গল্প: আসা যাওয়ার পথের মাঝে।। সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী।। বহরমপুর - শৃণ্বন্তু গল্প: আসা যাওয়ার পথের মাঝে।। সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী।। বহরমপুর - শৃণ্বন্তু
মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন

গল্প: আসা যাওয়ার পথের মাঝে।। সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী।। বহরমপুর

আপডেট করা হয়েছে : রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ২:৩৩ পূর্বাহ্ন

গল্প:
আসা যাওয়ার পথের মাঝে
সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী 
অফিসের চাপে একেবারে মস্তিষ্কবিভ্রমের যোগাড়। ডাক্তার বললেন, ” দিন পনেরো একেবারে একা কোথাও ঘুরে আসুন। ভুলে যান বাড়ির কথা, অফিসের কথা, এখানকার সব কথা।”
              আমি চিরকালের ঘরকুনো, তাও আবার একা যেতে হবে! কোথায় যাওয়া যায়? অতএব চলে গেলাম বাঙালির চিরচেনা পুরীতে, যদিও শুনলে সবাই অবাক হবে এই আমার প্রথম পুরীদর্শন। এখান থেকেই বুকিং বুকিং সব ঠিকঠাক হয়ে গেল ইন্টারনেটের বদান্যতায়।
             হোটেলটা সমুদ্রের খুব কাছে। খুব সুন্দর একটা ঘর পেলাম। আমার ডান পাশের ঘরেই ছিলেন মিস্টার এন্ড মিসেস আয়ার। কয়েকদিন আগেই এসেছেন। ওরাও প্রথমবারের জন্য এসেছেন পুরী দেখতে। বয়স্ক দম্পতির সঙ্গে এত ভাব হয়ে গেল, মনে হলো যেন  আমার কত কালের চেনা। এমনকি আবেগের সঙ্গে বলেই ফেললাম,” আমি আপনাদের বাবা মা বলে ডাকবো?” ওরা বললেন,” কোন সমস্যা নেই। ডাকতেই পারো।”
         দিন তিনেক পরে আমার বাঁদিকের ঘরে এলো ডিভোর্সি সুচরিতা ওর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে। ওরা এলো দিল্লি থেকে। থাকবে কয়েকদিন। কি আশ্চর্য ওদের সঙ্গেও অদ্ভুত একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলো। এতটাই ঘনিষ্ঠতা যে আমি আর সুচরিতা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকতে আরম্ভ করলাম। সুচরিতার নয় বছরের মেয়েটি আমার প্রচন্ড ন্যাওটা হয়ে উঠলো। একদিন আমাকে বলল,” তোমাকে আঙ্কেল না বলে বাবা বলে ডাকলে তুমি রাগ করবে!” আমি একটু ভেবেচিন্তে বললাম,” না না রাগ করার কী আছে!” 
           এই পাঁচ জনে মিলে অসাধারণ আনন্দে দিন কাটাতে লাগলাম। মনে হলো আমরা সবাই যেন অনন্তকাল ধরে পরস্পরকে চিনি। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত একসঙ্গে থাকা, খাওয়া, ঘোরাঘুরি। মন্দির দর্শন, কখনো উত্তাল কখনো কিছুটা শান্ত সমুদ্রের রূপ দেখা, সমুদ্রের পাড় বরাবর অনেক দূরে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া, মানুষজন দেখা, নিভৃতে সুচরিতার সঙ্গে গল্প করা — সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। রাতের ঘুমটুকু শুধু যে যার নিজের ঘরে।
           আট দিন কেটে গেল এমন করে। সকালে উঠে দেখি মিস্টার এন্ড মিসেস আয়ার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি। বললেন,” আমাদের তো থাকার মেয়াদ শেষ। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।” হঠাৎ যেন কান্না পেয়ে গেল; বললাম, “থাকার আর কোন উপায় নেই?” ওরা বললেন, কী করে থাকি বল! ফেরার টিকিট তো আগে থেকেই বুক করা। বাড়ি না ফিরে উপায় আছে!”অগত্যা কাঁদতে কাঁদতেই বিদায় দিতে হলো।
           এবার রইলাম আমি আর সকন্যা সুচরিতা। তিনজনে মিলে দিনগুলো কাটাতে লাগলাম অসাধারণ ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে, পরম আনন্দে, যেভাবে সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিরা আমাদের বাড়ির কাছে আহিরনের মস্ত বড় বিলে এসে থাকে সেভাবেই। তিনজনের কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতেই পারছিলাম না।
         কিন্তু এবার তো আমার ফিরে আসার পালা। ছুটি শেষ। এবার বাড়ি ফিরতেই হবে।ডাক্তার বাড়ির কথা ভুলতে বলেছিলেন এই পনেরো দিনের জন্য। এবার একটু একটু করে বাড়ির কথা  মনে পড়ছে।
         ফেরার দিন সুচরিতাকে বললাম,” এবার যে আমাকে যেতে হবে।”আমাকে জড়িয়ে ধরল মা-মেয়ে দুজনেই, বলল, “কিছুতেই যেতে দেব না। তুমি গেলে আমরা কী নিয়ে থাকবো?” আমি বললাম,” আমার থাকার সময় তো শেষ হয়ে গেছে। কী করে থাকি বলো! ছুটি শেষ। বাড়িতে যে ফিরতেই হবে। যে পথ ধরে এসেছি আবার তো সে পথেই ফিরতে হবে। বাড়ি ফেরার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু বাস্তবটা না মানলে কী করে হবে বলো?” সুচরিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আবার কবে দেখা হবে?”
 বললাম,” কী জানি !হয়তো আবার কোনদিন হবে কিংবা হবে না। এটাই তো বাস্তব।”
 সুচরিতা বলল,” যদি অনেক বছর পরে আবার দেখা হয়, চিনতে পারবে?”
 আমি বললাম,” তাই বা কী করে বলি?”
 সুচরিতার শেষ প্রশ্ন: “আমাদের এই কদিনের একসঙ্গে থাকা সবটাই কি মিথ্যে?”
 আমি বললাম, “কে বলল মিথ্যে? বাড়ি ফিরে যাওয়াটাও যেমন সত্যি, আবার এই একসঙ্গে কয়েকদিনের একান্ত হয়ে থাকা সেটিও তো কম সত্যি নয়।  যদি মহাকালের কোন খাতা থাকে, সেখানে নিশ্চিত ভাবে লেখা থাকবে এই কদিনের কথা। ভালো থেকো। আমি চললাম।”
 হাতে সময় বেশি নেই। ট্রেন ঢুকবে। অঝোরে কাঁদছে সুচরিতা আর তার কন্যা। কিন্তু আমার তো আর ফিরে তাকানোর সময় নেই। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে চললাম স্টেশনের দিকে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগ থেকে আরোও
Theme Created By FlintDeOrient.Com
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!