ন্যাথানিয়েল হওথর্ন (Nathaniel Hawthorne):
ন্যাথানিয়েল হওথর্ন (১৮০৪-১৮৬৪) একজন আমেরিকান ছোটগল্প লেখক ও ঔপন্যাসিক। ইতিহাস, নৈতিকতা, আর ধর্ম নিয়ে তার লেখার জগৎ। ন্যাথানিয়েল ১৮০৪ সালের ৪ জুলাই ম্যাসাচুসেটস ষ্টেটের সেলেম শহরে এক উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি প্রথম লেখা শুরু করেন। সেই সময়ে লেখা কয়েকটি ছোটগল্প পরে তার Twice-Told Stories বইয়ে একত্রিত করে প্রকাশ করা হয়। ১৮৫০ সালে তার প্রথম বই Scarlet Letter প্রকাশিত হয়। ন্যাথানিয়েলের বেশির ভাগ লেখার প্রেক্ষাপট আমেরিকার New England এলাকা (আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অংশ), এই কারণে তার লেখায় আঞ্চলিক গোঁড়া খ্রীস্টান আচারব্যবহারের সমালোচনা প্রায়শই দেখা দিয়েছে। ন্যাথানিয়েল আমেরিকার সাহিত্যে Romantic movement এও এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
ন্যাথানিয়েলের ছোটগল্পের সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে থেকে তিনটি গল্পের কথা বলা যাক। প্রথমটি Twice-Told Stories বই থেকে, নাম, The Minister’s Black Veil; গল্পে শহরের গির্জার রেভারেন্ড মিস্টার হুপার একদিন ধর্মোপদেশ দেবার সময় মুখের ওপর এক পাতলা কালো ঘোমটা চাপিয়ে হাজির হলেন। সবাই অবাক, অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া গেল না। এরপর থেকে মিস্টার হুপারের মুখের ওপর সর্বদা সেই কালো পাতলা ঘোমটা, প্রায়ই গির্জায় ভারী গলায় বক্তৃতা দেন পাপের কলুষের ওপর। যারা দোষ স্বীকার করতে আসে তারা ভয়ে তাড়াতাড়ি দোষ স্বীকার করে, ক্রমে পাদ্রির নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। গুজব রটল মৃত মানুষের আত্মার হাত ধরে কালো ঘোমটা দেওয়া পাদ্রি কবরস্থানে যান। ভয়ে শহরের কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে না এই ঘোমটা কেন। এমন কি প্রেয়সী এলিজাবেথের অনেক অনুনয়ের পরও মিস্টার হুপার ঘোমটা সরান না। কালো ঘোমটার ভয়ে শহরের পাপী তাপীদের সংখ্যা কমতে শুরু করলো, মিস্টার হুপার বিশপ পদে উন্নীত হলেন। বহু বছর বাদে এলিজাবেথ মিস্টার হুপারের মৃত্যুশয্যার পাশে হাজির হয়ে একটিবারের মত ঘোমটা সরাতে বলে, কিন্তু ঘোমটা সরে না। ঘোমটা সমেত মিস্টার হুপার কবরে যান। গল্পটি পাপ, স্বীকারোক্তি, আর নৈতিকতার মানসিক অন্বেষণের এক অনবদ্য উদাহরণ।
দ্বিতীয় গল্পটির নাম Rappaccini’s Daughter. এই Gothic গল্পটি ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির পাদুয়া শহরের গল্প। Dr. Giacomo Rappaccini একজন চিকিৎসক ও গবেষক, বাগান ভর্তি বিষাক্ত উদ্ভিদ নিয়ে তার গবেষণা। তার মেয়ে Beatrice সেসব গাছপালা ঘেঁটে নিজেই বিষাক্ত হয়ে গেছে। নেপলস থেকে Giovanni নামে এক তরুণ ছাত্র পাদুয়া ইউনিভারসিটিতে পড়তে আসে। বাড়ি ভাড়া নেয় এক পুরনো জমিদার বাড়িতে। বাগানে কর্মরত চুপচাপ সুন্দরী Beatrice কে দেখে সে তার প্রেমে পড়ে যায়। বাগানে দুজন প্রায়ই দেখা করে যা Giovanni র শিক্ষক Baglioni (Rappacciniর প্রতিদ্বন্দ্বী) পছন্দ করেন না। Giovanni র নজরে পড়ে Beatrice এর স্পর্শে গাছপালা পোকামাকড় সব মরে যায়, এমনকি তার ছোঁয়ায়
Giovanni র শরীরও নীল হয়ে যায়। সব উপেক্ষা করে মেলামেশা চালিয়ে গেলে Giovanni নিজে ক্রমে বিষাক্ত হয়ে যায়, যা Rappaccini র গবেষণার সাফল্যের নিদর্শন, আর সেই কারণেই Rappaccini উল্লসিত হয়ে ওঠেন। Giovanniর শিক্ষক Beatrice কে অ্যান্টিডোট দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করলে Beatrice মারা যায়। Rappaccini কিন্তু তার নিজের সাফল্যে নিমগ্ন থাকে। সমালোচকদের মতে এই আদম আর ইভের গল্পে Rappaccini ঈশ্বরের আর Baglioni শয়তানের ভূমিকায় চিত্রিত। Baglioni র অ্যান্টিডোট (ওই গল্পের আপেল) দুজনের একসঙ্গে পান করার কথা, যার পর তারা সুস্থ হয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পারত, সেই পরিণতি হতো আদম ইভের স্বর্গ থেকে বিদায়। কিন্তু Beatrice একা অ্যান্টিডোট পান করায় তার মৃত্যু হয়। Rappaccini’s Daughter গল্পটি ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত Mosses from an Old Manse নামের ছোটগল্প সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ঔপনাসিক ও গল্পকার : ন্যাথানিয়েল হওথর্ন
এই Mosses from an Old Manse সঙ্কলনের আর একটি গল্প Roger Malvin’s Burial আমাদের তৃতীয় গল্প। গল্পের শুরুতে যুদ্ধে আহত দুই বন্ধু Malvin আর Reuben পাহাড়ের ধারে এক জঙ্গলে বসে আছে। Malvin এর আঘাত অনেক বেশি গুরুতর আর তার বয়সও অনেক বেশি। তাই সে Reuben কে বলে তোর বয়স কম, বাঁচার চান্স বেশি, তুই গ্রামে পালিয়ে যা। ঘোর অনিচ্ছা স্বত্বেও Reuben Malvin কে ছেড়ে চলে যায়। Malvin মারা যাবার পর Reuben এর অনুতাপ হয়, তার আক্ষেপ সে বন্ধু Malvin কে কবর দিতে পারেনি। এর পর Reuben Malvin এর মেয়ে Dorca কে বিয়ে করে, কিন্তু সে তার বিবাহিত জীবনে শান্তি পায় না। বেশ কয়েক বছর বাদে Reuben আর তার ছেলেকে নিয়ে জঙ্গলে শিকার করতে যায়, ঘটনাচক্রে তারা দুজন আলাদা হয়ে যায়। সন্ধ্যের অন্ধকারে ঝোপের মধ্যে শব্দ শুনে হরিণ ভেবে Reuben গুলি করে, সে গুলি লাগে তার ছেলের বুকে। অবাক কথা, Reuben চারপাশ ভালো করে দেখে চিনতে পারে এটা সেই জায়গা যেখানে সে আহত Malvin কে ফেলে চলে গিয়েছিলো!
ন্যাথানিয়েলের প্রথম নভেল Scarlet Letter ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটিতে ১৬৪২-৪৫ সালে Boston শহরের গোঁড়া খ্রিষ্টান সমাজে Hester Prynne নামে এক অপরূপ যুবতীর অবৈধ কন্যা সন্তান জন্ম দেবার পর তার ওপর সামাজিক নির্যাতনের গল্প বলা হয়েছে। নগরচত্বরে অনেক অপমানের পর মুরুব্বিদের রায় হয় Hester এর পোশাকের ওপর সর্বদা বড় লাল অক্ষরে “A” (adultery) লেখা থাকবে। তার ওপর কন্যার পিতার নাম না বলার কারণে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। বিচারের সময় চারপাশে ভিড়ের মধ্যে Hester এর হারিয়ে যাওয়া পুরনো স্বামী এই অবৈধ সন্তানের কথা জানতে পেরে সেই কন্যার আসল পিতাকে খুঁজে বার করে হত্যা করার শপথ নেয়। অনেক নির্যাতনের পর Hester মুক্তি পায় ও শহরের এক প্রান্তে এক কুটিরে কন্যা Pearl কে নিয়ে পোশাক সেলাই করে বহু কষ্টে দিন যাপন করে। Pearl এর বিশাল কৌতূহল ওই A অক্ষরটি নিয়ে, তার কোন বন্ধু নেই। সে ক্রমে বেয়াড়া আর অবাধ্য হয়ে পড়ে। গির্জার বিশপ Pearl কে মার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাইলে Hester এক মন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়। ভগ্নস্বাস্থ্য মন্ত্রী Pearl কে Hesterএর কাছে রাখার বন্দোবস্ত করে আর সেই সময় Hesterএর স্বামী (বর্তমানে এক চিকিৎসক) তার সেবায় নিযুক্ত হয়। স্বামীর সন্দেহ হয় এই মন্ত্রীই Pearl এর অবৈধ পিতা। সে মন্ত্রীর ওপর মানসিক চাপ দেয়। অনুতাপে জর্জরিত হয়ে অবশেষে মন্ত্রী শহরের সেই নগরচত্বরে গিয়ে শহরের অধিবাসীদের কাছে তার কুকীর্তির কথা স্বীকার করে। Hester মন্ত্রীর সাথে লুকিয়ে দেখা করে তার স্বামীর প্রতিজ্ঞার কথা জানায় এবং মন্ত্রীর সাথে ইউরোপে পালিয়ে যাবার মতলব করে। কিন্তু পরের দিন আগত ভোটের সময় এক দুর্দান্ত বক্তৃতা দিয়ে মন্ত্রী Hester এর কোলেই তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। অবাক কথা সবাই মৃত মন্ত্রীর বুকেও লাল অক্ষরে A লেখা দেখতে পায়। পরবর্তী সময়ে Hester সেই লাল A-লেখা পোশাক পড়েই দিন কাটায়। তার মৃত্যুর পর স্বামীর পাশাপাশি কবরে এক কালো স্লেট পাথরের ফলকে লেখা থাকে “এক কালো প্রেক্ষাপটে অক্ষরটি লাল”। প্রকাশনার পর Scarlet Letter পাঠক সমাজে ভীষণ সমাদৃত হয়, প্রথম দশ দিনের মধ্যে ২৫০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
ন্যাথানিয়েলের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে The House of Seven Gables (১৮৫১ সালে প্রকাশিত) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই Gothic নভেলটি অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকার উত্তরপূর্ব প্রান্তের New England এলাকার এক Pyncheon পরিবারের পৈতৃক বাড়ির গল্প। গল্পটি অপরাধবোধ, প্রতিশোধ, আর প্রায়শ্চিত্তর আলো আঁধারে লেখা, তার সাথে অতিপ্রাকৃত ঘটনাও জড়িয়ে আছে। এই পৈতৃক জীর্ণ আধো-অন্ধকার অসুখী প্রাসাদে ইতিমধ্যেই অভিশাপের ছায়া পড়েছে। বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা Hepzibah Pyncheon অর্থাভাবে জর্জরিত, তাই সে বাড়ির এক অংশে দুর সম্পর্কের এক ভাই Clifford কে দোকান খুলে দিয়েছে। Clifford তিরিশ বছর জেল খেটে বেরিয়েছে। হঠাৎ সেই বাড়িতে সুন্দরি তরুণী Phoebe (সম্পর্কে দূরের কোনো আত্মীয়া) আসায় বাড়িতে একটু প্রাণ আসে।
এই Pyncheon পরিবারের প্রাসাদটি পরিবারের আদিপুরুষ কর্নেল Pyncheon বেআইনী ভাবে জায়গা দখল করে নির্মাণ করেন। জমির আসল মালিক Maule মরার আগে Pyncheon পরিবারের ওপর অভিশাপ দিয়ে যায়। ফলস্বরূপ গৃহপ্রবেশের দিন আচমকা কর্নেল বারান্দার চেয়ারে বসে মারা যান। তার ছবি প্রাসাদের দেয়ালে টাঙ্গানো, সবাইকে শাপের কথা অহরহ মনে করিয়ে দেয়। Phoebe কিছুদিনের জন্য তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলে Clifford বিমর্ষ হয়ে জানলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আর গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী হয়। এর মধ্যে শহরের প্রধান বিচারক Pyncheon পরিবারের কাছে প্রাসাদের দলিল দাবী করে। Clifford দেখাতে না পারায় বিচারক প্রাসাদে হাজির হয় আর সেই কর্নেলের চেয়ারে বসে জানায় সে দলিল না নিয়ে যাবে না। অবাক কথা আচমকা সেই চেয়ারে বসেই বিচারকের মৃত্যু হয়। ভয় পেয়ে Hepzibah আর Clifford পালিয়ে যায়, আর বিচারকের মৃতদেহ আবিষ্কার করে গৃহভৃত্য Holgrave। Phoebe ফিরে এলে সবাই মিলে খুঁজে কর্নেলের ছবির পিছনে লুকানো সেই দলিল খুঁজে পায়। আর এও প্রকাশ পায় যে Holgrave আসলে Maule এর বংশধর। কিন্তু পরপর মানুষের আচমকা মৃত্যুর পর কারোরই আর এই অভিশপ্ত প্রাসাদের ওপর টান নেই, সবাই একজোটে প্রাসাদ পরিত্যাগ করে চলে যায়।
১৮৫৩ সালে ন্যাথানিয়েল তার বন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতা Franklin Pierce এর রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর The Life of Franklin Pierce নামে একটি বই লেখেন। পরে Pierce আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১৮৫৩ সালে ন্যাথানিয়েল ইংল্যান্ডের Liverpool শহরে আমেরিকার প্রতিনিধির পদে নিযুক্ত হন। ১৮৬০ সালে ন্যাথানিয়েল আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। ন্যাথানিয়েল তার লেখক জীবনে বেশ কয়েকটি বই লেখেন, উল্লেখযোগ্য উদাহরণঃ The Blithedel Romance, Tanglewood Tales (ছোটগল্প সঙ্কলন), The Marble Faun, আর Chiefly About War Matters. আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ন্যাথানিয়েল ওয়াশিংটনে যান আর Abraham Lincolnএর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে ১৮৬২ সালে প্রকাশিত Chiefly About War Matters বইটিতে। ১৮৬৪ সালে Nathaniel Hawthorne এর মৃত্যুর পর তাকে ম্যাসাচুসেটস্ ষ্টেটের Concord শহরে Sleepy Hollow Cemetery তে সমাহিত করা হয়।