে পারবেন। সুদীপের বহুদিনের চাপা পড়া অস্তাদী মনটা বেরিয়ে এলো। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর সুদীপের বাবার ছিল গভীর টান। কলকাতার কোথাও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর হচ্ছে শুনলে সুদীপের বাবা ছুটে যেতেন। সঙ্গে সুদীপকেও নিতেন। প্রথম প্রথম সুদীপের ভালো না লাগলেও এক সময় সেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারিতে পড়তে যাওয়া, বাবার অসুস্থতা, দ্রুত সেসবের পট পরিবর্তন হতে থাকলো। আর এখন গাইনোক্লোজিস্ট হিসেবে নিজের খাওয়ার সময়টাও নিজে ঠিক করতে পারে না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সরিতা কর্পোরেট দৌড়ের বালি পাথরের নীচে অন্তঃসলিলা হয়ে চাপা পড়ে ছিল। আজ হঠাৎ এই মহারাজা কোঠিতে সেই সরিতা ঝরঝর ঝর্ণানৃত্যে সুদীপের মনের গহন কোণ দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। সেই সরিতায় সিক্ত সুদীপ অজান্তেই মিতালির হাত ধরে ফেললো। হাতে হালকা একটি রোমান্টিক চাপ অনুভব করে মিতালি শিউরে উঠলো ! মিতালির বিস্মিত মন বলে উঠলো, সুদীপই তো ? এই সুদীপকে তো কখনো দেখিনি ! মিতালির শরীর মন ভরে উঠলো। সুদীপের কাছ থেকে এই রোমান্টিকতাই তো চায় সে। এই জন্যই তো সুদীপকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে বেরোয়। এই রোমান্টিকতায় ডুবে থাকতে সুদীপের মনোসংযোগ নষ্ট করলো না মিতালি। নিজের নরম হাত দুটোকে সুদীপের রোমান্টিক মনের খেলনা করতে আরও নরম করে সুদীপের দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু কতক্ষণ ? অন্তঃসলিলা নদীর বুকের বালি দু’হাতে সরিয়ে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ আনলেও সেই জল যেমন বেশিক্ষণ থাকে না। চতুর্দিকের নুড়ি বালি এসে জলের গর্ত ভরিয়ে দেয়। আবার চাপা পড়ে স্বচ্ছ সেই জল। তেমনি উধাও হয়ে গেল সুদীপের রোমান্টিক মন।
সুদীপের হাতের রোমান্টিক চাপ উপভোগ করতে করতে মিতালি ভাবতে শুরু করেছিল আজ রাতটা অন্যরকম রোমান্টিকতায় কাটবে। কিন্তু কমিউনিটি হল থেকে রেরোতে না বেরোতেই নার্সিংহোমের ফোন। ফোনের ওপাশের কথা স্পষ্ট শুনতে পেল মিতালি। স্যার, পেশেন্টপার্টি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে সিজার করাতেই চাইছে না।
সুদীপ বলে উঠলো, কোন পেশেন্টটা বলুন তো?
— স্যার, ওই যে অসিত মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী।
— ও ! ওই যাঁর আগের দুটি বাচ্চা পরপর নষ্ট হয়েছিল ? ভ্যাল্যুয়েবেল বেবি। কিন্তু ওর তো এখনো সময় হয়নি। আরও দুই সপ্তাহ বাকি ছিল !
— স্যার, পেইন উঠেছে। হালকা জলও ভাঙছে। ওরা ভয় পেয়ে গেছে।
— কিন্তু কিছু করার নেই। আমি বাইরে বেড়াতে এসেছি। ডক্টর শতরূপ ঘোষকে ডাকো।
— স্যার, আগের দুটো ডেলিভারি ডক্টর শতরূপ ঘোষের হাতেই হয়েছিল। তাই ওরা বারবার আপনার কথা বলছেন।
— আরে ওদের বলো, আগেরটা নষ্ট হয়েছে বলে এবারেরটাও নষ্ট হবে তার কোনো কথা নেই। ওদের বলো, আমি শতরূপ ঘোষকে বলে দিচ্ছি। বলে ফোন রেখে দিল। কিন্তু মন তার উসখুস করতে লাগলো। শুধু টাকার জন্য নয় ; মানুষের বিশ্বাস, দায়িত্ব বলেও তো কথা আছে । ডাক্তারিতে এই বিশ্বাস এবং পসার অর্জন করতে অনেক সময় এবং পরিশ্রম করতে হয়েছে সুদীপকে।
মিতালির মন আবার খারপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে, একটু আগের সুদীপের সেই অচেনা রোমান্টিক মন উধাও হয়ে গেছে। চেনা সেই গতানুগতিক সুদীপকে নিয়েই মহারাজা কোঠিতে ভাসাতে হবে স্বপনের সাম্পান।
মোবাইল রেখে সুদীপ আফশোসের সুরে বলে উঠলো, তিনটে সিজার ছিল গো ! বড় লস হয়ে গেল।
সেই একই কথা, একই সুর ! এই কথা, এই সুর মিতালির খুব পরিচিত। তাই সেদিকে মন দিল না মিতালি। ঘরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে ডাইনিং হলের দিকে গেল। দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে ডিনার করতে হবে। বিশাল ডিনার রুম। বিশাল বড় টেবিল। কারুকার্য খচিত চেয়ার। প্রতিটি চেয়ারের সামনের টেবিলে প্রতিটি গেস্টের নাম লেখা। যার যার নাম লেখা জায়গায় গিয়ে বসতে হবে। খাবার মেনু হোটেল কর্তৃপক্ষের পছন্দের। হরেক রকমের পদ। সবই ভেজ আইটেম। যত খুশি খাও, যত খুশি নষ্ট করো। বিল একই। এবং পূর্ব নির্ধারিত। হোটেল বুকিংয়ের সময়ই কেটে নিয়েছে। সুদীপ সবগুলি পদই একটু একটু করে খেয়ে দেখলো। অমৃতা শুধু ঘি ভাত, আর মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলি খেল। শুধু ভেজ মিতালির খুব একটা পছন্দ নয়। তবে আয়োজন এবং পরিবেশনার ডেকোরেশন তার ভালো লাগলো। সেও সবগুলো আইটেম টেস্ট করলো। সবেতেই উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় স্বাদ। খেতে যে মন্দ লাগলো তা নয় ! অনেকটাই খেয়ে ফেললো মিতালি। খাবার সময় মৃদু মিউজিক বাজছিলো। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস কথা ছাড়া এত বড় হল ঘরে এত লোক, সবাই নীরবে খেয়ে যাচ্ছিল। মিতালিরাও খেয়েদেয়ে রুমে ফিরে এলো।
দুপুরের নির্ঘুম আর সারাদিনের ক্লান্তিতে অমৃতা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেল সুদীপের বিছানায়। নরম বালাপোশের বিছানায় অমৃতা প্রায় ডুবেই গেল। স্লিপিং ড্রেস পরে মিতালিও নিজের নরম বিছানার মধ্যে ঢুকে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করলো। মাকে ফোন করে সারাদিনের সমস্ত ফিরিস্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে আর একবার দেওয়ালের ছবি দু’টির দিকে তাকালো। বীরবিক্রম পৌরুষে ভরা মহারাজার ছবির পাশে সৌন্দর্যের অপরূপ প্রতিমূর্তি সিন্ধি সুন্দরী। মনে হচ্ছিল যেন চির যুবক মহারাজ অনন্ত যৌবন নিয়ে রাণীর দিকে এগিয়ে আসছেন। মিতালির শরীর মনও কি তেমনটি চাইছিল ?
ভাবনা শেষ না হতেই সুদীপ বিছানার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিছুটা হলেও মিতালি বুঝতে পারলো অন্তঃসলিলা নদীর রোমান্টিক আবেগ ভেতরে ভেতরে তখনো সুদীপের মনে বইছে। সেও নিজেকে উজাড় করে দিলো মহারাণীর মতো !
।। তিন ।।
আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস মিতালির নেই।সে মনে করে ঘুমটা অন্ধকারেই ভালো হয়। ডাক্তার স্বামী সুদীপেরও তাতে সায় আছে। সেও বলে, অন্ধকারে মেলাটনিন হরমোন ভালো ক্ষরণ হয়। মেলাটনিন হরমোন ঘুমের পক্ষে সহায়ক। তাই ঘরে মৃদু আলোর ব্যবস্থা থাকলেও তারা ঘর অন্ধকার করেই শুয়ে পড়লো । হঠাৎ কেমন একটি শব্দে মিতালির ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার মধ্যে শুয়েই কীসের শব্দ তা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। যতটা অন্ধকার করে শুয়েছিল, ঘর ততটা অন্ধকার নেই। মনে হলো ঘরের মাঝখানে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছেন। মিতালি দ্রুত বিছানার মধ্যে উঠে বসলো। বেডসুইচে চাপ দিতেই সমস্ত ঘর ঝলমল করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে মিতালি যেন দেখতে পেল, সেই ছায়ামূর্তিটি দ্রুত পায়ে পিছিয়ে গিয়ে পোট্রেটের মধ্যে ঢুকে গেল। এমন দৃশ্য মিতালি জীবনে কখনো দেখেনি। ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ঘেমে উঠলো। সুদীপকে ডাকার মতো স্বরটুকুও কণ্ঠ দিয়ে বেরোলো না। আলো নিভিয়ে দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। কিছুটা সেন্সলেসের মতো। কিন্তু কতক্ষণ ! আবার সেই শব্দ। মিতালি আবার বিছানার মধ্যে উঠে বসলো। কিন্তু এবার আলো জ্বালালো না। ঘরের ভেতরটা এমনিতেই বেশ আলো হয়ে আছে। এবার ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হলো না। আরও আশ্চর্যের, এবার মিতালি ভয় পেল না ! সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সুন্দর পোশাকে সুদর্শন এক রাজা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘোরের মধ্যেও মিতালির মন বলে উঠলো, রাজাকে কিছু জিগ্যেস করা যাক। কিন্তু একি ! রাজা পোশাক খুলছেন কেন ? মিতালি যেন স্পষ্ট দেখতে পেল পোশাক খুলতে খুলতে রাজা অদ্ভুত ভাবে হাসছে। মিতালি ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার শুনে দ্রুত সুদীপ আলো জ্বালালো। দ্রুত নিজের বিছানা ছেড়ে মিতালির বিছানার কাছে এলো।মুহূর্তে মিতালি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সুদীপকে কাছে আসতে দেখেই সুদীপকে জড়িয়ে ধরলো। সুদীপ যত বলছে, কী হয়েছে ? মিতালি কোনো উত্তর না দিয়ে সুদীপের লোমশ বুকের মধ্যে মুখ লুকাতে ব্যস্ত। সুদীপ অনুমান করলো, কিছু একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। মিতালিকে স্বাভাবিক করতে সুদীপ নিজের বুকের মধ্যে মিতালিকে সাপটে নিলো। মিতালির মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।
সুদীপের দুই বাহুর আবেষ্টনীর মধ্যে নিজেকে পুরোটা সিঁধিয়ে দিয়ে মিতালি বলে উঠলো, এ বাড়িতে আর থাকবো না। এখানে ভুত আছে !