আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্যিক, এই পর্বের সাহিত্যিক :
William Sydney Porter যাকে আমরা তার ছদ্মনাম ও. হেনরি বলে জানি, একজন আমেরিকান ছোটগল্পকার। তার সাহিত্যিক জীবনে তিনি ছোটগল্প ছাড়া কিছু কবিতা ও অন্যান্য লেখাও লিখেছেন। এই লেখকের কালজয়ী গল্প The Gift of the Magi পৃথিবীর বহু দেশের পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। আমার সাথে হেনরির পরিচয় এই গল্প দিয়েই। এছাড়া হেনরির Cabbages and Kings উপন্যাসটিও পাঠক সমাজে সমাদৃত। গভীর পর্যবেক্ষণ, কৌতুক-মণ্ডিত ভাষা এবং বিস্ময়কর পরিসমাপ্তি হেনরির গল্পের অন্যতম আকর্ষণ।
১৮৬২ সালে North Carolina ষ্টেটের Greensboro শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে উইলিয়াম পোর্টারের জন্ম হয়। তার পিতার ওষুধের ব্যবসা ছিল। ছোটবেলা থেকেই উইলিয়ামের বই পরার ও আঁকার নেশা ছিল। কিশোর বয়েসে তার One Thousand and One Nightsএর ইংরাজি অনুবাদ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। স্কুল শেষ করার পর মাত্র ১৯ বছর বয়েসে উইলিয়াম কম্পাউন্ডার ট্রেনিং সম্পূর্ণ করে Texasএ চলে আসেন এবং Austin শহরে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। এই শহরেই ব্যাঙ্কে চাকরি করার সাথে সাথে তিনি গল্প লেখায় মনোনিবেশ করেন। তার প্রথম জীবনের গল্পগুলি The Rolling Stone পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। Texasএ থাকাকালীন বন্ধুদের সমাবেশে নিয়মিত গল্প বলে তিনি আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন।
১৮৯৫ সালে উইলিয়াম Houston শহরে চলে আসেন। এই শহরে বসবাসের সময় Post পত্রিকায় তার ছোটখাটো ঘটনা বা কোন মজার মানুষ নিয়ে লেখা ছোটগল্প পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঘটনাচক্রে এখানের এক ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর তিনি Hondurasএ পালিয়ে যান। এই Hondurasএ থাকাকালীন তিনি তার Cabbages and Kings উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করেন। এই উপন্যাসেই উইলিয়াম “banana republic” পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন। শব্দটি অরাজকতায় অস্থির কোন গরিব দেশ যা তাদের অল্পসংখ্যক কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানির ওপর নির্ভর করে তার এক ব্যাঙ্গাত্মক উদ্ধৃতিতে ব্যবহৃত হয়। Texasএ তার স্ত্রী Athol যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হলে উইলিয়াম আমেরিকায় ফিরে এসে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং Atholএর মৃত্যু পর্যন্ত তার সেবা করেন। এর পর ১৮৯৮ সালে তিনি Ohio ষ্টেটের জেলে পাঁচ বছরের জন্য বন্দি থাকেন। এই কয়েদি জীবনেই তিনি ও. হেনরি ছদ্মনামের আড়ালে ১৪টি গল্প লেখেন। জেলে থেকে লেখা Whistling Dick’s Christmas Stocking গল্পটি হেনরির প্রথম জীবনের অন্যতম রচনা। গল্পটি McClure’s Magazineএ প্রকাশিত হয়।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হেনরি তার মেয়ে Margaretকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে চলে আসেন। হেনরির ফলপ্রসূ লেখক জীবনের শুরু এই নিউ ইয়র্ক শহরে যেখানে New York World Sunday magazineএ প্রতি সপ্তাহে তার একটি করে ছোটগল্প প্রকাশিত হতো। গল্পের প্রাঞ্জল ভাষা, কৌতুকের আলতো ছোঁয়া, আর আচমকা ঘটনার মোড় পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দেয়। সব মিলিয়ে হেনরি এই শহরে ৩৮১টি গল্প লিখেছিলেন। ১৯০৯ সালে তার দ্বিতীয় স্ত্রী Sarah Colemanএর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর কয়েক মাসের মধ্যেই (১৯১০ সাল) হেনরি মারা যান। অত্যধিক মদ্যপান আর ডায়াবিটিস মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে লেখকের জীবনের ইতি টানে। মৃত্যুর পর তার দেহ North Carolinaর Asheville শহরের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার কবর দেখতে আসা মানুষ এখনো এক ডলার এবং সাতাশি সেন্ট অর্পণ করে যায়; The Gift of the Magi গল্পে Dellর এই সামান্য পুঁজিই জমানো ছিল তার হাতের ব্যাগে।
এবার হেনরির লেখার কথায় আসি। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত The Gift of the Magi গল্পটি এক দরিদ্র অল্পবয়স্ক দম্পতির একে ওপরকে লুকিয়ে খ্রিষ্টমাসের উপহার কেনার এক মনছোঁয়া কাহিনী। গল্পের শুরু খ্রিষ্টমাসের আগের দিন, এক তরুণী Della Dillingham আবিষ্কার করে যে তার পুঁজি মাত্র এক ডলার সাতাশি সেন্ট, তাকে তার স্বামী Jamesকে (Della তাকে আদর করে Jim বলে ডাকে) একটা উপহার কিনে দিতে হবে কাল উৎসবের দিনে। তারা এক গরিব দম্পতি, দামি কিছু কেনার সামর্থ নেই। দুটি জিনিস এই পরিবারের সম্পদ, প্রথমটি Dellaর হাঁটু পর্যন্ত ঢেউ খেলানো সোনালি চুল যা রানীর সম্পদের চেয়েও দুর্মূল্য, আর আছে Jimএর এক দামি সোনার পকেট ঘড়ি যা পুরুষানুক্রমে তার পরিবারের সম্পদ। অনেক ভেবে Della পাড়ার Madame Sofronieর পরচুলার (wig) দোকানে গিয়ে তার সেই অমূল্য চুলের রাশ কুড়ি ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় আর সেই অর্থ দিয়ে Jimএর সোনার ঘড়ির জন্য একটি প্লাটিনামের চেন কেনে। সন্ধ্যে বেলায় Jim বাড়ি ফিরে এলে অনেক দ্বিধার পর Della তাকে বলে যে সে তার অতিপ্রিয় চুল বিক্রি করে Jimএর সোনার ঘড়ির এক উপযুক্ত চেন কিনেছে। হতভম্ব Jim তার পকেট থেকে Dellaর উপহার বার করে, এক রত্নখচিত অপরূপ চিরুনি যা সে সোনার ঘড়ি বিক্রি করে কিনেছে! Dellaর চুল আবার বড় না হওয়া পর্যন্ত সে চিরুনির কোন ব্যবহার সম্ভব নয় আর Jimএর পকেট ঘড়ি নেই, তার প্লাটিনামের চেন কি কাজে লাগবে? যদিও খ্রিষ্টমাসের দিনে দুজনেই তাদের উপহার কাজে লাগাতে পারবে না, তবু এই গরিব দম্পতি জানে ভালবাসার মানুষকে তার প্রিয় উপহার প্রেমিক বা প্রেমিকা তার সব কিছু উজাড় করে জোগাড় করে আনে। গল্পের শেষের লাইনে লেখক লেখেন যারা নিজের সর্বপ্রিয় সম্পদ তাদের ভালবাসার মানুষকে অনায়াসে অর্পণ করতে পারে তারা যীশু খ্রিষ্টের জন্মের পর যে তিনজন বিজ্ঞজন (Magi) উপহার নিয়ে এসেছিলেন তাদের মতই জ্ঞানী! ল্যাটিন Magus (বহুবচনে Magi) শব্দটির অর্থ বিজ্ঞ পুরোহিত। যীশুর জন্মের পর তিন বিজ্ঞ পুরুষ তার জন্য স্বর্ণমুদ্রা, ধুপ, ও অন্যান্য উপহার নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন।
New York Sunday Worldএ প্রকাশের পর এই সহজ সরল গল্পটি পৃথিবীর সব দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। সমালোচকদের ভাষায় “This story is focused on the inner beauty of love which compels this young couple to sacrifice their most prized possessions for each other”. Timesএর সমালোচক লেখেন “the ending is considered as an example of cosmic irony”!
১৯০৭ সালে The Saturday Evening Post পত্রিকায় প্রকাশিত হেনরির The Ransom of Red Chief গল্পটিতে আমরা এক অভূতপূর্ব মুক্তিপণের সাথে পরিচিত হই যেখানে দুজন মানুষ এক ধনী পরিবারের ছেলেকে ধরে আনার পর সেই বেয়াদব আর বেপরোয়া ছেলের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে আবার নিজেদের অর্থ কবুল করে ফিরিয়ে দেয় তার পিতার কাছে। গল্পের শুরুতে Bill Driscoll আর Sam Howard, দুজন ছিঁচকে চোর, Ebenezer Dorset নামের এক ধনী মানুষের ছেলে Jonnyকে ধরে নিয়ে আসে আর তার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ দাবি করে। এই একমাথা লাল চুল ছেলেটি একেবারে নষ্ট আর বখাটে। সে তার নিজের নাম দেয় Red Chief আর তার বন্দিদশা দারুণ ভাবে উপভোগ করে। সারাদিন তার বকবকের শেষ নেই, সে যখন তখন Bill আর Samকে নানাভাবে উত্যক্ত করে, তাদের ছোটখাটো হয়রানিতে ফেলে খুব মজা পায়। মাঝে মধ্যে তাদের ঘোড়া সাজিয়ে নিজে পিঠে বসে মাইলের পর মাইল দৌড় করায়। প্রথমে চোর দুটো ২০০০ ডলার মুক্তিপণ চেয়েছিল,তার পর ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে পণ কমিয়ে আনে, তাদের দাবি হয় ১৫০০ ডলার। Jonnyর পিতা বুদ্ধিমান মানুষ, তিনি তার ছেলেকে ভাল চেনেন, আর এও বুঝে জান যে চোরের দল তার গুণধর ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ভারী বিপদে পড়েছে। তিনি মুক্তিপণের দাবী পরিষ্কার নাকচ করে দিয়ে দুই চোরকে জানান যে তিনি তার কুপুত্রকে ফেরত নেবেন যদি তারা পিতাকে ২৫০ ডলার জরিমানা দেয়। দুই চোর তখন অতিষ্ঠ, Red Chief তাদের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে। তারা চটপট জরিমানা দিয়ে বিচ্ছুকে বাপের হাতে তুলে দিয়ে পরি কি মরি করে পালিয়ে বাঁচে।
১৯৫০ সালের পর এই গল্পটি বেশ কয়েকটি টেলিভিশন সিরিজ আর সিনেমায় রূপায়িত হয়েছে। এমন কি ১৯৬২ সালে সোভিয়েট রাশিয়ায় এই গল্পের ভিত্তিতে একটি সাদ-কালো চলচিত্র Strictly Business নির্মিত হয়। সমালোচকদের মতে “this story is a classic example of two ultimate comic ironies: a hostage actually liking his abductors and enjoying being captured, and his captors having the tables turned on them and being compelled to pay to get rid of him”!
হেনরির The Duplicity of Hargraves গল্পটি আমার আর এক প্রিয় গল্প। ১৯০২ সালে The Junior Munsey ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই গল্পের শুরু যখন আমেরিকার দাক্ষিণাত্যের এক অভিজাত Talbot পরিবারের আটষট্টি বছরের মেজর Pendleton Talbot ও তার বয়স্কা কুমারী মেয়ে Lydia গৃহযুদ্ধে (American Civil War)সব হারিয়ে Washington D. C. শহরের এক বোর্ডিং হাউসে এসে ওঠেন। সেখানে তাদের সাথে Henry Hopkins Hargraves নামের এক অভিনেতার পরিচয় হয়। এই Hargraves মানুষটি স্থানীয় এক ফরাসি যাত্রা কোম্পানিতে অভিনয় করে। সে প্রায়ই মেজর Talbotএর কাছে আসে আর মেজর তাদের পুরনো রঙ্গিন জীবনের ওপর যেই বইটি লিখছেন তার থেকে গল্প শোনে। কিছুদিন বাদে মেজরের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, তাদের বাড়িভাড়া বাকি পড়ে। মেজর এলাকার মেয়রের কাছে আবেদন করেন তার বইটি যদি প্রকাশিত হয়। কিন্তু কোথায় কোন সাড়া মেলে না। বিক্ষিপ্ত মনে মেজর পকেটের শেষ দুটি ডলার দিয়ে টিকিট কিনে তার মেয়েকে নিয়ে সেই যাত্রা দেখতে যান। যাত্রার আসরে বসে তারা লক্ষ্য করলেন Hargraves মেজরকে ব্যাঙ্গ করেই এক কৌতুকের আসর তৈরি করেছে। পরের দিন Hargraves মেজরকে কিছু ডলার দিয়ে সাহায্য করতে এলে ক্রুদ্ধ মেজর তাকে জানান যে তিনি খুবই অপমানিত হয়েছেন এবং সেই যাত্রার আয় থেকে কোন সাহায্য তিনি গ্রহণ করবেন না। যদিও Talbot পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়, আভিজাত্যের অপমান এই বৃদ্ধের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
দিন কয়েক বাদে পিতা ও কন্যার অসহনীয় আর্থিক দুর্গতির মাঝে বাড়িতে এক কৃষ্ণকায় বৃদ্ধের আবির্ভাব হোল। সেই অপরিচিত মানুষটি মেজরকে জানালো যে সে একসময়ে Talbot পরিবারের ক্রীতদাস ছিলো। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর দাসপ্রথা থেকে মুক্তি পেয়ে সে ব্যবসা করে বেশ পরিমাণে অর্থ সঞ্চয় করেছে আর তাই আজ সে এসেছে Talbot পরিবারের ঋণ শোধ দিতে। মেজর Talbotখুশি মনে সেই অর্থ গ্রহণ করেন। দিন কয়েক বাদে Lydia একটি চিঠি পায়, চিঠিতে Hargraves লিখেছে যে সেই ক্রীতদাস সেজে মেজরকে সাহায্য করতে এসেছিলো। Lydia সেই চিঠি লুকিয়ে রাখে,তার বৃদ্ধ পিতার আভিজাত্যের অহংকার সে ভাঙ্গতে চায় না! ১৯১৭ সালে পরিচালক Thomas Mills এই গল্পটিকে চলচিত্রে রূপায়িত করেন। ছবিটি দর্শক সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সাধারন মানুষের জীবনে নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনার উদাহরণ আমরা পাই ও. হেনরির গল্পে। ইংরাজিতে যাকে irony বলা হয় তার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে The Cop and the Anthem গল্পটিতে। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত এই গল্পের প্রেক্ষাপট নিউ ইয়র্ক শহরের Madison Square Garden এলাকার এক হেমন্তের রাত, গল্প মাত্র একটি হতভাগ্য রাস্তার মানুষকে নিয়ে যাকে আমরা Soapy বলে চিনি। মানুষটির রাত কাটে শহরের পার্কের বেঞ্চে, পুরনো খবরের কাগজ তাকে আড়াল করে শীতের হাওয়া থেকে। তার আজকের সন্ধ্যায় প্রধান লক্ষ্য সামনের শীতের আগে কোথাও কোন উষ্ণ ঘরে আশ্রয়লাভ, যেখানে খাবার আর কম্বল পাওয়া যাবে। এমন একটি আশ্রয়ের ঠিকানা Soapyর জানা, আর সেটা হোল Blackwell’s Islandএর কারাগার, যেখানে ছোটখাটো অপরাধের জন্য সে কয়েকবার তিন চার মাসের জেল খেটে এসেছে। আজ সন্ধ্যে বেলায় সে আবার কোন দুষ্কর্ম করে সেখানে ফেরত যেতে চায়।
এরপর শুরু হয় Soapyর আসামী হবার প্রয়াস। প্রথমে সে Broadway রাস্তার এক উচ্চ শ্রেণীর রেস্তোরাঁয় এসে বসে, তার মতলব দামী ভালো খাবার খেয়ে দাম না দেবার। তাহলেই রেস্তোরাঁর মালিক পুলিশ ডাকবে। কিন্তু এই প্ল্যান কাজে লাগলো না, রেস্তোরাঁর পরিচারকরা তার নোংরা পোশাক আর জীর্ণ জুতো দেখেই তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিলো। এরপর Soapy রাস্তা থেকে বড় এক পাথর তুলে এক দামী পোশাকের দোকানের আলোকিত কাচের জানলা ভাঙল, তার ইচ্ছে দৌড়ে আসা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া। কিন্তু পুলিশ এসে দাঁড়িয়ে থাকা Soapyকে সন্দেহ না করে দৌড় দিলো আর এক মানুষের পেছনে! এবারেও Soapyর প্ল্যান কাজে লাগলো না। মরিয়া Soapyর পরের টার্গেট এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক যিনি রাস্তার ধারের স্টল থেকে কাগজ কিনছেন। Soapyতার পাশে রাখা ছাতাটি নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলো। বৃদ্ধ দৌড়ে এসে ছাতা ফেরত চাইবার সময় রাস্তার পুলিশ এগিয়ে এলে বৃদ্ধ নিজেই পিছিয়ে গেলেন। “ছাতাটা আমার নয়, ওষুধের দোকানে পেয়েছিলাম” বলে তিনি হাঁটা দিলেন উল্টো পথে। পুলিশ চোখের আড়াল হতেই Soapy ছাতা ছুঁড়ে ফেলে দিলো আবর্জনার গাদায়। এবার Soapy এগোল এক তরুণীর দিকে, সুন্দর পোশাক পরিহিতা মহিলা দোকানের জানলায় প্রদর্শিত পণ্যদ্রব্য দেখছিলেন। অল্প দূরেই এক প্রহরার পুলিশ দাঁড়িয়ে। Soapy সোজাসুজি গিয়ে হাত ধরল সেই মহিলার, তার আশা পুলিশ এইবার তাকে মহিলাকে হয়রানি করার অপরাধে গ্রেফতার করবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, মহিলা মিষ্টি স্বরে বললেন, “সন্ধ্যের সঙ্গী খুঁজছিলাম, আমার একটা ড্রিঙ্ক দরকার”! হতাশ Soapy এবার রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে এক মাতালের অভিনয় শুরু করলো। তাতেও কোন ফল হোল না, রাস্তার পুলিশ হেসে তার বন্ধুকে বলল “এই কলেজের ধনী ছেলেগুলো ফুটবল খেলায় জিতে গেলে মদ খেয়ে কি যে হল্লা করে, যতো সব বাতুলের দল”! Soapyর এবারও গ্রেফতার হওয়া হোল না!
এদিকে রাত গভীর হয়েছে, হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হতাশ Soapy এবার পার্কে ফেরার পথে। রাস্তার পাশে এক ছোট গির্জায় একজন অর্গান বাজিয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছে। জানলা দিয়ে ভেসে আসা মিষ্টি গানের সুর, নরম চাঁদের আলো, স্নিগ্ধ শান্ত চারপাশ Soapyর মনে এক প্রশান্তি নিয়ে এলো। আধা অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগলো তার ছোটবেলার কথা, তার মা,তার পরিষ্কার পোশাক, উজ্জ্বল আলো, আর নিষ্পাপ হাসি! হঠাৎ তার মনে হোল সে কেন এত নিচে নেমে এসেছে, তার তো জীবন অন্য রকম হতে পারে। সে আবার কোন কাজ খুঁজে নেবে, আবার সে একজন সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিক হবে। এইসব ভেবে যখন Soapy নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে, তার পিঠে এক শক্ত হাতের চাপ পড়ল। ঘুরে দাঁড়াতেই বিশালাকায় এক পুলিশ “এখানে অন্ধকারে কি চুরির প্ল্যান করচ্ছিস শয়তান?” বলে তাকে এক ঘাড়ধাক্কা দিলো। “না, কিছু না”, Soapy উত্তর দেবার সাথে সাথেই পুলিশ তাকে তুলল গাড়িতে। পরের দিন সকালে কোর্টের বিচারপতি রায় দিলেন, “তিন মাস জেল, Blackwell’s Islandএর কারাগারে”।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাস্তায় পড়ে থাকা হতভাগ্য মানুষদের নিয়ে অনেকে অনেক গল্প লিখেছেন,কিন্তু হেনরির এক শীতের রাতে Soapyর এই ছোট্ট কাহিনী মনে গভীর দাগ কেটে যায়। এখনো সন্ধ্যের অন্ধকারে গির্জার অর্গানের আওয়াজ আমাকে এই অভাগার কথা মনে করিয়ে দেয়।
হেনরির Cabbages and Kings উপন্যাসটি আসলে ১৭টি ছোটগল্প জুড়ে তৈরি। গল্পগুলি আপাত দৃষ্টিতে একটু খাপছাড়া মনে হলেও বইটি শেষ করার পর পাঠক তাদের অন্তর্নিহিত যোগাযোগ পরিষ্কার উপলদ্ধি করতে পারেন। এখানে লেখক এক গরিব ছোট দেশের অশান্ত রাজনীতি,আন্তর্জাতিক শোষণ, দুর্নীতিগ্রস্থ বাণিজ্য, আর উপেক্ষিত সাধারণ মানুষের বিশৃঙ্খল জীবনের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বইটির টাইটেল Lewis Carroll এর Through the Looking Glass কবিতা থেকে নেওয়া। এই কবিতায় যে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ আছে, যেমন জুতো, জাহাজ,মোমবাতি, বাঁধাকপি আর রাজা, সেই সব হিজিবিজি নিয়ে Cabbages and Kings বইটি রচিত। ১৮৯০ সালে Hondurasএ থাকাকালীন ওই ছোট্ট অরাজকতায় দীর্ণ দরিদ্র দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হেনরি এই উপন্যাস লেখেন। বইয়ের প্রেক্ষাপট Anchuria নামের এক কল্পিত গরিব ক্যারিবিয়ান দ্বীপ যেখানে দেশের অভিবাসীরা দেশের প্রেসিডেন্টকে বিচারে অভিযুক্ত করার মরিয়া আন্দোলনে নেমেছে। তাদের অভিযোগ দেশের প্রধান ব্যাঙ্ক থেকে ডলারে ঠাসা এক চামড়ার ব্যাগ উধাও! প্রায় সব গল্পেই দেশটির সমুদ্র উপকূলের এক ছোট শহর Coralioর বিভিন্ন ঘটনার কথা বলা হয়েছে।
Cabbages and Kings উপন্যাসের শুরুতে আমরা জানতে পারি যে এই ছোট Anchuria দ্বীপে আমেরিকান জলদস্যু Goodwin ও তার নতুন অপরূপ সুন্দরী বউ Senorita Guilbert এক প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন কাটায়। মুশকিল বাধে যখন দেশের প্রেসিডেন্ট কোষাগার থেকে ১০০ হাজার ডলার ও Senorita Guilbertকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। Goodwin আবার Anchuriaয় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, সে আমেরিকা থেকে এই পলাতক প্রেসিডেন্টের কুকীর্তির খবর পায় এক গালিগালাজে ভরা টেলিগ্রামে (যা দেশের অধিকাশ মানুষই বুঝতে পারে না)। আমেরিকার দূতাবাসের দ্বিতীয় অফিসারGeddie তার স্ত্রী Idaকে হারিয়ে ইদানীং দ্বীপের সুন্দরী মেয়েদের পিছনে ঘুরে বেড়ায়। এক সকালে সমুদ্র উপকূলে ভেসে আসা একটি বোতলের চিঠি পেলে Geddieর আবার তার পলাতক স্ত্রীর প্রেমে বেসামাল হয়ে পড়ে। যথারীতি এই প্রেম পাগল অফিসারের বদলি হয়, দ্বীপে আসে Alabama ষ্টেটের এক অলস আর কুঁড়ে Jonny Atwood, যার মতে “you can’t expect a Democrat to work during the first term of office”! দ্বীপে হাজির হয়েই Atwood আর এক দুর্বৃত্তের সাথে স্থানীয় মানুষদের ঠকানোর প্ল্যান করে। কয়েকদিনের মধ্যেই এই প্রতারকরা অবাক হয় যে দ্বীপের মানুষদের সততাই ঠকানোর একমাত্র উপায় (হেনরির বিদ্রূপ বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনিয়)।
এর পর দ্বীপে সদ্য অধিষ্ঠিত Colonel Felipe Falconএর নেতৃত্বে অনুসন্ধান শুরু হয়। যদিও Goodwin জানে ডলার কোথায় আছে, সে চুপচাপ থাকে আর আরামে দিন কাটায়। Felipeমানুষটি পঙ্গু, হেনরির ভাষায় “a perfect sailor, but an imperfect man”। এক ভাঙ্গা স্মাগলারের জাহাজ দ্বীপের নৌবাহিনী যার সেনাধ্যক্ষ এই ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি পোশাকপরা পঙ্গু Felipe, হেনরির ভাষায় “the chief of a maritime banana republic”! Anchuriaর দুর্ভাগ্য যে এক প্রতারক Felipeকে ধোঁকা দিয়ে জাহাজে ওঠে আর নাবিকদের সাথে জোট বেঁধে নৌবাহিনীকে পরাস্ত করে। এর মাঝে শহরের এক মাতাল Beelzebub Blythe রটিয়ে দিলো যে এক বিশেষ জুতোর দোকানে এসে জুতো কিনলে Goodwin শহরবাসীকে অর্থ পুরস্কার দেবে। এই গুজবের মূলে Jonny যে তার বাবার Alabamaর জুতোর দোকানের একগাদা উদ্বৃত্ত জুতো বেচার সুযোগ খুঁজছিল। যদিও শহরের মানুষগুলো কখনোই জুতো পড়ত না, এই গুজবের পর শহরে হৈ চৈ পড়ে গেলো জুতো কেনার। আর এই জুতোর দোকানের লাভ পকেটস্থ করে Jonny তার প্রেমিকাকে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে গেলো। এবার শুরু হোল Keough নামের এক অফিসারের রাজত্ব। সে তার এক আমেরিকান বন্ধুর সাথে প্ল্যান করে আর এক জালিয়াতি শুরু করে। দেশের নতুন প্রেসিডেন্টকে (এই দেশের প্রেসিডেন্টের রাজাদের মত প্রায়ই বদল হয়) তার প্রতিকৃতি আঁকার ব্যপারে উৎসাহ দিয়ে তারা এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং প্রতিযোগিতার সমস্ত প্রবেশমূল্য নিজেদের পকেটে রাখে। আর এক প্রতারক তার ভাঙ্গা ক্যামেরা দিয়ে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ফটো তোলার অভিনয় করে শাসকের হাত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ আদায় করে। বস্তুত সব ছোটগল্পগুলিতেই হেনরি তার কৌতুকের স্টাইলে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে কিভাবে আমেরিকার মানুষ দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলিতে শাসনের নামে শোষণ আর প্রতারণা চালাত তার এক মনোরম ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
সমালোচকদের ভাষায়, “This book is a patched comedy. The stories sketched together actually give a decent depiction of Honduras and the neighboring small countries in the late 19th century with a good deal of humor thrown in”।
সবশেষে আমার প্রিয় হেনরির আর একটি গল্পের কথা বলি। গল্পটির নাম After Twenty Years. এটি দুই বন্ধুর গল্প, Jimmy আর Bob। তারা দুজনেই নিউ ইয়র্ক শহরে খুব ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। কিন্তু ঘটনাক্রমে দুই বন্ধুর জীবনের গতিপথ দুই দিকে মোড় নেয় যখন Bobভাগ্যান্বেষণে আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে চলে যায় আর Jimmy থেকে যায় নিউ ইয়র্ক শহরে। ছাড়াছাড়ির আগে দুই বন্ধু প্রতিজ্ঞা করে যে তারা ঠিক কুড়ি বছর বাদে শহরের Big Joe Brady’s রেস্তোরাঁয় আবার দেখা করবে। আজ কুড়ি বছর বাদে এক শীতের সন্ধ্যায় Bob সেই রেস্তোরাঁয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে Jimmyর অপেক্ষায়। আচমকা রাতের শিফটের এক পুলিস তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য হাজির হয়। উৎসাহের সঙ্গে Bob তাকে দুই বন্ধুর পুনর্মিলনের প্ল্যানের কথা বলে, আর একটু গর্বের সাথে জানায় যে তার এখন সুদিন ফিরে এসেছে, সে এখন রীতিমত ধনী। সে পুলিশকে আরও বলে সে নিশ্চিত, যে Jimmy আসবে তার সাথে দেখা করতে। অবশেষে “Jimmy” আসে রেস্তোরাঁয় আর দুই বন্ধু আলোর নিচে এক টেবিলে এসে বসে। Bob লক্ষ্য করে যে এই Jimmyকে সে চেনে না,তার ছেলেবেলার সেই বন্ধুর মুখ অনেক বদলে গেছে, এমন কি তার সেই টিকলো নাক এখন কেমন ভোঁতা! প্রশ্ন করলে সেই মানুষটি উত্তর দেয় সে আসলে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ আর তার পরই সে Bobকে এক দাগি আসামী বলে গ্রেফতার করে। হাজতে যাবার পথে সেই মানুষটি Bobকে Jimmyর লেখা একটি চিঠি দেয়, তাতে Jimmy লিখেছে, “BOB, I was at the place on time. I saw the face of the man wanted by Chicago cops. I didn’t want to arrest you myself. So, I went back and got another cop and sent him to do the job. JIMMY। গল্পের শেষে আচমকা ও অপ্রত্যাশিত মোড়ের এই উদাহরণ এককথায় ও. হেনরির ট্রেডমার্ক!
আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসে ও. হেনরি এক অসাধারণ গল্পকার। লেখক জীবনে তিনি সর্বসাকুল্যে ৩৫০টি গল্প লেখেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় তার গল্পের অনুবাদ মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেছে।
এই ছোটগল্পের জাদুকরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমেরিকায় এখনো প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের লেখককে O. Henry Award দিয়ে সম্মানিত করা হয়।