মোজাফ্ফর হোসেন (বাংলাদেশ)
রবীন্দ্রনাথ মুসলমান ছিলেন না, এটা তো পরিস্কার। এমনকি তাঁর সময়ে তার পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রজারা তার টার্গেট পাঠকও ছিলেন না। তারা ছিলেন নিরক্ষর কৃষিজীবী মানুষ।
আচ্ছা, এই যে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজ নিয়ে লিখেছিলেন বলেই কি তিনি হিন্দু সাম্প্রদায়িক? বা বিপরীতে মুসলিম বিদ্বেষী? তাহলে তো মুসলমান সমাজ নিয়ে লেখার জন্য হুমায়ুন আজাদও মুসলমান সাম্প্রদায়িক, নাকি? [যাকে আপনারা নাস্তিক বলে হত্যা করেছেন, whom it may concern] রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সমাজ নিয়ে বেশি কিছু না লিখে বরঞ্চ ভালো করেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ হিন্দু সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন। লেখকের কাজই তাঁর সমাজের অসঙ্গতি দ্বিচারিতা ভণ্ডামিগুলো তুলে ধরা। এখন রবীন্দ্রনাথ যদি মুসলিম সমাজ নিয়ে লিখতে গিয়ে মুসলমান সমাজের ভণ্ডামি অসততা অসভ্যতা অন্ধত্ব তুলে ধরতেন, তাহলে আজ এই প্রশ্ন তোলা মুসলমানরাই তাঁকে বেশি বেশি গালাতো।
বুঝতে হবে কে কোন পাঠকসমাজের জন্য লিখছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আলাউদ্দিন আল আজাদ, কায়েস আহমেদ, শাহেদ আলী, সেলিনা হোসেন এঁদের সাহিত্যের বিষয় কেন প্রধানত মুসলমান সমাজ? বাংলাদেশের বৌদ্ধসমাজ যদি প্রশ্ন করে নজরুলের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম আছে, বোদ্ধসমাজ কেন আসেনি? আদিবাসী সমাজ কেনো আসেনি? তাহলে তিনি বৌদ্ধবিদ্বেষী, আদিবাসী বিদ্বেষী! হলো কিছু?
কাজেই আমগাছের নিচে গিয়ে কলা না পেয়ে আমগাছের গোড়ায় না লাথিয়ে আপনার উচিত কলাগাছের সন্ধান করা। ঘরের আশেপাশেই প্রচুর কলাগাছ কিন্তু আছে। না থাকলেও এক কথা ছিল। যেমন কবিতায় ইসলাম চাইলে রবীন্দ্রনাথ না পড়ে ফররুখ আহমদ পড়েন। এরপরও যারা রবীন্দ্রনাথে মুসলমান/ইসলামধর্ম খুঁজতে যান, বুঝতে হবে তাদের অন্য রাজনীতি আছে।
আরেকটা কথা, রবীন্দ্রনাথ কবি ছিলেন, নবী ছিলেন না। জমিদারিত্বের ভার নিয়ে পূর্ববঙ্গে আসেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। ওই বয়সেই তিনি পল্লি সংস্থারে যে অভূতপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা আমাদের চিন্তার বাইরে। আপনি রবীন্দ্রনাথের মতো একটা কবিতা/গান/গল্প লিখতে পারেননি মানা যায়, কিন্তু এই বুড়ো বয়সে সমাজের কি উপকারটা করছেন? ২৯ বছরের সেই তরুণ যা করছেন, সেইটা কি আপনি করা তো দূরে থাক বোঝার ক্ষমতা রাখেন?
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে বলেছিলেন, সাহাদের হাত থেকে শেখদের রক্ষার জন্যেই তাঁর এখানে আসা।সাহারা হচ্ছে মহাজন। জমিদারদের পক্ষ থেকে এরকম কথা আর কেউ কখনো বলেনি। রাশিয়ার চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেন: ‘চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল (জমিদার হিসেবে) আমার অভিপ্রায়।…জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।..সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না।’
এই চিন্তা থেকে ওই তরুণ বয়সে তিনি তিনি গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীনিকেতন’। মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং মননগত বিকাশ ওউন্নয়নের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। তৎকালীন পূর্ববাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে দরিদ্র প্রজাদের ভাগ্যোন্নতির জন্য তিনি সমবায় ব্যাংক, সমবায়নীতি ও কল্যাণবৃত্তি চালু করেন। সারা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম চালু করেন হেলথ্ কোঅপারেটিভ্ সোসাইটি। অধিক ফলনের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ল্যাবরেটরি।
বাংলার কুটিরশিল্পের উন্নয়নেও কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার উদ্যোগে বয়নশিল্প শেখাতে শ্রীরামপুরে নিয়ে যাওয়া হয় একজন তাঁতীকে। স্থানীয় একজন মুসলমান জোলাকে পাঠানো হল শান্তিনিকেতনে তাঁতের কাজ শিখতে। তিনি এসে খুললেন তাঁতের স্কুল। পটারির কাজেও হাত দেওয়া হল একই সময়ে। রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লেখেন : ‘বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলচে, সেই রকম একটা কল এখানে (পতিসরে) আনতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে।… আরেকটা জিনিস আছে ছাতা তৈরি করতে শেখানো। সে রকম শেখাবার লোক যদি পাওয়া যায় তাহলে শিলাইদহ অঞ্চলে এই কাজটা চালানো যেতে পারে।’
পল্লীসংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি চালু করেন হিতৈষীবৃত্তি ও কল্যাণবৃত্তি। এই বৃত্তি থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হতো রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদ সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা তৈরি চাষিদের বিপদ-আপদের সাহায্যসহ প্রজাদের নানামুখী উন্নয়ন কাজে। শিলাইদহে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পতিসরে বড় হাসপাতাল তৈরি করেন। ক্ষুদ্র ঋণ নামের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজ দেখি ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে সেটাই ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক ‘নামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই চিন্তার জন্য একশ বছর পর ডক্টর ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ”মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আল-বাঁধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসীতে জল আনা একই কথা।” পুত্রকে লেখা চিঠিতে এই কথা উল্লেখ করে সেই আমলে চাষের জন্যে পতিসরে কৃষকদের জন্য ট্রাক্টর নিয়ে আসেন, ভাবা যায়?
নোবেলের পুরস্কারমূল্য ছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। ১৯১৩ সালে এই টাকা কত টাকা আপনার কল্পনার বাইরে; তাই তো? রবীন্দ্রনাথ পুরস্কারের প্রায় সিংহভাগ দিয়ে দিলেন পতিসরের কালীগ্রাম কৃষিব্যাংকে। বাকি যা থাকল, ঢেলে দিলেন বিশ্বভারতী তৈরির কাজে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই কৃষিব্যাংক টিকিয়ে রাখতে পারেননি। পতিসরের গ্রামবাসীরা বলেন এই ব্যাঙ্ক চলেছিল ২০ বছর। ব্যাঙ্কের খাতায় ২৫ বছর পর্যন্ত লেনদেনের হিসাব পাওয়া যায়। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে , লগ্নির কোনো টাকা ফেরত পাননি রবীন্দ্রনাথ। ব্যাংকের অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন ‘ট্যাগোর অ্যান্ড কোং। এই কোম্পানি ন্যায্য মূল্যে চাষীদের ধান ও পাট কিনে বাজারে বিপণনের দায়িত্ব নেয়। সরাসরি বিপণনে অক্ষম প্রাথমিক উৎপাদকদের ন্যায়সঙ্গত পণ্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থাস্বরূপ এটা ছিল অত্যন্ত জরুরি উদ্যোগ। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন ৮০ বিঘা খাস জমিতে চালু করেন আধুনিক কৃষি খামার। এই হলেন তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ। আপনার বয়স এখন যেন কত?
১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা ও গোষ্ঠবিদ্যা শেখাতে তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে পাঠান আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯০৭ সালে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীও বিদেশে পাঠান কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য। তখন আই. সি. এস বা ব্যারিস্টার বানানো ধনী বাঙালি পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, আর জমিদার রবীন্দ্রনাথ পুত্র, জামাতা ও বন্ধুপুত্রকে চাষাবাদ শিখতে বিদেশ পাঠালেন। আর আপনি? আপনি যেন সন্তানকে কি পড়াতে চান??
একটা লাইন লেখার ক্ষমতা নাই, একটা সেবামূলক কাজ করার ইচ্ছা নাই, কটা দাড়ি গজিয়ে আসছে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতে!! অবশ্য দাড়িতেও রবীন্দ্রনাথকে হারাতে পারেননি
তার মানে কাউকে সমালোচনা করতে হলে কি তার সমকক্ষ হয়ে করতে হবে? মোটেও না। কিন্তু তাঁকে ও তাঁর সময়ের বাস্তবতা ভালোমতো জেনে তারপরে কথা বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ নবী না, কবি। তাও ফররুখ আহমদের মতো মুসলমান কবি না; হলো তো? তাঁর জীবন ও কর্মকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে আপনার জন্য কোনে নীতিশাস্ত্র দিয়ে জাননি। সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য, সংগীত, নাটক, কবিতা। একজন কট্টর মুসলিম হিসেবে সেইটা আপনার সাবজেক্টই না। কথা তো এইখানেই শেষ। পরিস্কার।
ধরুন, আপনি কট্টর মুসলমান হইলে রবীন্দ্রনাথ সংগীত আপনার শোনারই তো কথা না, সেইখানে মুসলমানদের জন্য কিছু থাকলেই কি বা না থাকলেই কি!!
এখন আপনি কট্টর মুসলমান না, তাইলে রবীন্দ্রনাথে মুসলমান খোঁজেন কেন? মানুষ খোঁজেন…পাবেন…
গোটা বিশ্ব সেটা পেয়েছে।
মুসলমানরা আরো জেনে রাখেন, জীবদ্দশাতেই আরববিশ্বে রবীন্দ্রনাথ অনূদিত ও প্রশংসিত হয়েছেন। আরববিশ্বে, বিশেষ করে তুরস্ক এবং ইরানে তাঁর লেখার ভেতর সুফিবোধের অনুসন্ধান করা হয়েছে। আরবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুবাদক সম্ভবত লেবানি কবি উয়াদি আল-বুস্তানি (১৮৮৬-১৯৫৭)। তিনি ১৯১৪ সালে ভারত আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েকদিন কাটান। এর প্রায় এক দশক পর তানিয়াস আবদুহ-এর অনুবাদে কায়রো থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ মিশর সফরে যান রবীন্দ্রনাথ। সফরকালে তিনি দেশটির প্রধান প্রধান কবি ও লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা এই পর্যায়ে যায় যে সেদিনের সংসদীয় অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। এরপর রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের ওপর দেশটির সাতজন বুদ্ধিজীবীর লেখা ৭টি প্রবন্ধ নিয়ে একটি সংকলন বের হয়। মিশরের পর ইরানের রাজা রেজা শাহ’র বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি ১৯৩২ সালে ইরানের তেহরান সফর করেন। একই বছর তিনি ইরাক সফর করেন। কয়েকজন প্রখ্যাত ইরাকি কবি তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতাও রচনা করেন।
এছাড়াও…
চেকোস্লোভাকিয়ায় জার্মান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দেন। আবার জার্মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মর্মাহত জনগণের আশ্রয় হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে ইউরোপে খ্রিস্টীয় ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মহিমা উদ্ধার করা হয়েছে রবীন্দ্র-রচনায়। আবার কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরাও রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনা নিজেদের মতো করে ভেবে নিয়েছেন। এক ব্রিটিশ সৈনিককে যুদ্ধে গীতাঞ্জলি সঙ্গে রাখতে দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রথমদিককার জাপানি অনুবাদক কবি মাশিনো সাবুরো (১৮৮৯-১৯১৬) যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রশান্তির জন্য রবীন্দ্রকাব্যে মনোনিবেশ করেন। মৃত্যু যত সন্নিকটে এসেছে তিনি তত রবীন্দ্ররচনা অনুবাদের দিকে ঝুঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে জাপানে ‘Memorial Society of Rabindranath Tagore’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় যেখানে দেশটির পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। ৮ খণ্ডে রবীন্দ্ররচনা বের হয়। এ সময় বহুভাষী ও ভারতীয় দর্শন বিষয়ে পণ্ডিত অধ্যাপক Watanabe Shoko (1907-77)-এর অনুবাদে জাপানি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুবাদটি প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের দর্শন এবং অর্জিত সম্মান লাতিন অঞ্চলের তরুণ লেখক ও কবিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় এ কারণে যে, তারা অনুধাবন করতে পারেন, বড়মাপের লেখক হওয়ার জন্যে য়ুরোপীয়দের মতো করে লেখা বা চিন্তা করা আবশ্যক নয়। লাতিন বিশ্বের বড়কবি নোবেলজয়ী হুয়ান রামোন হিমেনেস-এর দক্ষ হাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাতিনে প্রবেশ ঘটে। ১৯১৩ সালেই হিমেনেস আর তাঁর হবু বউ মার্কিন জেনোবিয়া ক্যামপ্রাবি মিলে ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদ শুরু করেন। এই অনুবাদের পাশাপাশি হিমেনেস লিখছিলেন তাঁর বিখ্যাত Platero and I গ্রন্থটি যা পরবর্তীতে স্প্যানিশ সাহিত্যের অনবদ্য সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটি রবীন্দ্রনাথের গীতিধর্মী গদ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হন চিলির অন্যতম প্রধান কবি নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদাও। নেরুদা তাঁর তারুণ্যে এই বাঙালি কবির প্রেমে পড়েন। নেরুদার প্রথমত উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বিশটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান-এ তরুণ নেরুদা তার ১৬তম প্রেমের কবিতায় একটি অন্বয় সংযোজন করেন, যা অনেক সমালোচক এ-ও মনে করে যে, এটি ঠাকুরের মালি কাব্যগ্রন্থের ৩০তম কবিতা:’তুমি সন্ধ্যারো মেঘোমালা’-এর একটি প্রচ্ছন্ন অনুবাদ। তাছাড়া, ১৯৪৫-এ নোবেলজয়ী আরেক চিলির কবি গ্যাবরিয়েলা মিস্ত্রাল রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো সংগ্রহে সহযোগিতা করেছিলেন, যেখানে তিনি‘মালি নিয়ে উদ্বেগ’-এর প্রতিক্রিয়ায় নিজের বেশ কিছু ব্যাখ্যা সংযোজন করেন। রবীন্দ্র-প্রভাবিত আরেক লাতিন কবি ওক্তাবিও পাস (১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত, যিনি ভারতে কিছুকাল অবস্থানও করেন) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাকুরের পাণ্ডুলিপির একটি বক্তৃতা দেন। পাস রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখেন :
[Rabindranath Tagore]’s work, as well as himself, was a bridge between India and the world. Admired by the greatest in Europe, such as W B Yeats and Andre Gide, in the Hispanic countries he also had numerous and fervent readers.
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোস্টারিকায় সংস্কৃত বিশারদ সল আরগুয়েলোর কোস্টারিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর রবীন্দ্রনাথের উপর এক আলোচনাসভা পরিচালনা করেছিলেন যেখানে ছাত্রছাত্রীরা এই রবীন্দ্রনাথকে শুধু পঠন-পাঠনই না, তাঁর কিছু নাটক মঞ্চস্থও করেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সল আরগুয়েলোর জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক চিন্তার উপর সে দেশের শিক্ষার ভিত দাঁড়িয়ে আছে। তাছাড়া মেহিকোর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান চরিত্র ও লেখক হোসে ভ্যাসকোনসেলোস ১৯২০-এর দিকে পশ্চিমীয় সাহিত্যপদ্ধতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ানোর চিন্তাগুলো ব্যবহার করে সাজিয়েছিলেন মেহিকোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। এখনও কোস্টারিকাসহ লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পঠিত হন।
বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ শুধু যুদ্ধবিরোধী চেতনা, প্রেম ও শান্তির কথা প্রচার করেননি। পূর্বাংলার বাউল গানে বৈশ্বিক পরিচিতি তৈরিতেও সক্রিয় থেকেছেন। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ এই গানের হুবুহু সুরটা তিনে নিয়েছেন, সেটা আমরা জানি। নানাভাবে তিনি গগন হরকরার প্রতি তার ঋণ শোধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, যেমন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’ সংকলনের ভূমিকা লিখতে নিয়ে গগনের এই গানের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ফরাসি গিয়ে ভারতীয় লোকধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গগনের পরিচয় দিয়ে গানটির উল্লেখ করেন। হাসন রাজার গানের কথা তিনি ভারতীয় দর্শন মহাসভার অধিবেশনের ভাষণে বলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হিবার্ট লেকচার দিলেন, সেখানেও হাসন রাজার গানের দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন। লালনের গান তিনি সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বিভাগে তিনি গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটি ছাপেন। একে একে লালনের কুড়িটি গান তিনি এখানে প্রকাশ করেছিলেন। লালনের গানের দুটি খাতা তিনি ছেঁউড়িয়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তা এখন বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে আছে।
নিজের কিছু রচনার উপর বাউলের প্রভাব সম্পর্কে নন্দগোপাল সেনগুপ্তকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছেন যে এসব ‘রবীন্দ্রবাউলে’র রচনা। ১৯০৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আলোচনাসভায় রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে লালনের কথা বলেন। ইন্ডিয়ান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেসে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে ঐ ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানটিতে ইংরেজ কবি শেলির কবিতার সাথে তুলনা করেন। নিজের ‘জীবনস্মৃতি’তে তিনি ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ এই গানটির সুন্দর মরমি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।
তারপরও রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, এই তো?
পতিসরের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেষ করছি। ঘটনাটি জানিয়েছেন আরেক কীর্তিমান বাঙালি অন্নদাশঙ্কর রায়। তখন তিনি রাজশাহীর ডি.এম.। রবীন্দ্রনাথ এলে তিনি পতিসরে দেখা করতে গেছেন। সেখানে একজন বৃদ্ধ মুসলমান প্রজা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: আমাদের ধর্মের মহামানবকে আমরা দেখিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে দেখলে তেমনই মনে হয়।
হলো তো?
না, হলো না। জানি তো। কারণ, বিষ রবীন্দ্রনাথে না, বিষ আপনার অন্তরে।
অসামান্য একটি লেখা। অন্ধ রবীন্দ্র বিরোধিতার গালে সপাটে একটি চপেটাঘাত।